ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আম্র কথন

এস এম মুকুল
🕐 ১২:০১ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০২০

আমের জনপ্রিয়তা সবসময়ই তুঙ্গে। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই আমের ফলন হলেও রাজশাহীর আমের আছে অনেক সুনাম। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আমের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ববাজারে রপ্তানি তালিকায় নতুন যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্য আম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নতুন আশার পথ উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম আম উৎপাদনকারী দেশ। আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন এস এম মুকুল

বাংলাদেশি আমের সুনাম বিশ্বজুড়ে

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে যখন আম পাকে, তখন বিশ্ববাজারে আর কোনো আম পাওয়া যায় না। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে আম চাষ হয় প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে। আমের উৎপাদন কমবেশি ১৪ লাখ টন। উৎপাদিত আমের বাজারমূল্য প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিযোগ্য আমের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার টন। আশা জাগানিয়া খবর হলÑ বাংলাদেশের ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হচ্ছে। যুক্তরাজ্যেও ক্রেতারা বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু ফল হিসেবে বাংলাদেশের আমকে বেশ পছন্দ করছে। গুণে ও মানে অতুলনীয় হওয়ায় বিশ্ববাজারে দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশের আমের চাহিদা। রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট কোম্পানি বাংলাদেশের আম রপ্তানি করবে জার্মান, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে উৎপাদন করতে পারলে বছরে এক হাজার টন আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে। আম উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আম হতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে আমের চাষ হলেও উন্নত জাতের আম হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ ও দিনাজপুরে। আম উৎপাদনে দেশে দ্বিতীয় অবস্থানে সাতক্ষীরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থিত আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, দেশের ২২টি জেলায় এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমের চাষ হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে, সব জেলায় আমের চাষ বাড়াতে বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনে গবেষণা হচ্ছে। এমনকি উপকূলীয় লবণাক্ত ভূমিতেও এখন মিষ্টি আমের চাষ শুরু হয়েছে। জানা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি আমগাছ রয়েছে। বাণিজ্যিক চাষে আগ্রহীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে আমগাছ ও বাগানের সংখ্যা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে প্রতি বছর নতুন করে আট হাজার হেক্টর জমি আম চাষের আওতায় আসছে। ফলে বছর প্রতি আম উৎপাদন বাড়ছে ৫০ হাজার টন।


আমের রাজধানী

আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থানকারী চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়। পরের অবস্থানটি রাজশাহীতে ১৬ হাজার ৫১৯ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়। এই কারণে দুই জেলাকে দেশের বাণিজ্যিক আম চাষের আদি ভূমি এমনকি রাজধানী বলা হয়। তবে আশির দশক থেকে চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, নড়াইলেও বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ বিস্তার লাভ করে। গত কয়েক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামেও আম চাষ দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। এর প্রতিফলন হিসেবে দেখা যাচ্ছেÑ বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে এ বছর প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এছাড়া পঞ্চগড়, নাটোর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, পাবনা, দিনাজপুর, রংপুর, যশোর, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুরেও বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হচ্ছে। জেলায় সবচেয়ে বেশি আমের চারা বিক্রি হয় শিবগঞ্জ উপজেলায়। এখানে স্ব-উদ্যোগে শতাধিক বিশেষায়িত নার্সারি গড়ে উঠেছে। ২৫০ প্রজাতির আমের মধ্যে বেশিরভাগেরই চারা পাওয়া যায় এই উপজেলার শাহবাজপুর এলাকার ধোবড়া বাজারে।

জাতীয় বৃক্ষ আমগাছ

বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় মাছ ইলিশ, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আছে জাতীয় উদ্যানও। কিন্তু আমাদের কোনো জাতীয় বৃক্ষ ছিল না। অবশেষে আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণার মাধ্যমে পূর্ণতা পেল জাতীয় বৃক্ষের অভাব। আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণার পেছনে ফল আমের অবদানই বোধহয় বেশি। কারণ, আম খেতে ভালোবাসেন না, এমন বাঙালি পাওয়া কঠিন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় আমের পক্ষে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছে সেগুলো হল- আমগাছ দেশের বেশির ভাগ মানুষ চেনে। গ্রামে আমগাছ নেই, এমন বাড়িও খুঁজে পাওয়া কঠিন। ফল সুস্বাদু হওয়ার পাশাপাশি এর কাঠ ঘর ও আসবাব তৈরিতে বেশ ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের অনুভূতির সঙ্গে আম ও আমগাছের সম্পর্ক আছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ব্রিটিশদের হাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে বেদনার ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেয় এই আম্রকাননে। আমাদের জাতীয় সংগীতে আছে- ‘ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে, ঘ্রাণে পাগল করে...’। এখানে আমগাছের উপস্থিতি দেশপ্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে। আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে অনুমোদন দিতে গিয়ে এসব কিছুকে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর আমের অন্যতম আদি ভূমি বাংলাদেশ। আদি প্রজাতি ছাড়াও বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বেশ কিছু জাতের আম ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সুদর্শন, সুস্বাদু জনপ্রিয়তার কারণেই আম ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের জাতীয় ফল। সরকারি হিসেবে মৌসুমে দেশের মানুষ গড়ে তিন কেজি করে আম খায়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আম উৎপাদনের পরিমাণ দেড় কেজি। ভারত ও পাকিস্তানে এ হার যথাক্রমে ১১ ও ৬ কেজি। তানজানিয়ায় মাথাপিছু উৎপাদন ৭ কেজি, সুদানে সাড়ে ৭, ফিলিপাইনে ৬ ও জায়ারে ৫ কেজি। দেশে শতাধিক প্রজাতির আমের মধ্যে প্রায় ৫০ প্রজাতির আম টিকে আছে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরসাপাত (গোপালভোগ), হিমসাগর, লহ্মণভোগ, মোহনভোগ, গোপালভোগ ও বোম্বাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৮০০ জাতের আম চাষের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১১টি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ২১টি আমের জাত উদ্ভাবন করেছেন।

আমের রাজত্ব চাঁপাইনবাবগঞ্জ

প্রতিবছরই মধু মাসের মৌসুমি ফলের বাজারে রাজত্ব করে। মধু মাসের ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম আম, জাম, লিচু ও কাঁঠাল। এদের মধ্যে উৎপাদন, বাজার মূল্য, জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে আম। কাঁঠাল জাতীয় ফল হলেও আমের জনপ্রিয়তা বেশি। রাজকীয় ফল আম পুষ্টিগুণের পাশাপাশি লাভজনক অর্থকরী ফসল হিসেবেও জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরো অর্থনীতিই আমকে ঘিরে। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে কেন্দ্র করে বছরে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়।
বছরে কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জেই বিক্রি হয় প্রায় ছয় কোটি টাকার দুই লাখ আমের চারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আটশ’ জাতের আম চাষের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১১টি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ২১টি আমের জাত উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে আম্রপালি সবচেয়ে জনপ্রিয়।


বাহারি নাম- গুণে ভরা রঙিন আম

রঙ, স্বাদ, ঘ্রাণের কারণে আমকে বলা হয় ফলের রাজা। আমে আছে- পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, ক্লোরিন, কপার, আয়োডিন, ক্যারোটিন বা ভিটামিন ‘এ’র পূর্বসূরি উপাদান, ভিটামিন বি-১, বি-২, সি এবং খনিজ উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এমন প্রোটিন, আঁশ ও ক্যালরির পরিমাণও রয়েছে বেশি।
শরীরের রক্ত পরিষ্কার রাখে, পটাশিয়ামের অভাব পূরণ করে, লিভার ভালো রাখে, অ্যাসিডিটি নিয়ন্ত্রণ করে, ত্বক উজ্জ্বল করে, দাঁতের রোগ প্রতিরোধ করে, ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে, কিডনির সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে। ফাইবারসমৃদ্ধ হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফজলি, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, খীরসাপাত এ জাতীয় কিছু আম ছাড়া সব আমকেই গুটি জাতের আমের কাতারে ফেলা হয়। বাণিজ্যিক দিক বিবেচনা করে আম বাগান গড়ে তোলার কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে অনেক রকম আম। সচরাচর পাওয়া যায় এমন আমের মধ্যে আছে, কয়েক রকমের ফজলি, গোপালভোগ, মোহনভোগ, জিলাপীভোগ, লক্ষণভোগ, বৃন্দাবনী, চন্দনী, হাজিডাঙ্গ, বোম্বাই ক্ষীরভোগ, মিছরিভোগ, সিঁদুর প্রভৃতি। এছাড়াও গিরিয়াধারী, বউভুলানী, জামাইপছন্দ, বাদশাভোগ, রানীভোগ, দুধসর, মিছরিকান্ত, বাতাসা, মধুচুসকি, রাজভোগ, মেহেরসাগর, কালিভোগ, সুন্দরী, গোলাপবাস, পানবোঁটা, দেলসাদ, কালাপাহাড় প্রভৃতি জাতের। প্রচলিত আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৩০০ জাতের আম পাওয়া যায়। তবে তার অনেকগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। এসব জায়গা দখল করেছে মল্লিকা, আম্রপালি প্রভৃতি জাতের আম। রংপুরে এখন হাঁড়িভাঙ্গা আম চাষে বিপ্লব চলছে। যা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হলে আমের রাজধানী রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রংপুরের গ্রামগঞ্জের কৃষকরা হাঁড়িভাঙ্গা আম উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। রংপুর কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, রংপুর বিভাগের আট জেলায় হাঁড়িভাঙ্গা আমবাগানের পরিমাণ ৪৫ হাজার ৫০০ হেক্টর।

‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি নতুন সম্ভাবনা

‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি এ অঞ্চলের আমচাষিদের জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। নতুন পদ্ধতিতে তরতর করে বাড়ছে আমচাষ। ফ্রুট ব্যাগিং করা আম স্বাদ ও গুণে থাকছে অটুট। তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের এ আম এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে সুদূর ইউরোপের দেশগুলোতে। বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতিতে আম চাষ শুরু করেন জেলার আমচাষিরা। নতুন পদ্ধতি ব্যবহারে কীটনাশকের খরচও অনেক কমেছে। ধীরে ধীরে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি এ অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।


ফজলি একটি আমের নাম

আমের অন্যান্য জাত ছাড়াও বিশেষ করে রাজশাহীর ফজলি বিখ্যাত। ফজলি আম বাজারে আসে সবার শেষে। আকারেও যেমন বড়, স্বাদেও অদ্বিতীয়। তাই আমের রাজা বলা চলে ফজলিকে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মালদা জেলা এবং বাংলাদেশের উত্তরদিকের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ফজলি চাষের জন্য বিখ্যাত। দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বদিকে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে পাওয়া যায়। আমের অন্যান্য প্রজাতির থেকে দেরিতে ফলে এটি। আকারে বেশ বড় এই আম জ্যাম ও আচার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কথিত আছে, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মালদহের কালেক্টর র‌্যাভেন সাহেব ঘোড়ার গাড়িতে চেপে গৌড় যাচ্ছিলেন। পথে তাঁর তৃষ্ণা পায়। তখন গ্রামের এক মহিলার কাছে পানি চান। ফজলি বিবি নামে সেই মহিলার বাড়ির আঙিনায় বড় একটি আমগাছ ছিল। ফজলি বিবি তাকে জলের বদলে একটি আম খেতে দেন। আম খেয়ে কালেক্টর সাহেব ইংরেজিতে তাকে আমের নাম জিজ্ঞাসা করেন। বুঝতে না পেরে ওই মহিলা তার নিজের নাম বলে বসেন। সেই থেকে ওই আমের নাম হয়ে যায় ফজলি। অবশ্য ফজলি আমের নাম নিয়ে আরো অনেক কথিত গল্প প্রচলিত রয়েছে।


বছরে চারবার ফলন দেবে আম

আমের ক্ষেত্রে নতুন সুসংবাদটি হল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ রিজিওনাল হর্টিকালচার রিসার্চ স্টেশনের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বারি আম-১১ নতুন জাতের আম বছরে চারবার ফলন দেবে। জানা যায়, প্রথমে মে মাসে, দ্বিতীয় পর্যায়ে আগস্ট মাসে, তৃতীয় পর্যায়ে নভেম্বর এবং চতুর্থ পর্যায়ে ফেব্রুয়ারি মাসে এই আম পাকবে। বারি-১১ জাতের আম খেতে মৌসুমি আমের মতোই লাগবে। গাছগুলোর এ বৈশিষ্ট্য স্থায়ী হলে দেশে আম উৎপাদনে বিপ্লব ঘটবে। ফলে ফলপ্রেমীরা সারা বছরই পাবেন আমের স্বাদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টার সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে ‘নীলউদ্দিন’ নামে আমের জাতটি কৃষিবিদ কামরুজ্জামান ভারত থেকে নিয়ে আসেন। এরপর হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃবাগান হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সেখানে গবেষণা করে এ কলম চারা ২০০৩ সাল থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের সরবরাহ করা হয়। তিনি আরও জানান, বছর দু’বার পাওয়া যায় ‘নীলউদ্দিন’। আমের মৌসুমে একবার। আবার অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আরও একবার। এ জাতের আম অসময়ে ভারতে বেশি পাওয়া যায়।
আম সংরক্ষণে কেমিকেলের ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনতে ‘হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এই পদ্ধতিতে মাত্র ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য আম রাখলেই বৃদ্ধি পাবে আমের সংরক্ষণ কাল। গুণগত মান অক্ষুণ রেখেই রোধ করবে আমের পচন। রাজশাহী ফল গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন বলেন, গাছ থেকে পাড়া পরিপক্ক আম সংরক্ষণে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর।


ফ্রুুট ড্রিংকস ও জুস শিল্পে সম্ভাবনা

কৃষিপণ্য আমকে শিল্পপণ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে আমশিল্প গড়ে তোলার সব রকম উপকরণই বাংলাদেশে রয়েছে। আম থেকে তৈরি হতে পারে আমের রস, মোরব্বা, স্কোয়াশ, জেলি, পাল্প, টফি, মধু, আমসত্ত্ব, বরফি, আচার, জ্যাম, পাউডার। আম ফলের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে জুসশিল্প।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমের জুস এখন রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দেশের অভ্যন্তরে ও রপ্তানি মিলে জুসের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার। জুসের বাজারে প্রাণ, আকিজ, একমি, সজীব, ট্রান্সকম ও পারটেক্স গ্রুপ এগিয়ে আছে। জুসের বাজারে প্রাণ গ্রুপের ব্র্যান্ড ফ্রুটো, আকিজের ফ্রুটিকা, একমি গ্রুপের একমি, সজীব গ্রুপের সেজান, ট্রান্সকমের সøাইস ও পারটেক্স গ্রুপের ড্যানিশ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের জুস রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশেÑ আরব আমিরাত, আবুধাবি, দুবাই, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান ছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইতালি, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের বাজারে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটি হচ্ছে, দেশে উৎপাদিত এবং বাজারজাতকৃত জুস ও ফ্রুট ড্রিংকসে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। আরো দুঃখজনক ব্যাপার হল, ব্যাপক উৎপাদন ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার পরও দেশে সঠিক সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার ফলে আম আহরণের পর প্রায় ৩৩ শতাংশ আম নষ্ট হয়।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper