তারুণ্যের বেড়ে ওঠা ও দিনযাপন
সাইফুজ্জামান
🕐 ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৭, ২০২০
তারুণ্য বাঁধ না মানা এক অহংকার। তারুণ্যের স্মৃতি সারা জীবনের সঞ্চয়। মধুর দিনগুলো চলে যায় ঠিকই। বন্ধুদের খুঁনসুটি, শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের রসায়ন, ফেলে আসা দিন, প্রিয় মুখ, আর দিনযাপনের আনন্দ-বেদনার স্মৃতি বুকের ভেতর স্থির হয়ে থাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ভাবনা আলাদা। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলো আমাদের কাছে মূল্যবান। মফস্বলে আমাদের অনেকের বেড়ে ওঠা।
দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, জানা অজানা বৃক্ষ, ফুল, ফল ও পাখি সবুজের মধ্যে জ্বলজ্বল করত। যৌথ পরিবারের সকলে একে অন্যকে জড়িয়ে রাখত। একেক জন শিক্ষক ছিলেন একেক ধরনের চরিত্রের অধিকারী। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াতেন। পাঠ্যক্রমের বাইরের শিক্ষা আমরা তাদের কাছ থেকে কম পাইনি। বিকেলে খোলা মাঠে সাধারণ খেলার সামগ্রী নিয়ে মেতে থাকতাম। সন্ধ্যার আগেই সবাইকে ফিরতে হত ঘরে। না ফিরলে কড়া শাসন, শাস্তি অপেক্ষা করত। এত বইয়ের বোঝা আমাদের ছিল না।
এই শহরে আমাদের ছেলেমেয়েরা ফার্মের মুরগির মতো বেড়ে ওঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগে ব্যাগ বইয়ের চাপে স্ফীত হয়ে যায়। তারপর স্কুল-কোচিং সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি। জিপিএ ফাইভ নামক দৈত্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে তারা যন্ত্রে পরিণত হয়। এক সময় মানবিকতা হারিয়ে ফেলে। ঘরের খাবারের চেয়ে জাঙ্ক ফুড তাদের প্রিয় হয়ে ওঠে খুব। বিশাল বপু রোগ ব্যাধি ক্রমপ্রসারনমান শরীরে সঞ্চারিত হয়। অল্প বয়সে চোখে চশমা লাগে। তার পাওয়ার বদলাতে হয় প্রায়ই। কম বয়স থেকে এখন হাতে হাতে ঘুরছে স্মার্ট ফোন। একদিকে আছে বিশ্বভ্রমণের সুযোগ। অন্যদিকে অন্ধকার জগতের হাতছানি। রয়েছে লাইব্রেরি ঘুরে বই পড়া, সিনেমা দেখা ও গেম খেলার পর্যাপ্ত সুযোগ।
শৈশবে আমরা লাইব্রেরিতে বই খুঁজে পড়তাম। মলাট খুলে বই পড়ার আনন্দ বেশি। যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে। এখন একক পরিবারের ক্ষুদ্র সত্তা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বামী-স্ত্রী, পুত্রকন্যার সংসার নিরানন্দের। আমাদের কাছে কাজিনদের (খালাত, মামাত, চাচাত ভাই-বোন) সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দ ছিল আবেগময়। এখন তরুণ প্রজন্মের কাছে কাজিনরা অপরিচিত। এদের কম বন্ধুরা আবেগের কোনো বার্তা বয়ে আনে না। কাছের কিছু নেই, সবাই দূরের। রাত জেগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপ কল করার মধ্যে আনন্দের চেয়ে এদের বেদনা বেশি স্পর্শ করে।
উন্নত অনেক দেশে প্রথাগত লেখাপড়ার গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কারিগরি শিক্ষা প্রাধান্য পায়। একটি বৃত্তাবদ্ধ বেড়ে উঠতে উঠতে তারা শেখে। মুখস্ত করে উগরে দেওয়ার মধ্যে আমাদের শিক্ষা সীমাবদ্ধ। জিপিএ ফাইভের দৌড়ে সামিল হওয়ার প্রস্তুতি চলে জীবনভর। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরির পরীক্ষা অবধি চলে এভাবে। ভাবা যায় আর কত কী! কেউ চাকরি নামক সোনার হরিণ ধরতে পারে, কেউ পারে না। হতাশার হাত বদল চলে জীবনময়।
আনন্দের মধ্যে বেড়ে ওঠা, সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জয় করা, টিকে থাকা কতো না আনন্দের তা বুঝবে না এখনকার ছেলেমেয়েরা। তারুণ্যের বেড়ে ওঠা এখন হতাশার মধ্যে। ক্রমশ বিষাদের চাদরে ডুবে গিয়ে এরা মানসিক রোগীতে পরিণত হচ্ছে। অনিদ্রা, মৃত্যুভীতি, কোনো কিছু ভালো না লাগা তৈরি হয়। মানসিক সাপোর্ট সেন্টারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরামর্শ ও ওষুধ দিয়ে তরুণদের মনোজগতের পরিবর্তনকে রোখার চেষ্টা করছেন। প্রথম দিকে কেউ এ সব সেন্টারের সাহায্য নিতে চায় না। অনেক দিন বিষন্নতায় ভোগার পর তারা এসব সেন্টারে যায়। একজন তরুণের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার পরিবারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। চাকরিজীবী বাবা-মা সন্তানদের সেরকম সময় দিতে পারেন না। একাকিত্বের সঙ্গী হয় স্মার্ট ফোন। আমাদের শৈশবে, কৈশোরে প্রতিটি মহল্লায় অধিকাংশ ঘর থেকে হারমোনিয়ামের সুর ভেসে আসত সকাল সন্ধ্যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারে সকলে মিলে সিনেমা দেখা, নাটকপাড়ায় যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটত।
নগরের বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক সংগঠন, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য ও নাট্যকলা প্রশিক্ষণ চলছে হরদম। অনলাইনে শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এর পরিধি পরিব্যাপ্ত। করোনাকালে জুমে লেখাপড়া চলছে। কাউন্সেলিং, চিকিৎসা পরামর্শ চলছে ঠিকই। বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। ছবি আপলোড, ভিডিও ক্যামেরায় ধরা পড়ছে আমাদের অভিব্যক্তি। কোথায় যেন সুরের অভাব শোনা যাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে তরুণ প্রজন্ম। রুটিনমাফিক এই জীবনে তাদের পরিবর্তন প্রয়োজন। এদের মুখে গান, কবিতা শুনতে ভালোবাসি। গিটারের তারে ঝংকৃত হোক স্বপ্নের বাংলাদেশ। তারুণ্যের অনেক সময় কেড়ে নিচ্ছে স্মার্ট ফোন। গেম খেলে, মুভি দেখে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থেকে অর্জন থেকে বিয়োজন বেশি।
লেখাপড়ার পাশাপাশি গান, কবিতা, সৃজনশীল কাজে তাদের যুক্ত থাকতে হবে। ধ্যান, আত্মমগ্নতা, ব্যায়াম শরীর ও মনকে সুস্থ রাখে। বাড়াতে হবে জানার পরিধি। মহান ব্যক্তিত্বদের জীবনী পাঠ, বিজ্ঞানকে জানা ও নিজের মেধার ব্যবহার যথাযথভাবে করতে পারলেই তরুণ প্রজন্ম ভবিষ্যতে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারবে। আমাদের তরুণরা সৃজনে ও মেধায় যোগ্য হয়ে উঠুক এই-ই প্রত্যাশা। অনুকূল পরিবেশ ও বিশ্বস্ত পরিবারই তরুণদের মধ্যে কেবল পারে দুঃসময় মোকাবেলার শক্তি জোগাতে। আমরা অপেক্ষা করছি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র গঠিত হবে তরুণদের হাতে।
সাইফুজ্জামান : প্রাবন্ধিক