করোনা আবহে ডেঙ্গু
শেখ আনোয়ার
🕐 ৯:১৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৫, ২০২০
এখন করোনাকাল। এর মধ্যেই চলছে ঋতু বর্ষাকাল। এরপর আসছে ঋতু শীতকাল। বর্ষাকাল ও শীতকালের শুরুতে প্রকোপ বেড়ে যায় মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর। তাই বলা যায়, করোনার পাশাপাশি ক’দিন বাদে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে ডেঙ্গু। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে একজন বয়স্ক লোক করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন। খবরে প্রকাশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা বর্তমানে করোনা এবং ডেঙ্গু উভয় ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।
দেখা যায়, করোনা আবহে ডেঙ্গু মশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে যাচ্ছে। করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনিতে এই করোনাকালে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহারের পাশাপাশি মাস্ক পরেও নিস্তার নেই। একটু শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে কপালে। করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর জন্য আমাদের এখনই সাবধান ও সচেতন হতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে মশাকে বর্ষার আতঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, মশাবাহিত রোগে প্রতিদিন বিশ্বে তিন হাজার লোক মারা যায়। বছরে মারা যায় দশ লাখ লোকের বেশি। রিপোর্ট অনুযায়ী ডেঙ্গুই মশাবাহিত রোগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এছাড়া মশাবাহিত জীবাণু দ্বারা প্রচ- জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, কাঁপুনি, পেশী সংকোচন ও বমি ইত্যাদি হয়ে থাকে। বর্ষাকালেই এসব রোগের প্রকোপ দেখা দেয় অধিক। জ্বর, কাঁপুনি বা মাথা ব্যথার সঙ্গে বমি হলে বাসায় চিকিৎসা না করে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে স্থানান্তর করা উত্তম বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
অ্যানোফেলিস থেকে ম্যালেরিয়া এবং এডিস মশার দংশনে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে। ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশাসহ অন্যান্য মশা ডোবা-নালা, জঞ্জাল ও বদ্ধ জলাশয় ইত্যাদিতে জন্মায়। কিন্তু নালা-নর্দমা এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র নয়। এই মশার প্রজনন ক্ষেত্র হলো ফুলের টব এবং ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে বাড়ির আশপাশে ও এখানে-সেখানে পড়ে থাকা টিনের কৌটা প্রভৃতি। বৃষ্টির পানি এসব টবে ও পরিত্যক্ত পাত্রে জমা হলে এডিস মশা জন্ম নেয়। পার্বত্য তিন জেলায় এক ধরনের অতি ক্ষুদ্রাকার মশা রয়েছে। খালি চোখে এসব মশা দেখা অতি কষ্টকর ব্যাপার। এই মশা এতটাই ভয়ঙ্কর যে, এর দংশনে প্রচ- কম্প দিয়ে জ্বর ওঠে। সহসা জ্বর ছাড়তে চায় না। ক্রমান্বয়ে মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলে।
পাহাড়ি জেলাগুলোর জনগণের সঙ্গে আলাপ করলে বোঝা যায়, এই মশা এবং মশাবাহিত জ্বরের ব্যাপারে তারা যত আতঙ্কগ্রস্ত, অন্য কোনো অসুখ-বিসুখের ব্যাপারে তা নয়। এশিয়া আফ্রিকার বহু দেশে এমন সব মশা রয়েছে যার ব্যাপারে জনগণ রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে জানা যায়। মনে হতে পারে যে, মশার মধ্যে জীবাণু রয়েছে। যেমন বিষধর সাপে রয়েছে বিষ। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কিন্তু তা নয়। মশার নিজের মধ্যে কোনো জীবাণু নেই। এটা বাহক মাত্র। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দেহে দংশন করে জীবাণু সংগ্রহ করে এবং তা অন্যের দেহে ছড়ায়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মশাবাহিত রোগ নিরাময়ে সক্ষম হলেও প্রাণঘাতী ডেঙ্গু নিরাময়ে অক্ষম। ডেঙ্গুতে তরুণ-বৃদ্ধ বিশেষ করে শিশুর মৃত্যু এর প্রমাণ। আমাদের দেশেও প্রতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেকের মৃত্যু ঘটে। কোনো শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার যন্ত্রণা দেখে পিতা-মাতা কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কারো তা উপলব্ধি করার উপায় নেই।
কেন হয় ডেঙ্গু : ডেঙ্গু জ্বর একটা ভাইরাসজনিত রোগ। ভাইরাসের নাম গ্রুপ ‘বি’ আরবো ভাইরাস। এই ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। আরবো ভাইরাস বহনকারী মশার নাম এডিস মশা। এই মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। এই ভাইরাস বহনকারী স্ত্রী জাতীয় এডিস মশা যখন কোন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায় তখন তার দেহে এই ভাইরাস প্রবেশ করে এবং ওই ব্যক্তি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। সাধারণত মশা কামড়ানোর ৫ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানোর ৮ থেকে ১২ দিন পর এডিস মশা এই রোগ ছড়াতে পারে এবং এই মশা তার জীবনকালের বাকি সময়ের জন্যও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
ডেঙ্গু হয়েছে বুঝবেন কীভাবে : বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথমে প্রচ- মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, গিরায় ব্যথা, মাংসে ব্যথা- এক কথায় সমস্ত শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। হাড় ভেঙে গেলে নড়াচড়ায় যেমন প্রচ- ব্যথা হয় তেমনি ব্যথা হয় এই ডেঙ্গু জ্বরে। এজন্য ডেঙ্গু জ্বরকে হাড় ভাঙা জ্বর বা ‘ব্রেকবোন’ জ্বর বলে। তিন-চারদিন পর জ্বর কমে যায় এবং এরপর পুনরায় ১২ ঘণ্টা থেকে ৩ দিনের মধ্যে রোগী জ্বরে ও ব্যথায় আক্রান্ত হয়। এ সময়ে শরীরে লালচে আভা ও ফুসকুড়ি বা ‘র্যাশ’ দেখা যায়। চোখও লালচে হয়ে যায়। কখনও কখনও শরীরের অভ্যন্তরে অত্যধিক রক্তক্ষরণ হয় এবং রোগীর অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ অবস্থাকে ‘ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার’ বলে। তখন ব্লাড প্রেসার অনেক কমে যায়।
রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় শ্বেতকণিকা অনেক কমে গেছে। রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেটও অনেক কমে যায়। সাধারণ টিসি, ডিসি পরীক্ষায় এগুলো বোঝা যায়। প্লাটিলেট দেখার সর্বোত্তম পন্থা হল প্রথমে ‘সেল কাউন্টিং মেশিনে’ এবং পরে মাইক্রোস্কোপে দেখার ফলাফল তুলনা করা। রক্তে এই ভাইরাস শনাক্ত করার জন্য ‘ইমিউনোলজিক্যাল’ পরীক্ষা করা যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। অনেক রোগী না বুঝে ব্যয়বহুল ইমিউনোলজিক্যাল পরীক্ষা নিজেরাই করেন। যা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া করা উচিত নয়।
সাবধান! ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। এ রোগের জন্য চিকিৎসকরা প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকেন। ওষুধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। কারণ ডেঙ্গু জ্বরে কিছু কিছু ওষুধ মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করতে পারে। ডেঙ্গু হেরোরেজিক ফিভারে প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন অথবা ব্লাড ট্রান্সফিউশন দেওয়া হয়। তাই নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ সবসময়ই উত্তম। ডেঙ্গু প্রতিরোধ চেতনা সবসময়ই বাঞ্ছিত। তবে বর্ষাকালে বেশি সাবধান থাকা প্রয়োজন বলেই হয়তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে মশাকে ‘বর্ষার আতঙ্ক’ বলা হয়েছে। মশার বিস্তার রোধ করার জন্য বেশিরভাগ সময় সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে তাগাদা দেওয়া হয়ে থাকে।
ব্যর্থতা ও সাফল্যের জন্য নিন্দা এবং প্রশংসাবাক্য উচ্চারিত হয়। এর যৌক্তিকতা রয়েছে। সিটি করপোরেশনগুলোর চার-পাঁচটি প্রধান দায়িত্বের মধ্যে মশার বংশ বিস্তার রোধ অন্যতম। তারপরও কথা থাকে। তা হল, সিটি করপোরেশনের মশক নিধন অভিযান কারো ফুলের টব বা বাড়ির পাশে ফেলে রাখা ভাঙা হাঁড়ি-পাতিল ও টিনের কৌটায় জমা পানি পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না। এসব নাগরিক স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সাবধানতার ব্যাপার। বর্ষা মৌসুমে তো বটেই। সারা বছরই এই সচেতনতা প্রয়োজন।
প্রবাদে রয়েছে, ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। স্বাস্থ্যহীন বা নিত্য অসুস্থ লোক বিত্তশালী হলেও জীবন উপভোগ করতে পারে না। তাই বিশেষ করে বর্ষাকালে বারান্দায় ও ছাদে সংরক্ষিত ফুলের টবে যাতে পানি না জমে এবং ভাঙা কৌটায় পানি জমতে না পারে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে নিজস্ব দায়িত্ব অবশ্যই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে। নাগরিকদেরও নিজস্ব সচেতনতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। প্রচার মাধ্যমগুলো নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রাখতে পারে। বর্তমানে দেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলসহ নানামুখী প্রচার মাধ্যমের আকাল নেই। এসব মাধ্যমে দিনে অন্তত কয়েক মিনিট প্রচার এবং খবরের কাগজ রেডিওতে নিয়মিতভাবে প্রচার করা হলে সচেতনতা বাড়তে বাধ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কথিত ‘বর্ষার আতঙ্ক’ ডেঙ্গু এই করোনাকালে সত্যি সত্যি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি না করুক, এটাই কাম্য।
করোনার ওষুধ নেই। এ ক্ষেত্রে পার্সোনাল হাইজিন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহারের পাশাপাশি মাস্ক পরতে হয়। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু জ্বরেরও কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক নেই। বাহক মশা নিধনের মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার রোধ করতে হয়। তাই বাড়ির আশপাশে পানি জমতে দেওয়া যাবে না এবং চারিদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আগেই বলা হয়েছে এই মশা সাধারণত বাসগৃহে বা তার আশপাশে রক্ষিত টবে, পরিত্যক্ত বাসন-কোসন, কৌটা জমা-পানি ইত্যাদিতে ডিম পাড়ে।
এসব জায়গা পরিষ্কার রাখতে হবে এবং কীটনাশক ব্লিচিং পাউডার অথবা অ্যান্টি-লার্ভাল স্প্রে ছিটাতে হবে। শহরের নিচু তলার বাসিন্দাদেরই মশার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই ফুল সিøভ জামা-কাপড় পরার অভ্যাস করা, মশারি টানিয়ে ঘুমানো, সন্ধ্যার পর জানালা বন্ধ করে রাখা একটা প্রতিকার হতে পারে। আর হ্যাঁ। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই মশারির মধ্যে রাখতে হবে। কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি।
শেখ আনোয়ার : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়