ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দিস ইজ এ...

আলী হাসান
🕐 ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৩১, ২০২০

কেষ্টহাটী গ্রামটিকে উপর থেকে দেখলে আয়েস করে ডানদিকে কাত হয়ে উত্তর-দক্ষিণে শোয়া কোনো পুরোহিতের মতো দেখায়। পা দু’খানা গ্রামের উত্তরপ্রান্ত, দণ্ড অক্ষরকে টেনে প্রায় সোজা করলে যেমন হয় তেমনভাবে পড়ে আছে। মালকোঁচা দেওয়া ধুতিসহ ঈষৎ-ঝোলা পেটকে গ্রামের মূল বসতি ধরলে পৈতাখানি মেটেপথ, আর ন্যাড়া মাথাটি গ্রামের দক্ষিণ সীমানার পাঠশালা। দেশভাগের আগে পঁচিশটির মতো হিঁদু পরিবারের বাস ছিল এ গ্রামে। স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর সেই সংখ্যা কমে কমে এগারোতে ঠেকেছে।

যারা ভারতে চলে গেছে তাদের সম্পত্তি-বাড়িঘর অবশিষ্টদের আরও বিত্তবান করে বাবুগিরি বাড়িয়েছে। তারা কেউ মাস্টার, কেউ ডাক্তার, কেউ মজুতদার-ব্যবসায়ী- পরিষ্কার পোশাক পরে, বড় ইঁদারার জল খায়, নানা প্রকার আমোদ-প্রমোদে মন উজ্জীবিত রাখে। পাঠশালায় শিশুকিশোরদের কলরব গ্রামে সুখাবেশ ছড়ায়।

আশপাশের মির্জাতলা, চানপুর, চরপাড়া ও নিমতলার মুসলমান-সন্তানের সংখ্যাই পাঠশালায় বেশি। এ সংখ্যা আরও বেশি হত যদি না মামলা-মোকদ্দমা, খুনোখুনি আর থানা-পুলিশ করে মুসলমান পরিবারগুলো নিঃস্ব হতে থাকত। কেষ্টহাটীর হিঁদুদের বিশাল বিশাল জমির দাগ আবাদ করে এসব গ্রামের কৃষকরা। কৃষকদের সংসার জনবহুল, অপুষ্টিতে বেড়ে ওঠা সন্তানাদিতে ঠাসা। ভাবনাটা এমনÑ ছেলে যত বেশি, বর্গাজমি তত বেশি।

মির্জাতলার জালাল মিয়ার দুই ছেলে এক মেয়ে। বড়জন আকাব্বর আলী, ছোট দু’জনের চেয়ে একটু বেশিই বড়। যৌবনে কী কারণে এক ছেলের পর সংসারে খরা গেছে জালাল মিয়ার, সন্তানের চাষে কিছুটা পিছিয়ে। পাঠশালার সামনে বিশাল ফসলের মাঠ, বহুদূর পর্যন্ত বাড়িঘর-গাছপালা চোখে পড়ে না। দূরদেশ থেকে দীর্ঘ বাতাস এসে পাঠশালার বেড়াহীন ঘরের ভেতর দিয়ে হু হু করে গ্রামে ঢোকে। পাঠশালা ছুটির পর তাই অনেক অলস মানুষ বেঞ্চে শুয়ে সুখনিদ্রা যায়। জালাল মিয়ার অধিকাংশ বর্গাজমি এ মাঠেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমিতে কাজ করে সে। নতুন ধানের চারার দিকে তাকিয়ে যেমন নতুন দিনের পদধ্বনি শোনে তেমনি পাঠশালাটির দিকে তাকিয়ে ছেলেটাকে কেষ্টহাটীর বাবুদের মতো শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখে।

সকালে বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাজ করে পাঠশালায় আসতে আকাব্বরের প্রায়ই দেরি হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের গা-সওয়া ঘটনা, কোনো স্যারই এজন্য কৈফিয়ত চায় না। আকাব্বর ছোট একটা সালাম দিয়ে বিড়ালের মতো বেঞ্চের এক প্রান্তে বসে। এ বছর সে চতুর্থ শ্রেণিতে। বয়সের হিসাবে আরও উপরে থাকার কথা ছিল, কিন্তু তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি পেরোতে দুই বছর বেশি লাগায় ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পড়তে হচ্ছে।

সামান্য কুঁজো হয়ে সামনে ঝুঁকে বসলেও এক-দেড় বিগত উঁচুতে থাকে মাথা। রঙজ্বলা পুরনো জামার বুকের কাছের বোতামের স্থলে একটি সেফটিপিন আনাড়ি হাতে লাগানো। জামার ফাঁক গলে ঈষৎ উঁচু বুকটি অনেকেরই চোখে পড়ে। দীর্ঘদিনের হাঁপানিতে হাঁপাতে হাঁপাতে বুকটা কিঞ্চিৎ ইঁদুর-ডিবির মতো হয়ে উঠেছে। আকাব্বর যে একদমই পড়া পারে না তা নয়Ñ বাংলা বইয়ের দুই-তিনটা কবিতা, গরু বিষয়ে রচনা ঠেকা ঠেকা হলেও লিখে দেখাতে পারে। সাত আর নয়-এর ঘরে কিছুটা অসুবিধা হলেও এগার’র ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্তই বলা যায়। স্যাররা তাকে পড়ার জন্য তেমন চাপ দেয় না, বরং কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে প্রায় পুরোটাই আগে আগে বলে যায়। কিন্তু হেডস্যারের ইংরেজি পড়াটা ভয়ঙ্কর সমস্যা। স্যারের মেজাজ যেদিন গরম থাকে এলোপাতাড়ি হাতে-পায়ে-পিঠে বাঁশের কঞ্চির সপাসপ বাড়ি পড়তে থাকে। মাইর গ্রহণকালে কত রকম আঁকাবাঁকা-লাফালাফি যে করে, না দেখলে অনুমান করা কষ্ট। এ রকম অঙ্গভঙ্গি আত্মরক্ষার একটা কৌশলও হতে পারে।

একদিন তো বাড়ির তোড়ে লাফ দিয়ে বেঞ্চ ডিঙিয়ে দত্তদের বাঁশঝাড়ের দিকে ভোঁ-দৌড়। হেডস্যারের এই নির্দয় আচরণ শুধু শারীরিক নয় মানসিক কষ্টেরও কারণ। ঘরে পার্টিশন নেই, প্রহারের দৃশ্যে নিচের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তো বটেই মাঠের ঘুঁটেকুড়ানি শিশুরা পর্যন্ত এদিক চেয়ে হাসাহাসি করে- এ কী কম লজ্জার! আজ শনিবার, হেডস্যারের চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সহপাঠীরা সুযোগ পেলেই ইংরেজি পড়াটা ঝালিয়ে নিচ্ছে। আকাব্বর সেদিকে তাকিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করে কী বলছে তারা।

দিস ইজ এ ব্যাগ- এটি একটি থলে, হয়ার ইজ ইউর পেন- তোমার কলম কোথায়... এমন কিছু বাক্য কানে আসে। হেডস্যার এল দুই পিরিয়ড পর, যেন বাঘ ঢুকল ক্লাসে, সবাই চুপ। শ্যামলা খিটমিটে চেহারার আকাব্বরের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠল। স্যার একদিক থেকে পড়া ধরছে, টুকটাক ভুলভ্রান্তি হলেই পিঠে দুই-এক ঘা পড়ছে। আকাব্বর ভাবে- এ রকম হলে তো কথাই ছিল না, তার বেলায় শুরু হয় গোপ্রহার। পরের চার লাইন পড়- আকাব্বরের প্রতি দারোগার মতো কণ্ঠস্বর হেডস্যারের। সে স্থির বসেছিল, শান্তভাবে দাঁড়াল, বইটা মেলে চোখের সামনে ধরল, কিছুক্ষণ নীরব। কঞ্চিটা কঠিন হচ্ছে, সে হঠাৎই বলে উঠলÑ দিস ইজ এ...! আর শব্দ নেই, কাঁপছে শরীর।

হেডস্যারের চোখে একটা অভূতপূর্ব ভাষা ফুটে উঠল, একরাশ হাসিতে মুখম-ল ফেটে পড়ল- বাবা আকাব্বর, ‘দিস ইজ এ...’ বোইলা যে ঠেলা দিলি, ঠেলায় তো কোনো কাম হইল না! পান-খাওয়া দাঁতগুলো বের করে প্রচণ্ড হাসছে স্যার। সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্লাসের সবাই হাসছে, শুধু একজন ছাড়া। পাঠশালা ছুটি পর্যন্ত সময়টুকু নীরবে কাটল ছেলেটির, যা তার স্বভাবসিদ্ধ নয়। ছলছল চোখে কী ভাবছিল কে জানে! প্রহারের চেয়ে অপমানের বোঝা বোধহয় একটু বেশিই ভারী। এরপর থেকে আর আকাব্বরকে পাঠশালায় দেখা যায়নি।

 
Electronic Paper