দর্শনভিত্তিক উপন্যাস- চার্বাক
রাহমান হারুন
🕐 ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৩১, ২০২০
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলা কথাসাহিত্যের নবতর নির্মাণ খুব কম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, শহীদুল জহির যে নতুন দিক মেলে ধরেছেন কথাসাহিত্যে এর তুলনা কেবল তারা নিজেরাই। কোনো জাতির সাহিত্য কতটা এগুলো তা বোঝা যায়- সে জাতির ছোটকাগজ কিংবা স্বল্পায়ু পত্রিকাগুলোর প্রতি দৃষ্টি রাখলেই। কিন্তু এর বাইরেও বোধকরি কিছু লেখক নতুন মাত্রার লেখা লিখতে চান নিজের মতো করে। চার্বাক সুমন কর্তৃক লিখিত ‘চার্বাক’ নামক উপন্যাসটি ঠিক তেমনই একটি নবতর সৃষ্টির দিকে আলো ফেলেছে।
উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে প্রাচীন ভারতের চার্বাক দর্শনকে অবলম্বন করে। ফলে এই উপন্যাসকে দর্শনভিত্তিক রচনা বলাই শ্রেয় মনে করি। রচয়িতা সুমন- ঠিক কী কারণে এই দর্শনকে বেছে নিলেন উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসেবে সেটা আমরা ভাবতেই পারি- কেননা, চার্বাক দর্শন প্রাচীন ভারতের প্রথম দর্শন। চার্বাক নামক কোনো মনীষীর অস্তিত্ব ছিল কিনা এই ভারত বর্ষে তা আমরা আজও জানি না। যেমন- খনা নামক যে বচন রচয়িতাকে আমরা একক কেউ ভাবি ঠিক তেমনই ভাবনা চার্বাক নিয়েও। কিন্তু চার্বাক দিন শেষে একটি দর্শন হিসেবেই এসেছে আমাদের সমুখে।
কী ছিল তবে চার্বাক কিংবা কে ছিলেন চার্বাক? আমাদের তা জানা নেই- ধারণা করা হয় এই নামে কোনো ঋষি ছিলেন। যার চিন্তার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল- বস্তুবাদী এক চিন্তা আর অস্বীকার করেছিলেন তিনি- আর্য ও অনাযের্র সকল অযৌক্তিক বিশ্বাস। চার্বাক দর্শনে ব্যাপক সমালোচনা করা হয়- আর্য ধর্মের। আর্য-অনার্যের এই বিবদমান পর্যায় ধরে নেওয়া হয় চার্বাক অনার্যের পক্ষের। এইরকম একটি পর্যায়ে চরম সত্যকেই তারা শতভাগ প্রমাণাদি দিয়েই মানতে চাইতেন তাও নন। ঘটনার কার্যকারণ, সম্পর্ক সকল কিছুই বুঝতে চাইতেন- বুঝতে চাইতেন যুক্তির দ্বারাও ফলে এই দর্শনকে বস্তুবাদী দর্শনও বলা চলে। এইরকম একটি প্রেক্ষাপটে আলোচ্য উপন্যাস এসে চমকে দেয়।
পঠিত উপন্যাস থেকে দু-একটি উদ্ধৃতি এখানে যেন হয়ে ওঠে আরও প্রণিধানযোগ্য-
‘চার্বাক, তোমাকে আরও একটি মন্ত্র শিখিয়ে দেব। সুনৃতা চার্বাককে বলল, পিতার নিকট এই মন্ত্র সম্প্রতি আবির্ভূত হয়েছে। চমৎকার এর অলংকার, ছন্দ, বাক্য ও ধ্বনি প্রবাহ। এর ছন্দের গতিময়তা যেন সরতির জলের মতো স্বচ্ছ, বৈচিত্র্যময়, চিত্তাকর্ষক।’
‘এই মন্ত্র গুরুদেব সম্প্রতি রচনা করেছেন কি?’ চার্বাক বললেন। ‘তিনি এটি রচনা করেননি, চার্বাক! তিনি কোনো মন্ত্র রচনা করেন না। ঋষি কী করে মন্ত্র রচনা করতে পারেন? দেবগণ ঋষির হৃদয়ে প্রবিষ্ট হয়ে মন্ত্রের জাগরণ করেন। যব, ব্রীহির মূল যেমন রস আহরণ করে নিয়ে যায় তেমনি ঋষির হৃদয়ে মন্ত্র উদ্গত হয়।’
‘তুমি এই নিগূঢ় পারমার্থিক জ্ঞানের জন্যে প্রস্তুত নও, চার্বাক। মৃধা বলল, যথার্থ হয় যদি তুমি শমি বৃক্ষের পরিচর্যায় আত্ম-নিয়োগ কর।’
‘যথার্থ বাক্য, মৃধা।’ চার্বাক বললেন, ‘আমি যথার্থই সর্বদা জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হই না। প্রশ্নহীন কোনো জ্ঞানই গ্রহণ করতে সমর্থ নই। আমার অন্তর সদা সংশয় ও ভ্রান্তি দ্বারা পূর্ণ। তুমি যা প্রচেষ্টা বিবর্জিতভাবে অর্জন কর তা অর্জন করতে আমাকে সচেষ্ট হতে হয়।’
উপরের উদ্ধৃতি থেকে এটা প্রমাণ হয় যে- চার্বাক দর্শনের মূল ছিল প্রমাণ, যা নানা উপায়ে তা পরিষ্কার হত। চার্বাক- উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে লেখক তা চমৎকারভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করি। তবে একটি কথা মনে রাখতে হয়- চার্বাক দর্শনের বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান না থাকলে পাঠক যে এই উপন্যাসের মূল রস আস্বাদন করতে পারবেন তা মনে হয় না। তবে উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে নবতর সংযোজন হয়ে রবে। নতুন পাঠকগণও উপকৃত হবেন পাঠ করে। ভাষার যে কাব্যিকতা প্রকাশ পেয়েছে লেখকের রচনায় তা প্রশংসার যোগ্য।