ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মহাদেব সাহা : হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশ

সাইফুজ্জামান
🕐 ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ০৫, ২০২০

মহাদেব সাহার জন্ম ৫ আগস্ট, ১৯৪৪ সালে। সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে। শ্রাবণ বর্ষা ধারায় সিক্ত হয়ে প্রকৃতি অবগাহিত হয়েছিল সেদিন। তার মা বিরাজমোহিনী ছিলেন গান ছড়া শ্লোকের উৎস। মায়ের কাছ থেকে যা পেয়েছিলেন তা হচ্ছে কবিতার নিরন্তর ধারা। অশেষ সম্ভার। লেখালেখির শুরু থেকে প্রকৃতি, নদী, মানুষ, বর্ষা তার কবিতায় বারবার ফিরে আসে। এই পৃথিবী তার প্রিয়। সাধারণ মানুষের মুক্তি চায়। তিনি দ্রোহী হয়ে অজস্র কবিতা রচনা করেছেন। ব্যক্তিগত বিষয়, প্রেম, সৌন্দর্য দয়িতার উদ্দেশ্যে তার রচিত পঙ্ক্তিমালা পাঠকপ্রিয়। কবিতা ভাব, ভাষা ও বক্তব্যের সেতু। মহাদেব সাহা মহৎ ও সত্যদ্রষ্টা কবি। তার ক্ষেত্র ব্যতিক্রম হয়নি। ষাট দশক একদল কবি নতুন ভাবনাক সঙ্গী করে কবিতাচর্চায় অগ্রবর্তী হয়েছিলেন। প্রচলিত রোমান্টিক মানস প্রবণতা অস্বীকার করে এরা অস্তিত্ববাদ কবিতায় প্রযুক্ত করেছিলেন। এই দশক কবিতাঙ্গন মহাদেব সাহার আবির্ভাব। তিনি গভীরভাবে সাম্যবাদে বিশ্বাসী। মানুষের মনোজাগতিক সম্পর্ক তাকে গভীর আলোড়িত করেছে। শৈশব থেকে মহাদেব ভাবুক ও কল্পনাপ্রবণ ছিলন। উপনির্বাচনে প্রচারণা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার গ্রামে একবার আসেন। শিক্ষকদের অনুরোধে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা করে ওই সভায় পাঠ করেন। মহাদেবের কবিতা শুনে বঙ্গবন্ধু আশীর্বাণী করেন। তারপর থেকে তার পথ চলা নিরন্তর। অজস্রধারায় কবিতা রচনা করে তিনি জনপ্রিয়।

১৯৬০ সালে ধুনট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। গ্রাম থেকে সদ্য ঢাকায় আসা তরুণের মনোযোগের কেন্দ্র ছিল নিউমার্কেট, উঁচু দালানকোঠা, তরুণী, ঢাকার চাকচিক্য। অসুস্থ হয়ে তিনি বগুড়ায় ফিরে যান। ১৯৬৪ সালে মহাদেব সাহা বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। মহসিন আলী দেওয়ান সম্পাদিত বগুড়া বুলেটিন-এ তিনি যুক্ত হন। কবি আতাউর রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। আইএ পাস করে মহাদেব সাহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তার কবিতার সঙ্গে বসবাস তখন থেকে নিয়মিত। রবীন্দ্রনাথ মহাদেবের গভীর আগ্রহের বিষয় হয়ে যায়। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিতার ঐতিহ্য’। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সম্পাদিত ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় ‘আনন্দের মৃত্যু নেই’ কবিতা প্রকাশিত হলে মহাদেব বোদ্ধা মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একই সময় হাসান আজিজুল হক সম্পাদিত উত্তর অন্বেষা সাহিত্য কাগজ ‘হেমন্তের কবিতা’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতা প্রকাশিত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যানভাস, প্রিয় শিক্ষক ও বন্ধুরা তাকে নিত্য নতুন কবিতা রচনায় উৎসাহ প্রদান করেন। উন্মত্ত পদ্মা, সবুজ অরণ্যানী, উদার মানুষ, প্রিয়তমা নারী তাক দিয়ে লিখিয়ে নেয় অজস্র কবিতা। মহাদেব কবিতা প্রেমে হাবুডুবু নিমগ্ন তখন। 

১৯৬৮ সাল তিনি এমএ পাস করেন। আবদুর রশীদ খানের আইডিয়াল প্রিটিং প্রেস আড্ডায় মশগুল তিনি গভীর রাতে ঘরে ফিরতেন। ইংরেজি-বাংলা সাহিত্য গবেষণা, বাম রাজনীতির পাঠে ঘোরলাগা দিনগুলোর স্মরণীয় মুহূর্ত জ্বলজ্বল করে স্মৃতিতে। ঊনসত্তরে ছাত্র-শিক্ষকদর ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাক সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা গুলিবিদ্ধ হন। সামান্য দূরে ছিলেন মহাদেব সাহা ও সিকান্দার আবু জাফর। কারফিউ ভেদ করে ভিসি ভবনের দিকে এগিয়ে যান মতিউর রহমান বাচ্চু, জুলফিকার মতিন ও মহাদেব সাহা। ভিসি অধ্যাপক শামসউল হককে তারা জোহার হত্যা সম্পর্কে অবহিত করেন। স্বাধিকার আদালনের মুখপত্র ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ প্রকাশনার ওপর পাক সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয় বিক্ষোভ-প্রতিবাদের ফলে। মহাদেব সাহা ঢাকায় এসে ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে পরিচিত হন। তার রচনা কণ্ঠস্বরে প্রকাশিত হয়।

পরিক্রমা, মাসিক মোহাম্মদী, মাহেনও পত্রিকায় মহাদেব সাহা রচিত কবিতায় স্বদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, প্রণয়, বিরহ, সমাজভাবনা বিষয়ক চিন্তা প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালর ২৯ জুন ঢাকায় এসে তার কবিতার জগৎ খুলে যায়। সমকাল অফিস বন্ধু মলয় ভৌমিকের মাধ্যমে পরিচয় ঘটে কবি নির্মলেদু গুণের সঙ্গে। একসময় সাক্ষাৎ হয় নিউমার্কেটে সৈয়দ আকরম হোসেন, আবুল হাসান ও হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে। ঢাকা প্রেমমগ্ন মহাদেব রাজশাহী ফিরে গেলে পূর্বদশ পত্রিকা থেকে তার নামে টেলিগ্রাম যায়। সহকারী সম্পাদক হিসেবে তিনি নিয়োগ পান। এসময় কর্মসূত্রে তিনি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, নির্মল সেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এম আর আখতার মুকুলের সঙ্গে। মহাদেব সাহার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, সুরাইয়া খানম, হুমায়ুন কবির তার কবিতায়, স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। আড্ডার মধ্য থেকে উত্তাল ভার, সজীব, স্মৃতি, সবুজ বাগান, পিকনিক, শিশির কুয়াশা। আলো-আঁধারের লুকোচুরির মধ্য থেকে জীবনকে বারবার ফিরে দেখেছেন তিনি। আবুল হাসানের সহপাঠী মাহফুজুল হক খান তার বন্ধু তালিকায় স্থান পান। সানাউল হক খান, মোহাম্মদ রফিক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, সমুদ্র গুপ্ত, রুবী রহমান, মামুনুর রশীদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে তার বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর হৃদরোগে ভুগে কবি আবুল হাসান পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন মহাদেব। তার গায়ে জড়ানো শাল দিয়ে হাসানের মৃতদেহ ঢেকে দেন। গ্রাম থেকে আসা হাসানের পরিবারের সদস্যদের ঠাঁই হয় মহাদেবের বাসায়। হাসানের বৃদ্ধ পিতা পুত্রের মৃত্যুশোক ভুলে থাকতে মহাদেবের কাছে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। মহাদেব তখন বেকার। তিনি বন্ধুত্বকে অস্বীকার করেননি, বন্ধুর পিতাকে পিতৃশ্রদ্ধা দিয়ে কাছে রেখেছেন।

মহাদেব সাহা কবিতার পাশাপাশি স্বনামে, ছদ্মনামে গদ্য লিখেছেন। ১৯৭৯ সালে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন। দীর্ঘদিন তিনি ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছেন। দু’হাতে লিখেছেন কবিতা, গল্প, নানা ধরনের গদ্য। মহাদেব সাহা ১৯৮৩ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। পুরস্কারের অর্থ তিনি মনিসিং-এর কমিউনিস্ট পার্টিকে দান করেন। মহাদেব সাহা সামরিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাব অংশগ্রহণ করেছেন। তার কণ্ঠে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ চায় না তোমাকে, তুমি চলে যাও। যাও’-এর মতো পঙ্ক্তি। ডা. শামসুল আলম মিলন ও নূর হোসেনকে স্মরণ করেও তিনি কবিতা রচনা করেছেন।

বাংলাদেশের ভূপ্রকতি, নদী, পাখি, রমণী, সাধারণ মানুষ তার কবিতায় জল ছবির মতো উদ্ভাসিত হয় বারবার। প্রেম ও প্রকৃতির বন্দনায় মুখর কবি কতবার অভিমান ও ভালোবাসায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। নারী প্রেমে আপ্লুত কবি জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছেন ভালোবাসায়। প্রেম পূজারী, দ্রোহী কবি স্বদেশ হৃদয়ে ধারণ করেন। তার কবিতার বিষয়- প্রকতি, উপমা এর প্রমাণ দেয়। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। স্বদেশ বন্দনা, সমাজ ভাবনা ও রাজনীতি সচেতনতায় মহাদেব যুক্ত হয়েছেন। ধুলামাটির মানুষ (১৯৮২), তুমি বিষণ ফুল (১৯৯৯) কাব্যগ্রন্থের কবিতায় জন্ম গ্রাম, প্রকৃতি, ফুল, পাখি, মানুষ আর মর্মবেদনা মুখ্য হয়ে ওঠে। মহাদেব সাহার প্রেমের কবিতার মধ্যে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ, ফুলের সৌরভ, মাটির স্পর্শ লেগে থাকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর মহাদেব সাহা কাতর হয়ে পড়েন। পিতার মৃত্যুতে যন্ত্রণাবিদ্ধ সন্তান কবিতায় তার শোক প্রকাশ করেছেন। জার্মানিতে এক ভায়োলিন বাদক তার কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সম্বলিত দশ টাকার নোট দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রকৃতি, গ্রাম, সরল মানুষ, জীবন সংগ্রামকে মহাদেব কবিতার মূল ভিত্তি করেছেন। আকাশ, উদাসীন মেঘ, বনভূমি, শৈশব স্মৃতি তার কবিতার প্রিয় অনুষঙ্গ। বাংলার সৌদর্য ছাড়া কোথাও যেতে ইচ্ছা হয় না তার। আজিমপুরের ছোট্ট মহল্লায় তার কেটেছ অনেকটা সময়। ঢাকা নগরে এক ধরনের মুগ্ধতা নিয়ে তিনি মানসপ্রতিমাকে খুঁজে পেয়েছেন। নারী, প্রকৃতি তার কবিতায় হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি হেঁটে যায়। এই শহর ছেড়ে প্রিয় গ্রামে তিনি হুট করে চলে গেছেন অজস্রবার। ‘উলঝুলু বন’ ‘বিষণœ পাথর’ খালের মতো শুকনা নদী তার চোখ মায়াবী পর্দা তৈরি করে। এক টুকরো বাংলাদেশ তার সঙ্গী সর্বক্ষণ।

সাইফুজ্জামান : কবি ও প্রাবন্ধিক; উপ কীপার, জাতীয় জাদুঘর
[email protected]

 
Electronic Paper