ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনা

শেখ আনোয়ার
🕐 ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ, জুন ৩০, ২০২০

রবীন্দ্র প্রতিভায় বিজ্ঞান ভাবনার অনুসন্ধানের প্রাসঙ্গিকতার একটা দার্শনিক দিক রয়েছে। দার্শনিকদের ভাষায় সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিপরীত মেরুর দুটো বিষয়। এর পেছনের যুক্তি হচ্ছে বিজ্ঞান ভবের কথা বলে আর সাহিত্য বলে ভাবের কথা। সাহিত্য ও বিজ্ঞান এই যুক্তিতে চর্চার দুটো পৃথক বিষয়। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের এ বিভাজন কৃত্রিম। এদের মধ্যে গভীর সম্পর্কটাই স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে জর্জ সাটিন বলেছেন, ‘উঁচু দরের সাহিত্য, মহৎ শিল্প কিংবা উত্তম সংগীত ছাড়া জীবন অর্থহীন।

এগুলোই মানসিক সত্তাকে পরিচ্ছন্ন করে রাখে। অপরদিকে প্রকৃতির অপার রহস্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া, পারলে তার সমাধান করা, জীবনকে আরও স্বাচ্ছন্দ্য করা, মনের অগাধ প্রসার ঘটানোটাই বিজ্ঞানের কাজ।‘ এমন ভাবনায় সাহিত্য আর বিজ্ঞান বিপরীত মেরুর বিষয় নয়। বলা যায় একে অন্যের অঙ্গীভূত। বিজ্ঞান ও সাহিত্য এই দুয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে দিতে চাননি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষীবৃন্দ। আইনস্টাইনের বেহালাবাদন আমাদের কোন সত্যটা সহজে জানিয়ে দেয়? কিংবা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিজ্ঞানচেতনা?

বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্য এই দুই সংস্কৃতির মিলন প্রয়াস রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও জীবনচর্চায় সার্থক রূপ ও পরিণতি লাভ করেছে। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে ধ্রুবতারা ধরে এই দুই সংস্কৃতির মিলনে একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এই সংস্কৃতির মূলকথা হবে, অঙ্গন ভাগাভাগি নয়। বিজ্ঞানকে শিল্প সাহিত্যের প্রাঙ্গণে এবং শিল্প সাহিত্যকে বিজ্ঞানের গবেষণাগারে ঠাঁই করে দিতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ আয়ুষ্কালে বিজ্ঞানের যে সব দুনিয়া পাল্টানো আবিষ্কার জীবজগৎ, বস্তু পৃথিবী এবং মহাকাশকে এক সূত্রে গেঁথে নিয়েছে সেসবের প্রতি তার নিজের আগ্রহ ও অন্বেষণ ছিল গভীর ও ব্যাপক। এর স্বাক্ষর ছড়িয়ে রয়েছে তার গান, কবিতা ও প্রবন্ধে। বিজ্ঞান সখা কবি বিজ্ঞানের সত্যকে সাহিত্যের সম্পদের সঙ্গে প্রথিত করে আমাদের আনন্দ ও চেতনার দিগন্ত নিরন্তর প্রসারিত করেছেন।

ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান শিক্ষা : শৈশবে কবি বিজ্ঞানের পাঠগ্রহণ করেন গৃহশিক্ষকের কাছে। গৃহশিক্ষক রবিকে হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পানি গরম করলে কীভাবে তা বাষ্পীভূত হয়ে ওপরে উঠে যায়। এই গৃহশিক্ষকই রবিকে শিখিয়েছেন নানা প্রকৃতির কথা। পানি ও মাটি মিলেমিশে কীভাবে শুকনো বীজ অঙ্কুর গজায়। এই কৌতূহল রবির শিশুসত্তা জুড়ে ছিল বহুদিন।

বীজের অঙ্কুর হওয়ার এ বিস্ময় যৌবনের দিন পর্যন্ত কবিকে আলোড়িত করেছে। যৌবনে লিখিত, বসুন্ধরা কবিতায় তাই তিনি লেখেন ‘সম্মুখে মেলিয়া মুগ্ধ আঁখি/ সর্ব অঙ্গে সর্র্ব মনে অনুভব করি/ তোমার মৃত্তিকা মাঝে কেমনে শিহরি/ উঠিতেছে তৃণাঙ্কুর।‘ গ্রহ নক্ষত্র সূর্য নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ কবি পেয়ে যান তার পিতার কাছে। এ বিষয়ে কবির নিজের কথা ‘বয়স তখন হয়ত বারো হবে, পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ডালহৌসি পাহাড়ে। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে গিরিশৃঙ্গের বেড়া দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিষয় জানিয়ে দিতেন।’

একাগ্র বিজ্ঞান পাঠক রবীন্দ্রনাথকেও আমাদের চিনে নিতে হবে। তার সাহিত্যে আসা গুণীজনের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, তিনি আইনস্টাইন, ম্যাক্স প্লাঙ্ক, মিলিকান প্রমুখ বিজ্ঞানীর রচনা মন দিয়ে পড়েছেন। এই গভীর পঠনের বিশ্বাসবোধ তিনি তার বিশ্বপরিচয় গ্রন্থে ব্যাখ্যাও করেছেন। ফ্রয়েড, এডলার, ইয়াং প্রমুখ চিন্তাবিদের লেখার সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল। তিনি পড়েছিলেন বংশানুক্রম ও আচরণতত্ত্ব সম্পর্কে প্যাভলভ, ওয়াটসন প্রমুখের বইপত্র। প্রাণতত্ত্ব ও মনোস্তত্ত্ব নিয়ে লেখালেখির ইচ্ছাও তিনি ব্যক্ত করেছেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সত্যাসত্য তার সাহিত্যে নিয়ে আসার চেষ্টায় কবি এতসব পড়াশোনার গভীরে গিয়েছিলেন।

এই জগৎ ও এই জীবনের সৃষ্টিরহস্য নিয়ে দার্শনিক বিতর্কটা খুবই প্রাচীন। ভাববাদী দর্শনের কথা, সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে স্রষ্টা নামক সর্বশক্তিমানের ইচ্ছায় এবং চেষ্টায়। এই সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী ইচ্ছাময় স্রষ্টার সাত দিনের প্রচেষ্টার ফল ও ফসলসহ এই পৃথিবী। পক্ষান্তরে, বস্তুবাদী দর্শনের সিদ্ধান্ত জগৎ ও জীবন এক সুদীর্ঘ বিবর্র্তনের পথ বেয়ে বাস্তবে রূপ পেয়েছে। এই ধারণায় বলা হয়েছে পৃথিবীর উৎপত্তি পাঁচশ’ কোটি বছর পূর্বে। এত কোটি বছরের পুরনো পৃথিবীতে পরিপূর্ণ মানুষের বয়স মাত্র পঞ্চাশ হাজার বছর। বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার, এই সত্যটা সাহিত্যের অঙ্গনে তুলে নিলেন কবি।

বত্রিশ বছর বয়সে রচিত সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখলেনÑ ‘ধীরে যেন উঠে ভেসে/ ম্নানচ্ছবি ধরণীর নয়ন নিমিষে/ কত যুগ যুগান্তর অতীত আভাস,/ কত জীব-জীবনের জীর্ণ ইতিহাস/ যেন মনে পড়ে সেই বাল্য নীহারিকা,/ তারপরে প্রজ্বলন্ত যৌবনের শিখা/ তারপরে স্নিগ্ধ শ্বাস অন্নপূণ্যালয়ে/জীবনদাত্রী জননীর কাজ বক্ষে লয়ে/ লক্ষ কোটি জীব-কত যুদ্ধ, কত মৃত্যু নাহি তার শেষ।‘ নীহারিকায় গ্যাস ধূলি প্রতিনিয়তই উত্তপ্ত হয়। আকর্ষণে-বিকর্ষণে চক্রগতি লাভ করে। ঘনীভূত হয়ে বাষ্প তেজসহ সূর্য তারকায় উদ্ভাসিত হয়। নভোবিজ্ঞানের এই সত্যে বিস্ময়-বিমূঢ় কবি গেয়ে ওঠেন ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ/ তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ।‘ বর্তমান পরমাণু বিজ্ঞানের সূচনা করেন প্যারিসের মাদাম কুরি। এই সূচনার মূলে ছিল তার রশ্মিকণিকা নিঃসারি রেডিয়াম আবিষ্কার।

এই মৌল আবিষ্কার বিশ্বের যাবতীয় বস্তুর ব্যাখ্যাকে পরমাণু তত্ত্বের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। পরমাণু বিজ্ঞান বিষয়েও কবির কৌতূহল কত গভীর ছিল, তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন ‘নৈবেদ্য’ থেকে শুরু করে ‘উৎসর্গ’ গীতাঞ্জলির বহু কবিতা ও গানে। নৈবেদ্য-এ লেখেনÑ ‘এই স্তব্ধতায়/শুনিতেছি তৃণে তৃণে ধুলায় ধুলায়/ মোর  অঙ্গে রোমে রোমে লোক-লোকান্তরে। গ্রহ সূর্য তারকায় নিত্যকাল ধরে।/ অণু-পরমাণুদের নৃত্য কলরোল।‘ নীহারিকা চক্র থেকে নির্গত হয়ে এ বিশ্বের সৃষ্টি এই রহস্য নিয়ে কবি নিমগ্ন থেকেছেন।

এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিকদের পরীক্ষিত ধারণার সারমর্ম তিনি ‘উৎসর্গ-এর একটি কবিতায় ব্যক্ত করেছেন ‘আকাশ সিন্ধুর মাঝে এক ঠাঁই/ কিসের বাতাস লেগেছে/ জগৎ ঘূর্ণি জেগেছে/ ঝলকি উঠেছে রবি-শশাঙ্ক/ঝলকি উঠেছে তারা/ অযুত চক্র ঘুরিয়া উঠেছে/ অবিরাম মাতোয়ারা।‘ কবি গভীরভাবে মহাকাশপ্রেমী। একথার অপূর্ব নিদর্শন তার ‘বলাকা’ কাব্যের ‘ছবি’ কবিতাটি। এই কবিতার শুরুতে বিগতা কোন মানবীর প্রতিকৃতির নীরবতা নিয়ে কবির প্রশ্ন ‘তুমি কি কেবলই ছবি’ ইত্যাদি। এই ছবি ধারণার বিপরীত দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে তিনি জীবনের চারপাশের উপমা নিলেন না, উপমা খুঁজে পেতে তিনি পাড়ি দিলেন মহাকাশে অর্থাৎ তার মনন চলে গেল আকাশ ছাড়িয়ে। মহাকাশে। ছবি কবিতাটিতে উপমা প্রয়োগ করে তিনি লিখেছেনÑ ‘ওই যে সুদূর নীহারিকা/ যারা করে থাকে ভিড়/ আকাশের নীড়/ ওই যারা দিনরাত্রি/ আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী/ গ্রহ তারা রবি/ তুমি কি তাদের মতো সত্য নও?’

শুধু মহাকাশ বিজ্ঞানই নয়। জীববিজ্ঞানেও যে তার চেতনা উদ্দীপ্ত হত সে প্রমাণও তার বহু কবিতায় ছড়িয়ে রয়েছে। জিনতত্ত্ব আজ নানান অসাধ্য সাধন করছে। জিনতত্ত্বের সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে ক্লোনিং গবেষণা এবং ক্লোনিং আবিষ্কার আজকের পৃথিবীতে তোলপাড় তুলেছে। বংশপরম্পরাবাহিত জিনতত্ত্বকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন অনেক আগেই। কিন্তু তবুও তিনি জিনতত্ত্বের জৈবতার দিকটা অতিক্রম করার বাসনা প্রকাশ করে লিখেছেন ‘শুরু হতেই ও আমার সঙ্গ ধরেছে/ ঐ একটা অনেক কালের বুড়ো/ আমাতে মিশিয়ে আছে এক হয়ে/ ও এসেছে কত লক্ষ পূর্ব পুরুষের/ রক্তের প্রবাহ বেয়ে/ কত যুগের ক্ষুধা ওর, কত তৃষ্ণা. জীর্ণ করে ওকে দিনে দিনে পলে পলে/ বাসনার দহনে. আমি আজ পৃথক হব।/ ও থাক ওইখানে দ্বারের বাহিরে।/ ওই বৃদ্ধ ওই বুভুক্ষু. মুক্ত আমি, স্বচ্ছ আমি, স্বতন্ত্র আমি,/ নিত্যকালের আলো আমি...।’

ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিজ্ঞানের সত্য প্রচার প্রচেষ্টা : বৈজ্ঞানিক সত্যকে নিজের গান, কবিতা এবং প্রবন্ধের মাধ্যমে অন্যকে জানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন কবি। এই উদ্যোগেই বিজ্ঞান মনা কবি থেমে যেতে চাননি। বিজ্ঞান সত্যকে সবার জ্ঞানের সীমায় এনে দেওয়ার লক্ষ্যে গ্রন্থ রচনায় এগিয়ে এলেন। পরমাণু তত্ত্ব ও ভৌত রসায়ন নির্ভর মহাকাশ পর্যবেক্ষণ নিয়ে একটি সাধারণ জ্ঞানের গ্রন্থ লেখেন। ‘বিশ্ব পরিচয়’ নামের গ্রন্থটি কবির অর্জিত জ্ঞানের জ্বলন্ত প্রকাশ। পরমাণুরা কীভাবে বিদ্রোহ করছে এবং এর ফলে কীভাবে উদ্ভব ঘটছে জ্যোতিপুঞ্জের, সেসব কথা লিখেছেন এই গ্রন্থে। তার কলমে, ইলেকট্রন বাইরে থেকে ভেতরের পথে দর্শন দেয়। কেন দেয় এবং হঠাৎ কখন দেখা দেবে তার কোনো বাধা নিয়ম পাওয়া যায় না।

তেজ শোষণ করে ইলেকট্রন ভেতরের পথ থেকে বাইরের পথে লাফিয়ে যায়। এই লাফের মাত্রা নির্ভর করে শোষিত তেজের পরিমাণের উপর ইলেকট্রন তেজ বিকীর্ণ করে, কেবল যখন যে তার বাইরের পথ থেকে ভেতরের পথে আবির্ভূত হয়। ছাড়া পাওয়া এই তেজকেই আমরা আলো রূপে পাই। মহাকর্ষ বিষয়ে বিশ্ব বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক অভিমত বিশ্বকবি নিজে বিশ্লেষণ করলেন ‘বিশ্ব পরিচয়’ গ্রন্থে। তিনি লিখলেন ‘পরমাণুদের অন্তরের টানটা বৈদ্যুতিক টান, বাহিরের টানটা মহাকর্ষের, যেমন মানুষের ঘরের টানটা আত্মীয়তার, বাইরের টানটা সমাজের। আরও জানালেন কবি, মহাকর্ষের ক্রিয়া একটুও সময় নেয় না।

আকাশ পেরিয়ে আলো আসতে সময় লাগে, বৈদ্যুতিক শক্তিরও ঢেউ খেলিয়ে পরীক্ষা করেও মহাকর্ষের বেলায় যে রকম সময় নিয়ে চলার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তার প্রভাব তাৎক্ষণিক। আরও একটা আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আলো আর উত্তাপ পথের বাধা মানে, কিন্তু মহাকর্ষ তা মানে না।‘ কবি আরও জানালেন ‘অবশেষে আইনস্টাইন দেখিয়ে দিলেন এটা একটা শক্তি নয়। আমরা এমন একটা জগতে আছি যার আয়তনের স্বভাব অনুসারেই প্রত্যেক বস্তু প্রত্যেকের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য। বস্তু মাত্র তারই প্রকাশ। এটা সর্বব্যাপী, এটা অপরিবর্তনীয়। মহাকবি কালিদাসের কাব্য পাঠে উদ্দীপিত হয়ে গাছের সঙ্গে নাড়ির টান থাকা কবি লিখলেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লহো এ নগর।‘ অরণ্যের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের গভীর সত্যটা যখন বিজ্ঞানের আবিষ্কারেও প্রতিষ্ঠিত হল, কবি তখন শতগুণ উৎসাহিত ও উদ্দীপিত হলেন। কবির নিসর্গপ্রীতি ও প্রাণের সত্য-গাঁথা ‘বিশ্ব পরিচয়’ -এর পাতায় উঠে এল এভাবে ‘বিশেষ একটা যুগে প্রাণমন এল পৃথিবীতে অতি ক্ষুদ্র জীবকোষকে বহন করে। পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাসে এদের আবির্ভাব অভাবনীয়।

কিন্তু সকল কিছুর সঙ্গে সম্বন্ধহীন একান্ত আকস্মিক কোনো অভ্যাসগতকে আমাদের বুদ্ধি মানতে চায় না। আমরা জড় বিশ্বের সঙ্গে মনোবিশ্বের মূলগত কোনো ঐক্য কল্পনা করতে পারি সর্বব্যাপী তেজ ও জ্যোতি পদার্থের মধ্যে।‘ অনেক কাল পরে বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে, আপাতদৃষ্টিতে যে সকল স্থূল পদার্থ জ্যোতিহীন তাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন আকারে নিত্যই জ্যোতির ক্রিয়া চলছে। এই মহাজ্যোতিরই সূক্ষ্ম বিকাশ প্রাণে এবং আরও সূক্ষ্মতর বিকাশ চৈতন্যে ও মনে। জড় থেকে জীবে একে একে পর্দা উঠে মানুষের মধ্যে এই মহাচৈতন্যের আচরণ ঘোচাবার সাধনা চলেছে। কবি রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে প্রবর্তন করেন হাল কর্ষণ অনুষ্ঠান।

এর পাশাপাশি শান্তিনিকেতনে শুরু করেন বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠান। সৌন্দর্যের প্রশ্ন নয় শুধু, বনকর্তনের ফলে প্রাণ ধারার বিঘ্ন নিয়ে কবি বলেন ‘সূর্যতেজ থেকে অরণ্য অগ্নিকে বহন করছে, তাকে সত্য করছে মানুষের ব্যবহারে। আজও সভ্যতা অগ্নিকে নিয়েই অগ্রসর হয়ে চলেছে। সুতরাং অরণ্য থেকে আমরা যা কিছু নিচ্ছি সেসব ফিরিয়ে দিতে বলেছেন তিনি বৃক্ষরোপণের আয়োজনে। বুঝিয়ে দিয়েছেন, বন আমাদের বন্যতা নয়, দিতে চায় বন্ধুত্ব।

শিক্ষায় বিজ্ঞান সচেতনতা : কবিকণ্ঠে বারবার উচ্চারিত হয়েছে আমাদের শিক্ষার কর্মসূচিতে বিজ্ঞান অপরিহার্যতার কথা। বিপ্লবোত্তর রাশিয়া পরিদর্শনের পর এদেশের শিক্ষা সমস্যা সমাধানে সে দেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণের কথা বলেছেন। কবির মনোযোগ সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল রাশিয়ার বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা।

তিনি সাগ্রহে লক্ষ করেছেন, দেশের বিজ্ঞান শিক্ষা কীভাবে গণমন থেকে অন্ধ কুসংস্কার দূর করেছে। এজন্যে স্বদেশের বিদ্যালয়গুলোতেও তিনি বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেন ‘শিক্ষাক্ষেত্রকে সকল দিকে পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে। একটুখানি ছিটেফোঁটা শেখানো গোড়া থেকেই বিজ্ঞান ধরিয়ে দেওয়া দরকার। বিশেষত ফলিত বিজ্ঞান।’ তিনি জানতেন এই সত্যটা, বিজ্ঞান দেশের আপামর মানুষের বাঁচার, সমস্যার সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তুলতে পারে। এটা সম্ভব বিজ্ঞানের তথ্য ও তত্ত্বকে বিজ্ঞানের নীতি ও দর্শনের সঙ্গে যথাযোগ্য প্রয়োজনে মিলিয়ে দিতে পারে।

কবির বিজ্ঞাননির্ভর জীবন সমীক্ষা : রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও মননের ক্রমবিবর্তন ডারউইনের বিবর্তনবাদের চমৎকারিত্বকেও চমকে দেয়। কবির বয়স যত বেড়েছে, অভিজ্ঞতা যত প্রজ্ঞার দিকে এগিয়েছে, তিনি ততই বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছেন। সাধারণ্যে প্রক্রিয়াটা এমন বয়সের ভার মানসিক বন্ধ্যাদশা ডেকে আনে। এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-চেতনা মানুষের মনোজগতকে স্থবির করে দেয়। কিন্তু রবীন্দ্র মননে ঘটেছিল ঠিক বিপরীত ঘটনা। বয়স যত বেড়েছে, তিনি ততই মন-মননে আধুনিক হয়েছেন। আপডেট হয়েছেন। প্রগতিশীল হয়েছেন। সর্বোপরি বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছেন পুরোপুরি। এর উজ্জ্বল নিদর্শন তিনি রেখেছেন আশি বছর বয়সে নিজের জীবন সমীক্ষায়।

তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ে লেখেন, ‘জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে/ এ বিশ্বাস মনে আজ জাগে-লক্ষ কোটি নক্ষত্রের/ অগ্নি নির্ঝরের যেথা নিঃশব্দ জ্যোতির বন্যাধারা/ ছুটেছে অচিন্ত বেগে নিরুদ্দেশ শূন্যতা প্লাবিয়া/ দিকে দিকে/ তমোঘন অন্তহীন সেই আকাশের বক্ষস্থলে/ অকস্মাৎ করেছিল উত্থান/ পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে/ অঙ্কে অঙ্কে চৈতন্যের ধীরে ধীরে প্রকাশের পালা/ আমি সে নাট্যের পাত্রদলে/ পরিয়াছি সাজ/ আমারে আহ্বান ছিল যবনিকা সরাবার কাজে/ এ আমার পরম বিস্ময়।’

 

শেখ আনোয়ার : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক

[email protected]

 
Electronic Paper