কটি নৌপথ ও সাড়ে চার লক্ষ মানুষের আর্তনাদ
জিসান মাহমুদ
🕐 ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১০, ২০২০
হাজার বছরের ঐতিহ্যঘেরা মেঘনা মোহনায় অবস্থিত প্রাচীন দ্বীপ সন্দ্বীপ। প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষের বসবাস এখানে। রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস। একটা সময় বিখ্যাত ছিল জাহাজ ও লবণ শিল্পের জন্য। সবচেয়ে সুন্দর ও মজবুত জাহাজ নির্মাণ হত এখানে। সেগুলো উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি হত। দ্বীপে জন্ম নিয়েছেন অনেক জ্ঞানী-গুণী, কবি-সাহিত্যিক। মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ জোগান দিচ্ছেন এই দ্বীপের মানুষ। এতকিছুর পরও এই দ্বীপের মানুষ অবহেলিত যোগাযোগ ব্যবস্থায়।
মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার একমাত্র নৌপথ যেন প্রাচীনযুগের মতো রয়ে গেছে। এ নৌপথের এখনো কোনো সুফল মেলেনি। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার ৭টি ফেরিঘাট থাকলেও সচল রয়েছে কুমিরা-গুপ্তছড়া ফেরিঘাট। ২০১২ সালে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দুপাশে দুটি জেটি নির্মাণ করলেও গুপ্তছড়া অংশে কোনো কাজে আসছে না এটি। যা নির্মাণ ত্রুটির কারণে ৬ মাসের মধ্যে ভেঙে পড়ে যায়। সাড়ে চার হাজার ফুট দীর্ঘ জেটিটি অবশিষ্ট আছে মাত্র দুই হাজার ফুট। অথচ এই জেটি ব্যবহার বাবদ প্রতিবছর বিআইডব্লিউটিএ-কে ৪০ লক্ষ টাকা টোল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
কুমিল্লা অংশে থাকা জেটিও ব্যবহার হচ্ছে কেবল জোয়ারের সময়। যার ফলে দুর্ভোগের শেষ থাকে না সন্দ্বীপের মানুষের। কোমর পরিমাণ পানিতে নেমে যেতে হয় যাত্রীদের। এরপর কাদা মাড়িয়ে পাড়ে উঠতে হয়। আবার নৌযানে ওঠার সময়ও একই অবস্থা। শুধু তাই নয়, স্টিমার কিংবা লঞ্চে উঠতে নামতে হলে অবৈধ লালবোট ব্যবহার করতে হয়। যার কারণে ২০১৭ সালে ২ এপ্রিল হারাতে হয়েছে ১৮টি তাজা প্রাণ। এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় দ্বীপের মানুষকে।
এই রুটে প্রতিদিন ৫ থেকে ৮ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে। অথচ, যাতায়াতের জন্য এখানে কোনো স্থায়ী নৌযান নেই। ফলে উত্তাল সমুদ্রে কখনো অবৈধ স্পিডবোট, কখনো লঞ্চ, আবার কখনো স্টিমারে যাতায়াত করতে হয়। এই নৌপথে অনিয়মের শেষ নেই। এখানে লাইফ জ্যাকেট থাকা সত্ত্বেও সবসময় যাত্রীদের দেওয়া হয় না, রাত্রিবেলায় নেই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, যার কারণে দিনের বেলা নৌযান সচল থাকলেও রাত্রিবেলায় অচল হয়ে পড়ে। স্টিমার কিংবা অন্য কোনো নৌযানে উঠার জন্য চলছে অবৈধ লালবোট, সেই লালবোটে চলে বকশিসের নামে চাঁদাবাজি।
দুই পাড়ে ১০ টাকা করে ২০ টাকা দিতে হয় তাদের। বকশিস আদায়কে কেন্দ্র করে প্রায়ই যাত্রী ও বোট কর্মচারীদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। নেই মানসম্মত টয়লেট, পর্যাপ্ত যাত্রী ছাউনীর অভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে হয় যাত্রীদের। যাত্রীর মালামাল নিয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম না থাকায় অতিরিক্ত টিকেট খরচ দিয়ে মালামাল আনা-নেওয়া করতে হয়। নারী পুরুষের আলাদা টিকিট কাউন্টার নেই বলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পুরাতন নৌযান হওয়ায় মাঝপথে বিভিন্ন সময় ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। শীতকালে যাত্রী পারাপার নিরাপদ হলেও বর্ষাকালে কঠিন অবস্থা দাঁড়ায়। স্পিডবোটে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, ঝুঁকি নিয়ে মালবাহী বোটে যাত্রী আনা নেওয়াসহ নানান অভিযোগ তো আছেই। ফলে একপ্রকার জিম্মি হয়ে ওই পথে আসা যাওয়া করতে হচ্ছে হাজার হাজার যাত্রীকে। এসব কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে নৌ দুর্ঘটনা। প্রতিবার দুর্ঘটনা শেষে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু দোষীদের বিচার হয় না।
২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২৫ লাখ টাকায় একটি সি-এ্যাম্বুলেন্স দিলেও চালক ও জ্বালানির অভাবে ৩ বছর পড়ে থাকে। বহুদিন অচল থাকার পর ২০১১ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে অস্থায়ীভাবে একজন চালক ও জ্বালানি তেলের ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় এক বছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায় এটি। এরপর আর চালু হয়নি। ২০১৫ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৬৫ লাখ টাকায় আরেকটি সি-এ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। আগেরটির মতো এটারও চালক ও জ্বালানি তেলের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
ফলে রোগীদের জন্য সি-এ্যাম্বুলেন্স থাকলেও একদিনের জন্যও সেটি ব্যবহার করা যায়নি। বর্তমানে এটি সড়কের পাশে খালে ফেলে রাখা হয়েছে শুধু প্রদর্শনীর জন্য। স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় এই উত্তাল সমুদ্রে এভাবে রোগীদের চট্টগ্রামে আনা-নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কুলিদের টাকা দিলে তারা বৃদ্ধ বা অসুস্থ লোকজনকে কাঁধে করে পৌঁছে দেয়। অনেক সময় ভোগান্তির কারণে যাত্রাপথে রোগী মারা যায়। যে লালবোট অন্যান্য জায়গায় জেলেদের মাছ ধরার জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে, সেটি সন্দ্বীপে জরুরি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়।
অন্যদিকে, ২০১২ সালে গুপ্তছড়া ঘাটে নির্মিত জেটিটি বিকল হয়ে যাওয়ায় তার পাশে বর্তমানে ৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন আরেকটি জেটির কাজ চলছে। প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ। কিন্তু অতিরিক্ত চর জাগার কারণে এ জেটিও সাধারণ মানুষের তেমন কাজে আসবে না। নতুন জেটির দৈর্ঘ্য প্রথমে ছিল দশমিক ৬ কিলোমিটার। প্রকল্প ছিল ৪৬ কোটি ৯২ লাখ টাকার। পরে তা দশমিক ১ কিলোমিটার বাড়িয়ে প্রকল্প আনে ৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকায়। আরো দশমিক ৫ কিলোমিটার বাড়াতে চাই বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু তারপরও সুফল মিলবে বলে মনে হয় না দ্বীপবাসীর। এর জন্য আগের জেটির মতো সাধারণ মানুষকে আবার টোল গুনতে হবে।
ওঠা-নামার কষ্ট লাঘবে এখন বিকল্প হিসেবে কাজ করছে কেওড়া কাঠের নির্মিত সেতু। দ্বীপের মানুষের শেষ ভরসা এই কাঠের সেতু। কিন্তু পিচ্ছিল হওয়ায় সেটা যেন আরো বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। জোয়ার থাকলে কাঠের সেতুতে চলাচল করা যায়, তাও শিশু বৃদ্ধাদের জন্য সেটা কষ্টকর। কিন্তু ভাটা থাকলে দেড় থেকে দুইশ’ গজ পথ কাদা মাড়িয়ে পাড়ে আসতে হয়। রোগীদের জন্য তো সেটা জীবন মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। সব দিক বিবেচনা করে সরকারের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্বীপবাসীর কষ্ট লাঘবে নৌ যাতায়াত নিরাপদ করা।
জিসান মাহমুদ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম