ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শান্তিপদের কিপটামি

বাসুদেব খাস্তগীর
🕐 ৩:৩৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ০৭, ২০২০

শান্তিপদ ঘোষকে পাড়ার সবাই কিপটে হিসেবে জানে। তার হাতের ফাঁক গলে দু’এক টাকা বেশি যাবে, কাউকে দু’এক টাকা দান খয়রাত করবে এমন চিন্তা কেউ করে না। সবকিছুতেই তার হিসাব আর হিসাব। পাড়ার অনিল বাবু একদিন মশকরা করে বলেন, ‘শান্তিবাবু জীবনটা শুধু হিসাবে হিসাবে কাটিয়ে দিলেন, এবার পাড়ার বা সমাজের জন্য কিছু করেন।’

শান্তিবাবু পান চিবিয়ে চিবিয়ে একগাল হেসে বলেন, ‘হিসাবটা কে না বোঝে শুনি! কথায় বলে না পাগলেও হিসাব বোঝে। শুধু আমারটা দেখিস? যত দোষ নন্দ ঘোষ।’ বলেই নাক ছিটকিয়ে চলে গেলেন। সেদিন দুপুরবেলা শান্তিবাবু পরম শান্তিতে বাড়িতে ঘুমাচ্ছেন। হঠাৎ বাড়ির উঠোনে শোনা যাচ্ছে কিছু ছেলের স্লোগান- ‘জিতছে কারা, মহাজনপাড়া, জিতছে কারা, মহাজনপাড়া।’ 

আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে উঠে বারান্দার দরজা খুললেন শান্তিবাবু। দেখলেন পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা একটা ম্যাচ জেতার গোল্ডকাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর স্লোগান দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার?’
‘আমরা ফুটবল খেলায় জিতেছি আর এ গোল্ডকাপটি পেয়েছি দাদু।’
‘তো আমি কী করতাম?’
‘আপনি দাদু খুশি হয়ে কিছু বকশিস করতেন আর কি!’
‘বকশিস তো খুশি হইয়া করতে হয় নাকি? আমি তো খুশি হই নাই, বকশিস করতাম কীয়ের জন্য? যা এখান থেকে যত সব। দুপুরের ঘুমটাই মাটি করে দিলি।’ বলেই দরজাটা ধপাস করে বন্ধ করে দিলেন।
শান্তিবাবুর সঙ্গে ছেলেদের মধ্যে কথাটা বলেছিল রুবেল। নিপু বলে, ‘তোকে বলছিলাম এই কিপটের কাছে না আসার জন্য। আমরা কি উনাকে চিনি না?’ মনে ক্ষোভ নিয়ে ছেলেরা শান্তিবাবুর বাড়ি ত্যাগ করল। বিকেল বেলা বারান্দায় বসে ইজি চেয়ারে দোল খেতে খেতে দুধের কাপে চুমুক দিচ্ছেন শান্তিবাবু। নিজের ঘরের গাভীর দুধ। বউ এসে বলল, ‘দোকানে যাও। এক ডজন ডিম নিয়ে আসো।’
‘এক ডজন ডিম! ওই দিন না আনলাম।’
‘হ, আনার কথা মনে থাকে, কিন্তু খাওয়ার সময় মনে থাকে না।’ বউয়ের এমন কথায় গা ঝাড়া দিয়ে চেয়ার থেকে নেমে পড়লেন শান্তিবাবু। শার্ট গায়ে দিয়ে হনহন করে অদূরে দোকানের দিকে পা বাড়ালেন। ডিম কিনে পাশের চায়ের দোকানে বেলা বিস্কুট দিয়ে চা খেয়ে বাড়িতে ফিরলেন। বউকে বললেন, ‘ডিমের দাম পড়েছে এক ডজন একশ’ বারো টাকা।’
‘কী বলো? একশ’ টাকা ডিমের ডজন।’
‘শোনো একশ’ টাকা ডজন ঠিক আছে। ডিম আনতে গিয়ে চা খেয়েছি বারো টাকা। সেজন্য ডজনে খরচ পড়েছে একশ’ বারো টাকা। না গেলে আমার বারো টাকা বেঁচে যেত।’
‘থাক আর এমন হিসাব করতে হবে না।’
‘কেন হবে না? ব্যবসায়ীরা জিনিসের মূল্য হিসাব করে জিনিসটি আনতে গাড়িভাড়া, মজুরি সব হিসাব করে। সুতরাং ডিমের হিসাব কেন, সব জিনিসের ক্ষেত্রে যাওয়া আসার খরচসহ হিসাব করতে হবে।’
‘হয়েছে হয়েছে তোমার হিসাব নিয়ে তুমি থাকো। শোনো, আগামী শুক্রবারে পাশের বাড়ির ব্রজগোপালের বাড়িতে নিমন্ত্রণ আর শনিবারে শ্যামনগরে আমার বোনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ। ওরা এসে নিমন্ত্রণ করে গেছে।’
‘ব্রজগোপালের বাড়িতে যাব, কিন্তু শ্যামনগরে যেতে পারব না।’
‘কেন?’
‘শ্যামনগরে যেতে আসতে সিএনজিতে পঞ্চাশ পঞ্চাশ একশ’ টাকা খরচ আছে। খাব হয়ত একশ’ টাকা। গিয়ে লাভ কী। ব্রজগোপালের বাড়িতে খেলেই লাভ। আমার ঘরের খাবার একবেলা বেঁচে গেল। মানে আমার একশ’ টাকা লাভ।’
‘তোমার যেখানে ইচ্ছে যাও।’ বলেই শান্তিবাবুুর স্ত্রী রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। শান্তিবাবু বলেন, ‘আমি হিসাব করে চলি বলে শান্তিতে আছি, তোমার বাপের মতো আমার জমিদারি নাই।’ সেদিন ব্রজগোপালের বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ খেয়ে লাভের হিসাব করে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন। শান্তিবাবুর বয়স প্রায় ষাটোর্ধ্ব। কিন্তু এখনো শাশুড়ি বেঁচে আছেন। বয়স প্রায় নব্বই। শ্বশুরবাড়ি পাশের গ্রাম নন্দীপুরে। হেঁটে যেতে লাগে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। সিএনজিতে বা মোটরসাইকেলেও যাওয়া যায়। শ্বশুরবাড়ির পাশেই নন্দীবাজার। এই গ্রাম থেকে অনেক লোক সে বাজারে সওদা করতে বা জিনিসপত্র বিক্রি করতে যায়। আগামী সপ্তাহের রোববারে জামাই ষষ্ঠী। জামাই শান্তিবাবুকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। স্ত্রী জানেন শান্তিবাবু জামাই ষষ্ঠীর নিমন্ত্রণে যাবেন। কারণ গেলে দাওয়াসহ দক্ষিণা মেলে। শাশুড়ি আছে বলে এখনো কদর। বয়স যা হোক জামাই তো জামাই। তিনি কোনো বছর সহজে শ্বশুরবাড়ির জামাই ষষ্ঠী মিস করেন না। লাভের হিসাব করে প্রয়োজনে হেঁটে যান। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। চারিদিকে করোনার প্রকোপ। মানুষজন ঘর থেকে বের হচ্ছে না। শাশুড়ি নিমন্ত্রণ দিয়ে রেখেছেন।
বউ সেদিন বলেছেন, ‘এবার না গেলে হয় না? করোনার কারণে মানুষজন তেমন ঘর থেকে বের হচ্ছে না।’
শান্তিবাবু ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে যাচ্ছেন। হিসাব করছেন না গেলে তার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। জামাই ষষ্ঠীর আগের দিন বউকে বলে, ‘যেতেই হবে। না গেলে শাশুড়ি মা রাগ করবেন। প্রতি বছর যাই যখন প্রথা ভেঙে লাভ কী।’
বউ আসল ঘটনা বুঝতে পারে। যতই মানা করুক শান্তিবাবু যাবেনই। গেলে তো অনেক প্রাপ্তি। সেজন্য জোর করে কিছু বলে না। পরের দিন রোববার শান্তিবাবু পায়জামা পাঞ্জাবি পরে রওনা দেন শ্বশুরবাড়িতে। মনে মনে ঠিক করেছেন হেঁটেই যাবেন, টাকা বাঁচবে। সে বাজারে মোটরসাইকেল করে সওদা করতে যাচ্ছে পাড়ার ছেলে সুমন। সুমন শান্তিবাবুর চরিত্র ভালো করেই জানে। তাকে দেখে মোটরসাইকেল থামাল।
‘কী কাকা কোথায় যাচ্ছেন? বাজারে বুঝি? হেঁটে হেঁটে কেন?’
শান্তিবাবু চিন্তা করলেন, ভাগ্য আজ সুপ্রসন্ন। মোটরসাইকেলে যাবেন। টাকা বাঁচল, হাঁটতেও হলো না।
‘ওঠেন ওঠেন’ বলতেই শান্তিবাবু সুমনের পেছনে মোটরসাইকেলে উঠে পড়লেন। শান্তিবাবুর কাছে কতবার কতকিছুর জন্য চাঁদা আনতে গিয়েছে, নানা ছলাকলায় দশ-বিশ টাকা হয়তো দিয়েছেন কিন্তু অন্তত দশবার ঘোরাঘুরি করিয়েছেন। সুমনের মনে এসেছে এক বুদ্ধি। কিছুক্ষণ পর সুমন কাশতে লাগল। প্রচ- শ্বাসকষ্টের ভাব দেখাল। মোটরসাইকেল থামিয়ে কাশতে লাগল। শান্তিবাবু দ্রুত নেমে সরে দাঁড়ালেন।
‘তোর এমন কাশি কয়দিন থেকে? শ্বাসকষ্টও আছে!’
‘বেশ কয় দিন ধরে...।’ বলতে বলতে হাঁপাতে লাগল সুমন। শান্তিবাবুর মাথা গরম হয়ে উঠেছে- ‘তুই লক্ষ্মীছাড়া আমাকে বললি না কেন। কোন দুঃখে ফেললি! তোর মোটরসাইকেলে যাওয়ার গুষ্টি কিলাই!’

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper