ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মুখ

বিশ্বজিৎ দাস
🕐 ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০২০

বন্যা পর্ব
কয়েকদিন ধরেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। পড়ছে তো পড়ছেই। থামার নাম নেই। শহরের চারপাশের খালবিল, নদী-নালা, পুকুর সব উপচে পড়ছে। বস্তি এলাকায় অনেক ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। তারা নিজ নিজ বাড়ি ছেড়ে উঁচু রাস্তার উপর আশ্রয় নিয়েছে। শহর রক্ষা বাঁধও ভেঙে গেছে কাল। শহরে পানি ঢুকছে হু হু করে। ধারণা করা হচ্ছে বিকেলের মধ্যে শহরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হবে। খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।

পরিবার নিয়ে মানুষ যেমন বিপদে পড়েছে, ঠিক তেমনি বিপদে পড়েছে তার পোষা প্রাণীগুলোকে নিয়ে। গরু আছে, খাবার নেই। ছাগল আছে, পাতা নেই। ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে চারদিকে।
‘দেশের অবস্থা বেশ খারাপ।’ সজীব বলল। ‘সে তো হবেই। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। মানুষ আর কত কষ্ট করবে।’ বলল নীরা। সজীবের স্ত্রী। এই বন্যায় তার কাজকর্ম অনেক বেড়ে গেছে। বাচ্চা দেখাশোনার পাশাপাশি রান্নার ঝামেলা বেড়েছে। সজীব বাসাতেই থাকছে। তার জন্য মাঝে মাঝে ভালো কিছু রান্না করতে হচ্ছে।
‘কোনো কিছু কিনতে হবে নাকি?’ জানতে চাইল সজীব।
‘কেন?’ ‘পরে সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাবে। খাবার-দাবার সহজে হয়ত পাওয়া যাবে না।’
‘হুম।’ নীরা ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর কাগজ কলম নিয়ে বসল। ঝটপট লিখে ফেলল যা যা মনে এল।
সজীব বেরিয়ে পড়ল লিস্ট নিয়ে। হাতে ছাতা। বাড়িতে টাকা আছে, এটাই ভরসা। ভাগ্যিস দোতলার বাসায় ভাড়া নিয়েছিলামÑ যেতে যেতে ভাবল সজীব। এই বৃষ্টি আর বন্যার মধ্যে নিচতলায় বাসা নিলে এমনিতেই খুব কষ্ট হত। কে জানে, রাতে ঘুমিয়ে থাকার সময় হয়ত পানিই ঢুকে পড়ত। কেনাকাটা সেরে বাসায় ঢোকার মুখে আধো অন্ধকারে তিনজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সজীব।
‘কে?’ ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল ও।
‘আমি রে। সাধন।’
‘ও সাধন। তা এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সজীব। ‘বাসায় তো পানি ঢুকে গেছে। কী করব বুঝতে পারছি না। আজ রাতটা তো কোথাও থাকা দরকার। তাই তোর কাছে এসেছি।’
ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল সজীবের। অন্ধকারে কেউ অবশ্য সেটা দেখতে পেল না। নীরা ভালো স্ত্রী, কোনো সন্দেহ নেই। তবে নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পছন্দ করে। সাধন বিপদে পড়েই তো এসেছে আশ্রয় চাইতে। এখন নীরা যে কী বলবেÑ দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরে ঢুকল সজীব।
অসুবিধা অবশ্য হওয়ার কথা নয়। ওদের ফ্ল্যাটে একটা ঘর তো খালি পড়েই থাকে। সাধন ওর ছোটবেলার বন্ধু। বন্ধু তো বন্ধুর বাসাতে থাকতেই পারে। কিন্তু এই বন্যা ছাড়তে তো সময় লাগবে। নীরা কি রাজি হবে? ভয়ে ভয়ে নীরাকে ঘটনাটা খুলে বলল সজীব।
‘ও মা! তুমি ওদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছ কেন? তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো।’ সজীবকে অবাক করে দিয়ে বলল নীরা। ‘ওরা কিন্তু আজ রাতটা থাকবে।’ ‘থাকুক। বিপদে পড়েছে। যাবে কোথায়? তুমি নিয়ে এসো তো। যতদিন বন্যার পানি না কমবেÑ ওরা থাকবে; নিয়ে এসো তো।’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সজীব ভাবল, একসঙ্গে এতদিন সংসার করেও আজ পর্যন্ত নীরাকে চিনতে পারল না।

করোনা পর্ব
সত্যি সত্যি সাধনকে দেখে চিনতে পারল না সজীব। আসলেই অনেক পরিবর্তন হয়েছে তার। গায়ে গতরে স্বাস্থ্যবান মনে হচ্ছে তাকে।
‘কী রে সজীব! কেমন আছিস তোরা?’ ‘আছি ভালো। তোরা সবাই কেমন আছিস?’
‘ভগবানের কৃপায় ভালোই আছি।’
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। সাধন ওকে ঘরে বসতেও বলল না। সে পরিস্থিতিও অবশ্য নেই! করোনাকাল চলছে। একটু পর বলল, ‘কিছু বলবি সজীব?’
‘বলব কিনা তাই ভাবছি। তুই কী মনে করবি।’
‘না না। মনে করব কেন? তুই বল।’
‘আমার তো কোম্পানির চাকরি। এই করোনার সময়ে কোম্পানি বন্ধ হয়ে আছে। বেতনও বন্ধ। আমার হাতে নগদ টাকা একদম নেই।’ সজীব বলল। ‘বুঝেছি।’
ইতস্তত করল সজীব।
‘তুই কি আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবি; কয়েকদিনের জন্য।’
‘কত টাকা?’
‘হাজার পাঁচেক দিলেই চলবে। আমাদের একটা ডিপিএস পরের মাসে পূর্ণ হবে। সেটা ভাঙালেই টাকাটা দিয়ে দেব।’
‘আচ্ছা, দাঁড়া। আমি আসছি।’
সাধন ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। দরজা আধখোলাই রইল। একটু পরই সাধনের স্ত্রীর গলা শুনল সজীব। ‘লোকটার কি আক্কেল-জ্ঞান কিছুই নেই! এই করোনার মধ্যে এসেছে টাকা চাইতে!’
‘আহ্! আস্তে। সজীব শুনতে পাবে।’ সাধন বলল। ‘শুনতে পেলে আমি কী করব! তোমার বন্ধু কি জানে না, তুমি কেমন কোটিপতি! নাকি তুমি দাতা হাতেম তাই।’ শ্লেষ মিশিয়ে বলল সাধনের স্ত্রী।
‘অত চেঁচিয়ে কথা বল কেন। টাকা চেয়েছি, টাকা দাও। বিপদেই তো বন্ধু বন্ধুর কাছে চায়।’
‘কেমন বন্ধু! একসঙ্গে পড়েছিলে? না সাঁতার কেটেছিলে? উনি যদি তোমার বন্ধুই হতেন, তাহলে অন্তত এই করোনার সময়ে মাস্ক-গ্লাভস পরে বাসায় আসতেন। বুঝেছ?’
নিজের মুখে হাত বোলাল সজীব। সত্যিই তো মুখে মাস্ক পরে আসতে হত। কিন্তু হাতে টাকা নেই! মুখেই তো খাবার জুটছে না। মুখ ঢাকবে কী করে! এখন তো এই মুখটাকেই সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হচ্ছে নিজের কাছে।
একটু পরই হাসিমুখে দরজা দিয়ে টাকা নিয়ে বের হল সাধন। সজীবের মুখ থেকে দুশ্চিন্তার ছাপ দূর করে দেবে এই টাকা।
কিন্তু সজীব নেই! যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে জায়গাটা ফাঁকা।

 
Electronic Paper