ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

স্বপ্নভঙ্গ

সাজ্জাক হোসেন শিহাব
🕐 ২:৫১ অপরাহ্ণ, জুন ০৫, ২০২০

জীবনের ত্রিশটি গ্রীষ্মকাল পার করল রবিউল। কিন্তু কোনো গ্রীষ্মেই ধেয়ে আসেনি এমন ঝড়। পাকা ফসলের তামাটে রঙে মিশে যায়নি মানুষের হাহাকার। এমনটি শোনেনি পূর্বপুরুষদের মুখেও। একটা অদৃশ্য দানব হানা দিয়েছে দেশে। সারা দুনিয়ায়। যা বিভক্ত করে দিয়েছে মানুষকে।

অবিশ্বাস কাজ করে মানুষে মানুষে। মসজিদ থেকে মন্দির, সবকিছুতেই চলছে বিধিনিষেধ। নিরাপদ দূরত্বে থাকার আবেদন করছে সবাই। রবিউল বউকে পাশে নিয়ে মাঝে মাঝে এসব ভাবে। রাত হলে পান চাবায় আর বউয়ের সঙ্গে উঠোনে শুয়ে শুয়ে কথা বলে। কী হল এসব! আকাশে তারার ক্যারাভানে তাকায় তার বউ। মাঝে মাঝে রবিউলকে বলে, এইটা করোনাকাল। এত ভাইব্যা লাভ নাই। আকাশে যে তারা দেহন যায়, সেটা দেইখ্যা সময় কাটাও।

দ্যাখো না, তারা ভরা আসমান থাইক্যা আলো চুইয়া আমারে কেমন রাঙায়ে দ্যায়! এমন্ডা দেখছ কখনো! সারাদিন বাড়িতে পাখি আহে, গান হায়। ঘুঘুর সে কী আমোদ। গাছে গাছে পাখি ডাহে। যেন ওগো ঈদ লাগছে! শুধু আমাদের মুখে হাসি নাই। এমনটি দ্যাখছো কখনো। রবিউল বউয়ের কথায় চুপসে যায়। একটু ভাবে। কোনো কথা না বলে রবিউল তার চোখ দূর আসমান থেকে নামিয়ে জমিনে আনে। আধোকালো রাতে একটা পেঁচা ডেকে চলেছে। ডাক। সেদিকে খেয়াল করে রবিউল। এরপর কী যেনও মনে করে পাশে থাকা স্ত্রীর গালে তাকায়। এরপর মায়াবী প্রেমে কাছে টানে তাকে। জড়িয়ে ধরে বুকে। সারা রাত তারা গপ্প করে।

একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের জময দুই মেয়ে আবার স্কুলে যাবে। মজা করবে। পাখির মতো ঘুরবে। একদিন পৃথিবীর রোগ শেষ হয়ে যাবে। মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। মানুষে মানুষে আড্ডা হবে। আমাদের আপনজন বাসায় আসবে। হাসিমুখে মানুষ মানুষকে স্বাগত জানাবে। এসব ভাবে তারা। আর আকাশের তারা গোনে। এভাবে দুজন হাজারো স্বপ্ন দেখে রাত পার করে। পরের দিন। দিনের আলো না ফুটতেই চুপিসার গঞ্জের হাটে যায় রবিউল। করোনা এলেও তার এ কর্মে ছেদ পড়েনি এতটুকু। শুধু সময়টা বদলে গেছে। আগে যেত সকালে। সূর্য ওঠার পরে। আর এখন ফজরের আজান শুনে, নামাজ পড়েই আলোর আগমনী বার্তার আগেই ছুটে যায়।

চোখে ভোরবেলার হাটে তেমন কোনো ফারাক চোখে পড়ে না। শুধু মুখোশ আর আলো বাদে। আগে মানুষজন আলোতে হাটে আসত। খোলা মুখে। এখন আসে আঁধারে। মুখোশ পরে। এখনো সাধারণ মানুষজন মনের আনন্দে হাটে কেনাবেচা করে। দিনের আলো বাড়তেই সেখানে আসে অনেক বাধা। আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ, চৌকিদার আর আর্মির লোক আসে মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার বার্তা নিয়ে। হাটের ইজারাদার প্রতিনিয়ত মাইকিং করে। দূরে দূরে থাকার কথা বলে। পান হাটে সেটা কী করে সম্ভব! সেটা ভেবে রবিউল মাঝে মাঝে হাসে।

এরপর কাজে মন দেয়। ইদানীং বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রবিউলের শরীর কেমন নেতিয়ে আসে। ক্লান্ত লাগে। পান হাটে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা রবিউলের অবশ্য এতে খুব বেশি ভ্রƒক্ষেপ নেই। রোজগারের কথা বলতে গেলে তার আয় আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। করোনাকালেও তার ভাগ্য আরও সুপ্রসন্ন হয়েছে। তার সঙ্গে দূর থেকে এসে যারা কাজ করত তারা এখন আর আসে না। শ্রমিক সঙ্কটে পড়েছে পানের ব্যাপারি। উপায় না দেখে পানের ব্যাপারি রবিউলকে হাটে ঘুরে ঘুরে পান কেনার দায়িত্বও দেয়। সঙ্গে দেয় বাড়তি কিছু টাকার প্রস্তাব। লুফে নেয় অভাবে থাকা রবিউল। করোনার কঠিন সময়ে সবার অবস্থা যখন একেবারে বাজে যাচ্ছে, তখন সে রোজগার করছে ঢের। ভালোই যাচ্ছিল তার দিন।

আচমকা কয়েকদিন ধরে জ্বর আর কাশি বড্ড ভোগাচ্ছে তাকে। গত তিনদিন ধরে শ্বাসকষ্ট যোগ হয়েছে। স্ত্রীর কপালে এসেছে চিন্তার ছাপ। স্ত্রী আর তের বছরের জময দুই মেয়ে সারা রাত রবিউলের গলায়, গায়ে গরম তেল মালিশ করে। গ্রাম্য ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খাওয়ায়। কিন্তু কোনো কিছুতে কাজ হয় না। জ্বর থাকায় হাসপাতালে গিয়েও ঠাঁই হয়নি। চতুর্থ দিনের মাথায় স্ত্রীর বুকে মাথা রেখে মুরগির মতো ঝিমোতে ঝিমোতে মারা যায় রবিউল। চারদিকে খবর রটে- জ্বর, সর্দি-কাশি আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে একজন পান-শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় পত্রিকায় খবর হয়Ñ করোনা উপসর্গে শ্রমিকের মৃত্যু।

 
Electronic Paper