ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভুয়া পরিচয়েই সমাজের উঁচুতলায়, সিংহদাপট

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৮:৪৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ০৯, ২০২০

করোনা মহামারির সময় হাজারো মানুষের কাছ থেকে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতারক মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন না থাকলেও নিজেকে কখনও সেনাবাহিনীর বড় কর্মকর্তা কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দিতেন।

মাঝে মধ্যে নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের উপ-কমিটির সদস্য বলেও পরিচয় দিতেন। ভুয়া পরিচয়ে বিচরণ করতেন সমাজের উঁচুতলায়, সিংহের মতো দাপট নিয়ে চলাফেরা করতেন। এই ধরনের পরিচয় ও দাপটের আড়ালে অবৈধভাবে মানুষের শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই প্রতারক। প্রতারণার অভিযোগে জেলে গেলেও নিজেকে শোধরাননি।

জীবনে কলেজের গণ্ডি (এসএসসি পাস) পেরোতে না পারলেও টাকা কামানোর ধান্দা ঠিক মতোই রপ্ত করেছিলেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ। তার প্রতারণার ফাঁদ এতই সূক্ষ্ম ছিল যে সাধারণ মানুষকে ঠকানোর ব্যবসা করে রাতারাতিই কোটিপতি বনে যান। তাছাড়া বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে টাকা দিয়ে অতিথি হিসেবে এসে সরকারের গুণগান করে দলের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।

মো. সাহেদ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকলেও তার আসল নাম মো. সাহেদ করিম, পিতা সিরাজুল করিম। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার ঠিকানা হরনাথ ঘোষ রোড, লালবাগ, ঢাকা-১২১১। গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। ১/১১ সরকারের সময় প্রতারণার অভিযোগে তিনি দুই বছর জেলে ছিলেন বলে ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। জেল থেকে বেরিয়ে আবারো ধানমন্ডির ১৫নং রোডে এমএলএম কোম্পানি বিডিএস ক্লিক ওয়ান খুলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।

আর সে সময় তিনি মেজর ইফতেখার করিম চৌধুরী বলে পরিচয় দিতেন। তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় ২টি মামলা, বরিশালে ১ মামলা, বিডিএস কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরির নামে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারণার কারণে উত্তরা থানায় ৮টি মামলাসহ রাজধানীতে ৩২টি মামলা রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে।

এছাড়াও প্রতারণার টাকায় তিনি উত্তরা পশ্চিম থানার পাশে গড়ে তুলেছেন রিজেন্ট কলেজ ও ইউনিভার্সিটি, আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটি। এর একটিরও কোনো লাইসেন্স নেই বলে অভিযোগ আছে। আর অনুমোদনহীন আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটির ১২টি শাখা করে হাজার হাজার সদস্যের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, প্রতারক সাহেদ রাষ্ট্রীয় বড় বড় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি ও সেলফি তুলে সেগুলো অফিসে টানিয়ে মানুষের কাছে নিজকে একজন বড় মাপের মানুষ বলে দাবি করতেন। আর সাধারণ মানুষ যখন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ছবিগুলো দেখত তখন তারা প্রতারিত হয়েও তার বিরুদ্ধাচরণ করতেও ভয় পেত।

তার প্রতারণার জাল এতই বিস্তৃত ছিল যে, সর্বশেষ দেশে করোনার মহামারির সময়ে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের জন্য তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল রিজেন্টের লাইসেন্স না থাকার পরও সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন ভাগিয়ে নেয়।

ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট তৈরিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত রিজেন্ট হাসপাতালকে সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে সিলগালা করে  দেওয়ার পর বের হয়ে আসছে সাহেদের একের পর এক রোমহর্ষক দুর্নীতি। বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগ এলেও তোয়াক্কা করেনি প্রশাসন। হাসপাতালটির চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই এখন। করোনার মতো গুরুত্ব¡পূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব কীভাবে বাগিয়ে নিলেন- এমন প্রশ্ন মানুষের মনে।

অভিযানের পর প্রতারক সাহেদ কীভাবে লাপাত্তা হলো সেটিও ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে প্রতিদিনই সম্ভাব্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে আসছে। তাছাড়া সে যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে তা সেই বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা এবং বাড়িতে থাকা রোগীদের করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করত হাসপাতালটি। এছাড়া সরকার থেকে বিনামূল্যে করোনা টেস্ট করার অনুমতি নিয়ে রিপোর্ট প্রতি সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা করে আদায় করত। এভাবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে মোট তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই সমস্ত অপরাধ ও টাকার নিয়ন্ত্রণ সাহেদ নিজে করতেন অফিসে বসে এমন তথ্য জানা গেছে। রিজেন্টের প্রধান কার্যালয় থেকেই এই অপকর্মগুলো হতো বিধায় এটি সিলগালা করা হয়েছে।

র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে গ্রেফতারের জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া দেশ ছেড়ে পালানোরও তার কোনো সুযোগ নেই। আশা করছি দ্রুতই তাকে গ্রেফতার করে আইনের কাছে সোপর্দ করতে পারব। তাছাড়া তার সহযোগী যারা পলাতক রয়েছেন তাদের গ্রেফতারে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

৫০ শয্যার রিজেন্ট হাসপাতালটিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর অনুমোদন দিয়েছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। পরে ২০১৭ সালে মিরপুরেও হাসপাতালটির আরেকটি শাখা খুলে তারও অনুমোদন নিয়েছিল। যদিও এসব হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ একবার উত্তীর্ণ হওয়ার পর আর নবায়ন করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় দণ্ড বিধি ৪০৬/৪১৭/৪৬৫/৪৬৮/৪৭১/২৬৯ ধারায় ১৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। এতে সোমবার রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখা থেকে আটক আটজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদসহ ৯ জনকে পলাতক আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ সাহেদের সহযোগী তারেক শিবলীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

 
Electronic Paper