ব্যাংক ঋণ সীমা দ্বিগুণ করেও কুলাতে পারল না সরকার
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
🕐 ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৯, ২০২০
বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি হওয়ার কারণে ব্যাংক থেকে ঋণের সীমা পঁচাত্তর ভাগ বাড়িয়ে ৮২ হাজার কোটি টাকা পুনঃনির্ধারণ করে। বছর শেষে এ টাকাতে কুলাতে না পেরে অতিরিক্ত আরও ৩ হাজার কোটি ব্যাংক থেকে ধার করে সরকার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সব মিলে সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমান দাঁড়াল ৮৫ হাজার কোটি টাকা।
চলতি বছরের মাঝামাঝি থেকেই দেশের অর্থনীতিতে করোনা অতিমারির ঝাপটা লাগে। ডিসেম্বর চীনে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব লাগলে দেশেরর কাঁচামাল আমদানি কমা শুরু করে। এর প্রভাব উৎপাদন কমে যায়। প্রভাব পড়ে রপ্তানিতেও। আর মার্চের মাঝামাঝি থেকে করোনাভাইরাস দেশের মহামারিতে পুরোপুরি আঘাত দেয়। ২৬ মার্চ থেকে উৎপাদন, বিপণন, যোগাযোগ, আমদানি-রপ্তানি, কৃষি, ব্যাংকিং, রেমিট্যান্সসহ সব কিছু বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়ে। বছরের শেষে দুই মাস রাজস্বের বড় অংশ আদায় হয়। আর এ সময়েই করোনার কারণে সব কিছু থমকে থাকে। মানুষের জীবন বাঁচানোই প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি পড়ে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক ঋণ ৮২ হাজার কোটি টাকা থাকলেও এতে কুলিয়ে উঠতে পারে না সরকার। আরও তিন হাজার কোটি টাকা বাড়তি ঋণ নিতে বাধ্য হয়।
সরকারের ব্যাংকের প্রায় পুরোটা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদায়ী অর্থবছরের সরকার ব্যাংক ঋণের মধ্যে প্রায় ৭৯ হাজার কোটি টাকাই নেওয়া হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। বাকি ৬ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে। ব্যাংক ঋণের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণই বেশি। অর্থাৎ ১০ বছর, ১৫ বছর ও ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া হয়েছে বেশি পরিমাণ। আর ঋণের বিপরীতে সরকারকে উচ্চ সুদ পরিশোধ করতে হবে।
প্রতি বছরই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটায় সরকার। কিন্তু যত বছর পার হচ্ছে তত বড় হচ্ছে বাজেটের ঘাটতির পরিমান। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে নেওয়া টাকার পরিমান বাড়ছে। ব্যাংকাররা বলছেন, এতে দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনছে না। কারণ, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করলে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন হয়। সৃষ্টি হয় বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। বাড়ে অর্থনৈতিক লেনদেন। আর অর্থনৈতিক লেনদেনের বেশির ভাগই হয় ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে। এতে ব্যাংকেরও ব্যবসা বাড়ে, বাড়ে শাখা প্রশাখা।
সামগ্রিকভাবেই অর্থনৈতিক চাকা সচল হয়। কিন্তু যেভাবে ব্যাংক খাত থেকে বাড়তি ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ছে তাতে বেসরকারি খাতের ঋণ দেওয়ার মতো অর্থ ব্যাংকের কাছে থাকবে না। আর চলমান পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ ব্যাংকই বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এর অন্যতম কারণ হলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার একটি অলিখিত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ব্যাংক থেকে রাঘববোয়ালরা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছেন না। তাদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান গ্রহণ না করে বরং বিভিন্ন নীতিসহায়তা দিয়ে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এতে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই ৯ শতাংশ সুদে উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ দিয়ে ফেরত পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিলে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর যে কোনো সংকট মেটাতে সরকারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নেওয়া যাবে। এ কারণে এখন বেশির ভাগ ব্যাংক বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করার পরিবর্তে সরকারের ঋণ দিতেই বেশি উৎসাহী হয়ে পড়েছে। করোনা অতিমারি দীর্ঘায়িত হলে চলতি ২০২০-২১ বছরে সরকারের ব্যাংক ঋণের হার আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের বক্তব্য, এখন ব্যাংক থেকে টাকা সরকারের উন্নয়ন কাজ করা লাগছে। এ টাকা টাকা পরিশোধ করতে ছাপিয়ে শোধ করতে হবে। করোনা মহামারি দীর্ঘায়িত হলে এবং রাজস্ব আদায়ের কোন সংস্কার না এলে চলতি বছর হয়তো উন্নয়ন কাজের কথা ভাবাও যাবে না সরকারি কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে হবে টাকা ছাপিয়ে।