জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জনসমস্যা সৃষ্টি
লিটন দাশ গুপ্ত
🕐 ৮:২১ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১১, ২০২০
১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা পাঁচশ কোটি পূর্ণ হওয়ার দিনটিকে, জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের ঘোষণা করা হয়। সেই অনুযায়ী পরবর্তী ১৯৮৯ সালের ১১ জুলাই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়। তখন থেকে প্রতিবছর প্রতিটি দেশ এই দিনটি যথাযথ মর্যাদায় ও আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে আসছে।
তবে এই বছর করোনার প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে বা আড়ম্বরপূর্ণ পালন করা না গেলেও এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সর্বসাধারণের মাঝে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর এই সম্পর্কিত বিভিন্ন সচেতনতাবিষয়ক বার্তা সকলের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। কারণ আমাদের দেশে যে ধরনের সমস্যা রয়েছে তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অধিক জনসংখ্যাই দায়ী।
পৃথিবীর মোট আয়তনকে, বাংলাদেশের আয়তন দিয়ে ভাগ করে দেখলাম; ভূমির পরিমাণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড হচ্ছে পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভাগের এক ভাগ, যা আয়তনের দিক দিয়ে পৃথিবীর চুরানব্বইতম বৃহত্তম রাষ্ট্র। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে আরো ৯৩টি বড় দেশ রয়েছে। অথচ জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যেখানে লোকসংখ্যার ঘনত্ব ১১১৬ জন, বর্গকিলোমিটারে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ১৯০১ সালে মোট জনসংখ্যা ছিল আড়াই কোটির মতো। আর বর্তমান ২০২০ সালে মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটির কাছাকাছি।
এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৩ শতাংশ হিসাবে প্রতিবছর আরো প্রায় ২৫ লক্ষ করে মানুষ যুক্ত হচ্ছে মোট জনসংখ্যায়। এখন বিপুল এই জনসংখ্যা দেশের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ! কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বা অবনতি অনেক সময় নির্ভর করে সেই দেশের মোট জনসংখ্যার ওপর। অধিক জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলে তখন আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। আবার অনভিপ্রেত জনসংখ্যার আধিক্য উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি হয়। তখন আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। তবে এটাও ঠিক, জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলেও মোট জনসংখ্যাকে একটি সুনির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ করে রাখতে না পারলে বহুমুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়।
যেমন অধিক জনসংখ্যার কারণে সৃষ্টি হয় অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা সংকট। অতঃপর বেড়ে যায় ঘুষ দুর্নীতি চুরি ডাকাতি প্রতারণা ছিনতাই সন্ত্রাস ইত্যাদি, কিংবা সৃষ্টি হয় অন্যায় অনিয়ম অবক্ষয় অবিচার বিশৃঙ্খলা হানাহানি খুনাখুনি। শুধু কি তাই? বেকার সমস্যা সামাজিক সমস্যা, দারিদ্র্য রাজনৈতিক অস্থিরতা যানজট সড়ক দুর্ঘটনা মহামারি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশদূষণ জলবায়ু পরিবর্তন জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ আরো কত কী সমস্যা! এই জন্য বলছি জনসংখ্যা জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলেও অধিক জনসংখ্যা বহুমুখী সমস্যার কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় প্রভাব, ভৌগোলিক পরিবেশ, সুশিক্ষার অভাব, কিংবা বাল্যবিবাহ বহুবিবাহ অজ্ঞতা মূর্খতা ইত্যাদি বিষয়।
এই প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ গত কয়েক বছর আগের কিছু কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সৃষ্ট ‘ভিটে আছে বাড়ি নেই’ প্রকল্পের আওতায়, উপজেলাভিত্তিক সুবিধাভোগী পরিবার বাছাই কমিটিতে আমি অন্যতম সদস্য ছিলাম। সেই হিসাবে আমি, গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ যাদের ভিটে আছে কিন্তু বাড়ি নেই এমন পরিবার সরেজমিনে নির্বাচন করতে গিয়েছি। দেখেছি খেটেখাওয়া তথা সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যে কত যে ব্যাপক জন্মহার ও জনসংখ্যাজনিত সমস্যা! আর তা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে, বাস্তব মুখোমুখি না হলে অনুধাবন করতে পারতাম না। অনুভব করতে পারতাম না দেশে জনসংখ্যা সমস্যা সত্যিই এক নম্বর সমস্যা!
শহরের বস্তি এলাকায় নয় কিংবা যাযাবর সম্প্রদায় নয়; কিন্তু গ্রাম এলাকায়, বিশেষ করে খেটে খাওয়া সমাজের নিম্নস্তর মানুষের একাংশ দেখেছি, পলিথিন ছেঁড়া কাপড় ছালার চট বেড়া ইত্যাদি দিয়ে ঝুপড়ি ঘর বেঁধে বসবাস করছে। অধিক জনসংখ্যার কারণে পারিবারিকভাবে বণ্টনকৃত জমিজমা ভিটেবাড়ির প্রাপ্ত সীমিত জায়গায় ঘর বেঁধে, একটি ঘরে ১০-১২ জনের বসবাস। এখানে শুধু ‘ভিটে আছে বাড়ি নাই’ তাই নয়, অভাবেরও অভাব নাই! স্বভাবেরও প্রান্ত নাই, সমস্যারও অন্ত নাই। গিয়েছিলাম হতদরিদ্র পরিবার নির্বাচন করতে, সেখানে এরা দারিদ্র্য দেখিয়ে বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার কথা বলছে ঠিক আছে, কিন্তু দুনিয়ার যত সব অভাব অভিযোগ সমস্যার কথা বলে আমাদের কাছে বিচার সালিশ দাবি নিয়ে আসছিল।
এই হচ্ছে দেশীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে একাংশের সমস্যা, যা প্রত্যক্ষভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৭৬০ কোটির বেশি। অনেক পরিবেশবিদ জনসংখ্যাবিশেষজ্ঞ মনে করেন, পৃথিবীতে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা ২৫০ কোটি থেকে ৩০০ কোটি মানুষের বসবাস উপযোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মতে পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৪ জনের বেশি শিশু জন্মগ্রহণ করছে। সেই হিসাবে অনেক রাষ্ট্রে, প্রতি সেকেন্ডে ১০ বা ১৫ জনের অধিক শিশু জন্মগ্রহণ করছে। তাই দেখা যায় কোনো কোনো দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়ে বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
আর কোনো রাষ্ট্রে আয়তনের তুলনায় কম জনসংখ্যা। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল বা ‘ইউএনএফপিএ’ কর্তৃক প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে জানা যায় ১৮০৪ সালে পৃথিবীর মোট লোকসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি, এরপর ১৯২৭ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ কোটি; আর ৩২ বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে লোক সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০ কোটি, এর মাত্র ১৫ বছর পর ১৯৭৪ সালে ৪০০ কোটি। অতঃপর ১৩ বছর পর ১৯৮৭ সালে পৃথিবীর মোট লোকসংখ্যা হয় ৫০০ কোটি; এরপর ১৯৯৯ সালে ৬০০ কোটি এবং ২০১১ সালে ৭০০ কোটি পূর্ণ হয় পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা।
গত কয়েক দশক ধরে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি সীমিতকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যার প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশও অনেকাংশ সফল হয়েছে। তবে গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, হ্রাসকরণের যে সরকারি বেসরকারি সংস্থার তৎপরতা ছিল, তা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কমে আসছে মনে হচ্ছিল। এখন কথা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে, দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান রয়েছে। যা এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। এই গতিতে ত্বরণ সৃষ্টি করতে এবং জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে, সার্বিকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধকরণের বিকল্প নেই।
লিটন দাশ গুপ্ত : শিক্ষক ও কলাম লেখক