হাবিপ্রবিতে উদ্ভাবিত গ্রেইন ড্রায়ার
সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, দিনাজপুর
🕐 ৯:৫০ অপরাহ্ণ, জুলাই ০৮, ২০২০
আলোড়ন সৃষ্টি করেছে দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) শিক্ষকের উদ্ভাবিত শস্য শুকানোর প্রযুক্তি টু স্টেজ গ্রেইন ড্রায়ার। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশ এবং বৈরী আবহাওয়ায় খুব দ্রুত সময়ে সীমিত খরচে ধান, গম, ভুট্টা শুকানো যাচ্ছে।
এছাড়া আর্দ্রতা ১২-১৪ শতাংশে নিয়ে আসার সুবিধা থাকায় ভুট্টা চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিটি। ২০১৮ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ড্রায়ার উদ্ভাবনের গবেষণা কাজ শুরু করেন হাবিপ্রবির ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. মো: সাজ্জাত হোসেন সরকারের নেতৃত্বে একদল গবেষক। ড্রায়ারটি তৈরির কাজ সম্পন্ন হলে এর কার্যকারিতা এবং গুণাবলী দেখতে পরিদর্শনে যান হাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আবুল কাসেম, ট্রেজারার অধ্যাপক ড. বিধান চন্দ্র হালদার, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. মো. ফজলুল হক (মুক্তিযোদ্ধা), আইআরটি পরিচালক অধ্যাপক ড. মো: তারিকুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. মারুফ আহমেদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ।
পরিদর্শন শেষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আবুল কাসেম বলেছিলেন, এটি একটি নিড বেসড টেকনোলজি। প্রতিনিয়ত আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে এবং প্রতিবছরই বৈরী আবহাওয়ার কারণে আমাদের অনেক ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই সব বিবেচনা করে সাজ্জাত সাহেব শস্য শুকানোর জন্য যে ড্রায়ারটি উদ্ভাবন করেছেন তা বাংলাদেশের কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে আমার বিশ্বাস।
গত বছর প্রকল্পটির অর্থায়নকারী কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. ওয়েস কবীর ও বাকৃবির সাবেক অধ্যাপক ড. বি. কে বালা উপস্থিত থেকে মেশিনটি শুভ উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন রংপুর বিভাগীয় কৃষি কর্মকর্তা এবং দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। উদ্বোধন হলেও ঐ বছর বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যায়নি ড্রায়ারটি। ২০২০ সালে শস্য সংগ্রহের শুরু থেকেই বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত করা হয় ড্রায়ারটিকে। বাণিজ্যিকভাবে কাজ শুরুর পর থেকেই ব্যাপক সাড়া ফেলতে শুরু করে।
চাতালে শুকানোর খরচেই মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ভুট্টা শুকাতে পারছেন ব্যবসায়ীয়া। একই খরচে আর্দ্রতা ১২-১৪ শতাংশে নিয়ে আসার সুবিধা এবং বৈরী আবহাওয়াতেও শুকানোর সুবিধা থাকায় প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে ভুট্টা, ধান শুকানোর জন্য ছুটে আসছেন ভুট্টা চাষি ও ব্যবসায়ীরা। হঠাৎ করে এত বেশি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কর্তৃপক্ষ। চাহিদার তুলনায় ড্রায়ারের ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় শত শত বস্তা শুকানোর জন্য সারিবদ্ধভাবে জমা হয়ে পড়ে আছে ড্রায়ারের পাশে এমন চিত্র দেখা মিলছে এলমিস চৌধুরীর রাইস মিলের একটি অংশে।
গ্রেইন ড্রায়ারটি উদ্ভাবনের নেতৃত্বে থাকা গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. মো: সাজ্জাত হোসেন সরকার জানান, এই করোনা পরিস্থিতিতেও প্রতিদিন গড়ে ২৩০ বস্তা (১৪০০০ কেজি) ভুট্টা শুকানো হচ্ছে। এরপরেও কৃষকদের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। আমাদের দেশে আগে এই ধরনের কোনো প্রযুক্তি ছিল না। আবহাওয়া এবং কৃষকদের কথা বিবেচনা করে আমরাই প্রথম গবেষণার মাধ্যমে এই ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করি। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে শস্য শুকানোর কার্যক্রম চলছে এবং ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি। প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য ফোন কল আসে আমাদের কাছে, আমাদের একটি মাত্র ড্রায়ার হওয়ায় জমাকৃত ভুট্টা শুকাতেই আরও বেশ কয়েকদিন লেগে যেতে পারে। তাই ফোন কল পেলেও বাধ্য হয়ে অনেককে আসতে নিষেধ করা হচ্ছে।
ড. সাজ্জাত সরকার আরো জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণের যে উদ্যোগ নিয়েছেন সেটিকে ত্বরান্বিত করতে আমাদের উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তিটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অধিকাংশ মানুষ বিভিন্নভাবেই কৃষির সঙ্গে জড়িত। বৈরী আবহাওয়ার কারণে প্রতিবছর ফসল শুকাতে না পেরে অনেক ভুট্টা চাষি এবং ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন। আর আমাদের উদ্ভাবিত ড্রায়ারটির মাধ্যমে যে কোনো আবহাওয়াতেই দানা জাতীয় সব ধরনের শস্য শুকানো যাবে।
ফলে আর্থিকভাবে আগে যে ক্ষতি হত সেটি আর হবে না। দেশের প্রতিটি উপজেলায় যদি সরকারিভাবে শস্য শুকানোর জন্য এ ধরনের একটি ড্রায়ার স্থাপন করা হয়, তাহলে একদিকে কৃষকরা যেমন উপকৃত হবে অন্যদিকে ফসল নষ্টের যে সমূহ সম্ভাবনা সেটা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। এছাড়াও এই ড্রায়ার সরকারের ধান, চাল সংগ্রহে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর পর ড্রায়ার পরিদর্শনে গিয়ে হাবিপ্রবি’র রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. মো. ফজলুল হক জানান, আমাদের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য মানুষের কাছে প্রযুক্তির সেবা পৌঁছে দেওয়া। ড. সাজ্জাত সাহেব যে কাজটি করেছেন তা সত্যিকার অর্থেই গর্ব করার বিষয়। এটা শুধু তার একার গর্বের বিষয় নয় এটা পুরো হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশের গর্ব।
কারণ, তার এই উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মাধ্যমে অসংখ্য ভুট্টা চাষি এবং ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। অতিরিক্ত বৃষ্টি বাদলের কারণে ভুট্টা শুকাতে না পেরে প্রতিবছর যে আর্থিক ক্ষতিটা হত এখন থেকে কিন্তু সেটি আর হবে না। প্রতিটি জেলা উপজেলায় যদি সরকারিভাবে এই ধরনের ড্রায়ার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে আরও অনেক বেশি মানুষ উপকৃত হতে পারবে।
উল্লেখ্য যে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কো-ইনভেস্টিগেটর হিসেবে কাজ করেছেন অধ্যাপক ড. মো: মফিজ-উল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক মো: আব্দুল মোমিন সেখ এবং রিসার্চ ফেলো হিসাবে ছিলেন মো: এজাদুল ইসলাম, মো: আখতারুজ্জামান ও মো: হাসান তারেক মন্ডল।