ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এবিএম হোসেন : একজন মনীষীর নীরব প্রস্থান

আরাফাত শাহীন
🕐 ৬:০১ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১২, ২০২০

অতি চুপিসারে জীবনের শেষ দিনগুলো যাপন করে চিরবিদায় নিলেন প্রিয় শিক্ষক এবিএম হোসেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ইমিরেটাস প্রফেসর। ২০০১ সালে তিনি সম্মানজনক এ পদে নিয়োগ পান। তার মৃত্যুতে আমাদের সকলের হৃদয়ে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

এবিএম হোসেন। পুরো নাম আবুল বাশার মোশারফ হোসেন। ১৯৩৪ সালে কুমিল্লায় জন্ম নেওয়া মানুষটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে এমএ এবং ১৯৬০ সালে ইতিহাস ও ইসলামি শিল্পকলায় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ সালেই যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

প্রফেসর হোসেনের সঙ্গে আমার সরাসরি কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। মূলত তাকে চিনেছি তার লেখা বইপত্র পড়ে এবং আমার সম্মানিত শিক্ষকগণের কাছ থেকে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রফেসর ইমিরেটাস হওয়ার পরও তেমনিভাবে প্রচার-প্রচারণা পাননি; চিরকাল থেকে গেলেন প্রদীপের আড়ালেই। এ এক ভারি আশ্চর্যের ঘটনা বৈকি।

২০২০ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে তৃতীয় দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে হোসেন স্যারের উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল। সত্যি সত্যি আমি খুব আশা করেছিলাম, এবার স্যারকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাব; তার মুখ থেকে দুটো কথা শুনতে পাব। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগে স্যার ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী হলেন; আমাদের আশাভঙ্গ হল। তবে তিনি উপস্থিত হতে না পারলেও প্রিয় বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেন সব সময়। তিনি সবার উদ্দেশ্যে কিছু কথা লিখে পাঠালেন। কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে তার লেখা পাঠ করে শোনানো হল। আমরা আবেগে আপ্লুত হলাম।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষের দুটো অত্যাবশ্যকীয় কোর্স হল মুসলিম স্থাপত্য এবং চিত্রকলা। এই দুটো কোর্স পড়তে গেলে স্যারের লেখা ‘আরব স্থাপত্য’ ও ‘ইসলামি চিত্রকলা’ পড়ার কোনো বিকল্প নেই। আবার যদি আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হয় বাংলা ভাষায়, তাহলে হোসেন স্যারের ‘মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস : অটোমান সাম্রাজ্য থেকে জাতিসত্তা রাষ্ট্র’ বইটি পড়ার কোনো বিকল্প দেখি না। শেষোক্ত বইটির নামে আমরা একটা সাহিত্যিক শিল্পবোধ দেখতে পাই। নামটি ঠিক করতে স্যারকে সহায়তা করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক। সাধারণত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজস্ব কোর্সের ব্যাপারে ছাত্ররা কম গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

শুনতে একটু তেতো হলেও এটাই বাস্তব সত্য। স্থাপত্য এবং চিত্রকলার প্রতি আমার আগ্রহ খুব বেশি পরিমাণ না হলেও মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের প্রতি আমার ঝোঁক অনেক আগে থেকেই। আমি পত্রিকার পাতা থেকে প্রতিদিন মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদগুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করে থাকি। তাছাড়া আরব বিশ্ব নিয়ে লিখিত বইগুলোও কম ঘাঁটাঘাঁটি করি না।

যখন জানতে পারলাম আধুনিক আরব বিশ্ব নিয়ে আমার বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক এবিএম হোসেন স্যার একটা বই লিখেছেন তখন সেটা কোথায় পাওয়া যাবে পাগলের মতো খুঁজতে থাকি। আমাদের সেমিনার লাইব্রেরিতে বইটা আছে বটে তবে সেখান থেকে নিয়ে তো আর নিজের কাছে রাখা যাবে না! বাজারের বইয়ের দোকানগুলো তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলাম, বইটা পাওয়ার উপায় নেই। তখন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে গেলাম এবং বইটা ফটোকপি করে নিজের কাছে নিয়ে এলাম। এই সুখটা সত্যিই আমার কাছে অন্যরকম ছিল।

`মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস : অটোমান সাম্রাজ্য থেকে জাতিসত্তা রাষ্ট্র’ বইটা পড়তে গিয়ে আমার চোখের সামনে যেন একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেল। উপলব্ধি করতে পারলাম লেখকের জানাশোনার গভীরতা এবং গবেষণার সক্ষমতা। একটা বই লিখতে গিয়ে তিনি বিশ্বের নানা প্রান্তের, নানা ভাষার বহু লেখকের বই ঘেঁটেছেন; তারপর সেখান থেকে সমুদ্র সেঁচে মুক্তো তুলে আনার মতো করে প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে এনেছেন। বইটার প্রতিটা পাতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ‘আরব স্থাপত্য’ বইটাও পড়ে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। এই বিষয়ে বাংলাদেশে এবিএম হোসেন ছাড়া আর কেউ কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন বলে জানা নেই। এই বিষয়ে গবেষণা করতে আগ্রহীদের কাছে বইটা মূল্যবান সোর্স হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

আরাফাত শাহীন : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

 
Electronic Paper