৫০০ বছরের পুরনো মসজিদ
মাহবুব আলম প্রিয়, রূপগঞ্জ
🕐 ৭:৩১ পূর্বাহ্ণ, জুন ০৩, ২০২০
মোগল স্থাপত্যের নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের শাহি মসজিদ। প্রায় সাড়ে পাচশ’ বছরের পুরনো এই মসজিদটির অবস্থান রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া বাজার ঘেঁষা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে। স্থানীয় প্রবীণদের দেওয়া তথ্য ও স্থানীয় ইতিহাস ও বইপত্র থেকে জানা যায়, ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের ইলিয়াস শাহি বংশের উত্তরাধিকার নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের ছেলে রুকনউদ্দিন বরবক শাহ আছিয়া খাতুনের পরগনা হিসেবে এ শীতলক্ষ্যা তীরের মুড়াপাড়া এলাকায় আসেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন জৌনপুরের শাসনকর্তা মাহমুদ শর্কী, মুসলমান সাহিত্যিক আমীর জয়েনউদ্দীন, আমীর শিহাবউদ্দীন কিরমানী, মনসুর সিরাজী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসু। তিনি এলাকাটি দেখে খুবই পছন্দ করেন।
পরে তিনি এ পরগনায় মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এরপর আছিয়া খাতুনের সঙ্গে আলোচনা করে মসজিদের কাজ শুরু করেন। মসজিদটি দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন ওই সময়কার তার পৃষ্ঠপোষক মুসলমান সাহিত্যিক আমীর জয়েনউদ্দিন, আমীর হাবউদ্দিন কিরমানী ও মনসুর সিরাজী। একপর্যায়ে জৌনপুরের শাসনকর্তা মাহমুদ শর্কী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসুকে নিয়ে বরবক শাহ তার রাজ্য গৌড়ে ফিরে যান। এরপর ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে বরবক শাহ পরলোক গমন করেন।
পরে জৌনপুরের মাহমুদ শর্কী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসুর মুখে পিতার মসজিদের অসমাপ্ত কাজের বর্ণণা শুনে বরবক শাহের পুত্র সামসুদ্দিন আবু মুজাফফর ইউসুফ শাহ মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করার তাগিদ দেন। ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে ইউসুফ শাহ দেহরক্ষী বাসুদেব বসুকে সঙ্গে নিয়ে আছিয়া খাতুনের পরগনায় ফিরেন। পরে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর বরবক শাহের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয় শাহী মসজিদ। একপর্যায়ে পরগনার ১৮ বিঘা জমি মসজিদের নামে দিয়ে দেওয়া হয়।
এসময় মসজিদের দায়িত্বভার আমীর জয়েনউদ্দিন হারাভী, আমীর শিহাবউদ্দিন ও মনসুর সিরাজীকে বুঝিয়ে দিয়ে ইউসুফ শাহ পৃষ্ঠপোষক বাসুদেব বসুকে নিয়ে তার রাজ্য উড়িষ্যায় ফিরে যান। বরবক শাহ’র আমলে চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জেও দুটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়।স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মোগল আমলের পতনের পরে ১৮৮৬ সালে ইংরেজ শাসনামলে তৎকালীন জমিদার জগদীশচন্দ্র বসু মসজিদটি মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলেন। পরে এর পাশেই জমিদাররা হিন্দুদের তীর্থস্থান তৈরি করেন।
এক পর্যায়ে মসজিদটি জঙ্গল দিয়ে ঢেকে যায়। এর চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যায়নি। স্থানীয়দের দেয়া তথ্যে আরো জানা যায়, ১৯২৫ সালের দিকে সাত ফুট উচ্চতা সম্পন্ন শমসের মিয়া নামে এক পথচারী একদিন এর পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি পাশ থেকে সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলওয়াত ও আজানের গায়েবী ধ্বনি শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ান। এ নিয়ে তার কৌতূহলও বেড়ে যায়। একদিন সে জঙ্গল পরিষ্কার করে ও মাটি খোদাই শুরু করে। পরে গম্বুজ দেখতে পেয়ে আশপাশের লোকজনকে ডেকে আনেন। কিন্তু তখন জমিদারদের ভয়ে অনেকে জবুথবু হয়ে থাকতো।
পরে শমসের মিয়া পরিষ্কার করে মিনারে দাঁড়িয়ে আজান দেন। এ সময় জমিদারদের নির্দেশে তাদের পাইক-পেয়েদা তাকে গুলি করে। পরে শমসের মিয়াকে পরগনার মালিক আছিয়া খাতুন ও মুসলমান তিন সাহিত্যিকের পাশেই দাফন করা হয়। এ নিয়ে কলকাতা আদালতে শমসের মিয়ার মা জমিলা খাতুন মামলাও দায়ের করেন। তবে এ পর্যন্ত প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের কারো পা পড়েনি এই স্থাপনায়। মসজিদ পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাপ-দাদাগো মুখে হুনছি এই মসজিদের বয়স সাড়ে ৫শ বছরের মতো। তবে এ মসজিদটি এখন মুড়াপাড়া বাজার পরিচালনা কমিটির অধীনে। কালের বিবর্তনে মানুষ বেশি হওয়াতে জামে মূল মসজিদের সামনে করা হয়েছে আলাদা টিনশেড বারান্দা।
এতে মূল সৌন্দর্য দেখতে অসুবিধা হচ্ছে বলে জানান দর্শনার্থীরা। ঐতিহাসিক এ মসজিদটির জমিও জবর দখলের অভিযোগ উঠেছে দীর্ঘদিন যাবৎ। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে দেনদরবার চলছে। তবে মসজিদের জমি রক্ষায় দেখভাল করছেন মুড়াপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ আলমাছ। নজরে রয়েছে উপজেলা প্রশাসনের। তবে ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মৃতিময় এ মসজিদটি রক্ষায় সরকারিভাবে আরও নিরাপদ নজরদারি রাখার দাবি এলাকাবাসীর।