ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মৃত্যুতেও অমলিন এন্ড্রু কিশোর

সাইফুজ্জামান
🕐 ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১২, ২০২০

চারপাশে মৃত্যুর করতালি, যেন থেমে যেতে চায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। কালব্যাধি সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অঙ্গনের কৃতি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এসব মৃত্যুর খবর উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকের মতো টিভি দেখা ছেড়ে দিয়েছি। প্রিন্টেড পত্রিকার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সক্রিয় হয়ে পড়েছে। তাই দুঃসংবাদ থেকে দূরে থাকা অসম্ভব। করোনাভাইরাস পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অস্বাবাভিক মৃত্যু।

অল্প সময়ের মধ্যে আমরা অসংখ্য প্রিয় মানুষকে হারিয়েছি। মৃত্যু এক অমোঘ নিয়তি। তার আহ্বান অস্বীকার করার সাধ্য কারো নেই। মৃত্যু নিয়ে অনেক মনীষী অনেক কথা বলেছেন। ধর্মগ্রন্থে রয়েছে বহু বক্তব্য। সুরা আল ইমরানের ১৩৮ আয়াতে উল্লেখ রয়েছে ‘কুল্লু নাফসিন জাইকাতিল মওত (জীবন মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে)। ডব্লিউ বি ইয়েটস বলেছেন, প্রতিটি মৃত্যু আমাদের সংকুচিত করে। আর আমি মানবজাতির অংশ।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন মৃত্যু যে এড়িয়ে চলে, মৃত্যু তারে টানে। মৃত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারা জানে। ইংরেজি প্রবচন আছে মৃত্যু সবাইকে তার হিম শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। মৃত্যু এক পরম সত্য। এ সত্য নিয়ে মানুষকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হয়। কারো জানা নেই কখন তার প্রস্থানের ঘণ্টা বাজে!। অসুখে ভুগে, না ভুগে কিংবা হার্ট অ্যাটাকে অথবা সড়ক দুর্ঘটনায়, এমনকি ঘুমের মধ্যে কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। পৃথিবীময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে জীবনকে দীর্ঘায়িত করার জন্য। রোবট তৈরি হয়েছে তারা মানুষের মতো কাজ করছে। জীবন আছে বলে আহার, নিদ্রা, জীবনকে সচল রাখার আয়োজন সম্পন্ন হচ্ছে । প্রতিনিয়ত চাহিদা জন্ম নিচ্ছে। সৌন্দর্য দেখা, জীবন উপভোগ করা মিথ্যে করে মানুষ একসময় চলে যায়।

সঙ্গীতাঙ্গনের প্রিয় মুখ এন্ড্রু কিশোরও চলে গেলেন। আপন মানুষ তিনি হয়ে উঠেছিলেন আশির দশকে। রেডিও যখন প্রিয় সঙ্গী, সিনেমা দলবেঁধে দেখি তার গান শুনে হৃদয়ের ভেতর তোলপাড় করে। তার আকস্মিক চলে যাওয়ার সংবাদে চোখের কোণে জমে যায় অশ্রুবিন্দু। কিংবদন্তি এই শিল্পীর চলে যাওয়া বড় শূন্যতার ও বেদনার। প্রেম, বিরহ, লোক ও আধ্যাত্মিক গানে একাত্ম হয়ে যেতেন। কোনো গ্রুপ, দলবাজিতে ছিলেন না। সত্য উচ্চারণে অটল এমন মানুষ কম জন্ম নেয়। তিনি বলতেন গানই তার ধ্যান। প্রায় ১৫ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন।

এন্ড্রু কিশোরের কন্ঠে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচিত ‘ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’ আসাধারণ গীতিময় হয়ে উঠেছিল। আজীবন হৃদয়ে বাউল ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, তোরা দ্যাখ চাহিয়া, আমি চক্ষু দিয়া দেখতেছিলাম জগত রঙিলা, কারে বলে ভালোবাসা কারে বলে প্রেম, চাঁদের সাথে দেব না তোমার তুলনা প্রভৃতি গান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কোনো কোনো মানুষ নিজ অধ্যবসায় দিয়ে অনেক উচ্চতায় পৌঁছে যায় যেখানে অন্যরা যেতে পারে না। তারকা খ্যাতিতে পৌঁছেও বিনয় থাকে। এটা তাদের ভূষণ। এক সাগর তৃষ্ণা নিয়ে তারা পথ চলেন, সৃষ্টির উন্মাদনায় বিভোর থাকেন। তেমন একজন এন্ড্রু কিশোর। তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন শিল্পী নিজস্ব গায়কী শৈলীতে দর্শক শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করেছিলেন। কী সিনেমায়, কী স্টেজ প্রোগ্রামে তার পারফরমেন্স ছিল অসাধারণ। পুরো নাম এন্ড্রু কিশোর বাড়ৈ। জন্ম ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর, রাজশাহী।

উইকিপিডিয়ার সূত্র থেকে জানা যায়, ছয় বছর বয়স থেকে তিনি গানের ধ্রুপদী শাখার সঙ্গে পরিচিত হন। পিতা ক্ষিতিশ চন্দ্র বাড়ৈ, চিকিৎসক। মা মিনু বাড়ৈ। মা ছিলেন গান অন্তঃপ্রাণ। রাজশাহীর বুলনপুর মিশন গার্লস শিক্ষিকা। মায়ের কাছে সঙ্গীতের এন্ড্রুর গান শেখা শুরু। আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে প্রথাগত গান শেখা। স্বাধীনতার পর রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হয়ে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন।

এক সময় ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে মেইল ট্রেন সিনেমায় অচিনপুরের রাজকুমারী গান পরিবেশনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে তার আবির্ভাব ঘটে। তারপর তাকে থেমে থাকতে হয়নি। বাদল রহমানের এমিলির গোয়েন্দা বাহিনীর ধুমধাড়াক্কা গান, ১৯৭৯ সালে এজে মিন্টুর প্রতিঞ্জা চলচ্চিত্রে এক চোর যায় চলে গানে তিনি খ্যাতির চূড়া স্পর্শ করেন। তার পরিবেশিত জনপ্রিয় গান হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস। এই গানের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।

তিনি সারেন্ডার (১৯৮৭), ক্ষতিপূরণ (১৯৮৯) পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১) কবুল (১৯৯৬), আজ গায়ে হলুদ (২০০০), সাজঘর (২০০৭), কি যাদু করিলা চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ১৯৮৪, ১৯৮৭, ২০০১, ২০০৮, ২০১০ সালে বাচসাস পুরস্কার ও ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারপ্রাপ্ত এন্ড্রু কিশোর বিশেষ একটি ঘরানার জাদুকরী গায়কী আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সমান উচ্চতার গায়ক খুব একটা দেখা যায় না।

তিনি পেয়েছিলেন প্লেব্যাক সম্রাট উপাধি। জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস, ডাক দিয়েছে দয়াল আমারে, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্য খানে, আমার বাবার মুখে যেদিন, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, সবাই তো ভালোবাসা চায় তার গীত সঙ্গীত আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ১৯৭৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। সব গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

নন হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এন্ড্রু কিশোর। তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয় দীর্ঘদিন। ২০২০ সালের ১১ জুন দেশে ফিরে এসে বোনের বাসায় ওঠেন। তার বোন ও বোনজামাই দুই জনই ডাক্তার। তাকে বাসায় ও হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয় । নিবিড় তত্ত্বাবধানে থেকেও তার আরোগ্য লাভ হয়নি। ২০২০ সালের ৬ জুলাই এন্ড্রু কিশোর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।

এন্ড্রু কিশোর ছিলেন আত্মমগ্ন কণ্ঠশিল্পী। তিনি প্রচারমুখী ছিলেন না। নিজেকে অন্তরালবাসী শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তুলেছিলেন। সুরকার আলম খান ও অন্যদের সুরে অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। সৈয়দ শামসুল হক রচিত গান তার কন্ঠে জাদুময় ধরা দিয়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তার গায়কী শৈলীর ভক্ত হয়ে আছে। তার গানের মায়াবী মুগ্ধতা ঘিরে রাখবে অনেক দিন আমাদের। এন্ড্রু কিশোর ক্ষণজন্মা এক শিল্পীর প্রতিকৃতি। ক্ল্যাসিক ধারার বিশেষ ঘরানা রপ্ত করে তিনি নিজেকে পরিব্যাপ্ত করেছিলেন সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায়। সহশিল্পীসহ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সম্ভাবনা দেখলে তিনি উৎসাহিত করতেন। দশজন শিল্পী থেকে তিনি ছিলেন আলাদা। কী কণ্ঠ মাধুর্যে, কী ব্যবহারে। বাংলাদেশ একজন বড় মাপের শিল্পীকে হারাল। এ শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তিনি সঙ্গীতে, স্মরণে বেঁচে থাকবেন।

 

সাইফুজ্জামান : প্রাবন্ধিক, কবি; উপকীপার

জাতীয় জাদুঘর

[email protected]

 
Electronic Paper