সফল হতে ভালো রেজাল্ট মুখ্য নয়
ইমরান ইমন
🕐 ৭:০০ অপরাহ্ণ, জুন ০১, ২০২০
যারা আজ A+ পাওনি বলে হা হুতাশ করছ, অমুকে পেয়েছে আমি কেন পেলাম না! অমুক তমুকের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে নিজেকে অযোগ্য ভাবছ, কেউ কেউ আবার অতি আবেগপ্রবণ হয়ে আত্মহত্যার মতো মহাপাপের সিদ্ধান্ত নিচ্ছ। তাদের জন্য বলি, জীবনে সফল হতে A+ মুখ্য নয়। একটা পাবলিক পরীক্ষায়ও A+ না পেয়ে তুমি জীবনে সফল মানুষদের কাতারে নিজের নাম লেখাতে পারবে। তোমার ভেতরে কী আছে, কতটুকু তুমি অর্জন করেছ সেটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং দিন শেষে সেটাই তোমাকে সফলতার চূড়ায় নিয়ে যাবে।
কেবল দুই একটা পরীক্ষার রেজাল্ট তোমার জীবন নির্ধারণ করতে পারে না। পৃথিবীতে যারা আজ সফলতার চূড়ায় আরোহণ করেছেন তাদের জীবনী অনুসন্ধান করে দেখো, তাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল ব্যর্থতা আর গ্লানিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু দিন শেষে তারা সফল।
কেননা তারা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে ছিল নিজের প্রতি প্রচ- বিশ্বাস, ছিল কাজের প্রতি ভালোবাসা, সততা ও নিষ্ঠা। যারা নিজেকে চিনে নিতে পেরেছে, যাদের রয়েছে নিজের প্রতি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস, সেই সঙ্গে রয়েছে সততা ও নিষ্ঠা দিন শেষে তারা সফলতা ছিনিয়ে আনবেই।
তোমার নিজের প্রতি যদি নিজের আত্মবিশ্বাস থাকে, কাজকে যদি তুমি ভালোবাসতে পারো, তোমার নিজের মধ্যে যদি সততা থাকে তাহলে বিশ্বাস করো পৃথিবীতে তোমাকে আর কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। দিন শেষে তুমি সফলতার চূড়ায় পৌঁছে যাবেই।
নিজের কথাই বলি, আমার কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসি কোনটাতেই A+ ছিল না। A+ পেতে পেতেই পাওয়া হল না। আমার প্রতি আমার শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার আশা-আকাক্সক্ষা ছিল মাস্ট বি A+ পাব। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমার A+ জোটেনি। কিন্তু A+ না পাওয়াতে আমার কোনো আক্ষেপ ছিল না, বিন্দুমাত্রও হতাশ হইনি।
পরীক্ষার রেজাল্টের পর আমাকে নিয়ে অনেকেই অনেক বিরূপ মন্তব্য, নেতিবাচক সমালোচনা করেছে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে সেসব হজম করেছি। অনেক দিন লুকিয়ে লুকিয়ে বাথরুমে ঢুকে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে কান্না করেছি। আত্মচিৎকার করেছি গড়িয়ে পড়া পানির সঙ্গে।
তবুও হতাশ হইনি, দমিয়ে যাইনি। বরং হতাশাকে হতাশ করে দিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে শপথ করেছি, সফল? আমি হবোই। নিজের প্রতি ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। নিজেকে চিনে নিয়েছি আসলে আমি কে! কতটুকু যোগ্যতা আমার রয়েছে। আমি জানতাম, আমি পারবই, আমি সফল হবোই। হ্যাঁ, আমি এখন সফল?। নিজের একনিষ্ঠতা, পরিশ্রম, সততা দিয়ে এক এক করে সব স্বপ্ন পূরণ করে নিচ্ছি।
আমার প্রতি যাদের বিশ্বাস ছিল, আশা আকাক্সক্ষা ছিল সেসব মানুষকে হতাশ করিনি। কম সিজিপিএ নিয়ে, সমালোচনার তুমুল ঝড় ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মতো স্নায়ুযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মেধাবীকে ডিঙিয়ে, শীর্ষ স্থান দখল করে আমি এখন দেশের স্বায়ত্তশাসিত শীর্ষ একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, শীর্ষ একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করছি।
শুধু একাডেমিক পড়াশোনার গণ্ডিতে আমার জীবন সীমাবদ্ধ নয়। স্কুল জীবন থেকেই আমি একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে সব ধরনের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজে দাপিয়ে বেড়িয়েছি। এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক সংগঠনের সঙ্গে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি ।
লেখালেখি করে যাচ্ছি আপন গতিতে। কখনো সাহিত্য, কখনো সমাজ, কখন বা দেশকে রাঙিয়ে তুলতে চেষ্টা করি লেখায়। দেশের শীর্ষ জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আমার লেখা হয় টপ অব দ্য কলাম। সম্পাদকরা যখন বলেন, তুমি বেশ ভালো লেখো, লেখার মান খুব ভালো। লেখালেখি চালিয়ে যাও, অনেক বড় হতে পারবে। এসব শুনে আমি উল্লাসিত হই না, অভিভূত হই। জীবনের সার্থকতা এখানেই। এক জীবনে চাইলে মানুষ অনেক কিছু হতে পারে। দরকার শুধু কাজের প্রতি ভালোবাসা, সততা, একনিষ্ঠ পরিশ্রম আর লেগে থাকা।
আমার A+ বিহীন অনেক বন্ধু-বান্ধব এখন দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভালো সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করছে। কই A+ এর অভাবে বা A+ না পাওয়াতে তাদের জীবন তো থেমে থাকেনি?! দেখা গেছে, এমন ভুরি ভুরি A+ পাওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই কোথাও চান্স পায়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চান্স পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই এসএসসি ও এইচএসসি কোনোটাতেই A+ থাকে না।
জীবনে সফলতার চূড়ায় আরোহণ করতে হলে, সফলতার ছোঁয়া পেতে হলে A+ মুখ্য বিষয় নয়। সামান্য দুই এক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে একজন মানুষকে কখনোই বিচার করা যায় না। তার সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের অভিভাবকরা মেনে নিতে চায় না এ অমোঘ বাস্তবতা। তারা শিক্ষার্থীদের অমুক তমুকের সঙ্গে তুলনা করে, রেজাল্ট নিয়ে মানসিক চাপের মুখে রাখে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী ঘুরে দাঁড়ানোর মনোবল হারিয়ে ফেলে। কেউ কেউ জীবনের মায়া হারিয়ে ফেলে চরম হতাশার অন্ধকারে ডুবে থাকে, বেছে নেয় আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপের পথ।
আপনি একজন মা/বাবা? আপনার ছেলেমেয়ে তো আপনারই DNA! ওরা সায়েন্টিফিক্যালি আপনারই। কিন্তু যখন তাদের বলেন, ‘তোরে দিয়ে কিচ্ছু হবে না!’ অজান্তেই You are destroying your DNA!
অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ, সামান্য দুই এক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে ছেলেমেয়েদের বিচার করবেন না, তাদের সুযোগ দিন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আপনি বিশ্বাসও করতে পারবেন না আপনার সন্তানের মাঝে হয়তো লুকিয়ে আছে আইনস্টাইন, নিউটন, শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও হুমায়ূন।
কোনো মানুষই অযোগ্য নয়। প্রতিটা মানুষই এক একটা হীরার খনি। দরকার শুধু সে খনি থেকে মণি মুক্তা বের করে আনার। প্রতিটা মানুষই আলাদা বিশেষ গুণে গুণান্বিত। তাই নিজেকে চিনে, নিজের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আপন পথে দৌড়াও। কেউ তোমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। সফলতার পর্বত একদিন তুমি ছোঁবেই।
ইমরান ইমন : শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়