ড. আনিসুজ্জামান : একটি জ্যোতিষ্কের পতন
সাইফুজ্জামান
🕐 ৬:৪২ অপরাহ্ণ, মে ২৯, ২০২০
তিনি ছিলেন তারকা বুদ্ধিজীবী। এ শহরের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি অনিবার্য ছিল। পৌরহিত্য কিংবা প্রধান আতিথ্য তাকে গ্রহণ করতে হত। মূল কথা বলতেন অল্প শব্দে, বাক্যে কিন্তু বিস্তৃত তথ্য ও ব্যাখ্যায় ভরপুর থাকত। একাধিক অনুষ্ঠানে তাকে উপস্থিত থাকতে হত। যত ব্যস্ততা থাকুক না কেন তিনি কাউকে না বলতেন না। তার বিনয় ছিল অফুরান। আমরা সাধারণত দেখি সমাজের একটি পর্যায়ে পৌঁছে মানুষ কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়।
এক ধরনের অহংকার পেয়ে বসে। চারপাশের মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা থেকে শুরু করে এড়িয়ে চলা পর্যন্ত কাজ তারা করে। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। ভিআইপি হয়েও ছিলেন সাধারণের জন্য উন্মুক্ত। তাকে কেউ সময়ের পরে কোনো অনুষ্ঠানে যেতে দেখেনি। সময়ের আগে তিনি অনুষ্ঠানে পৌঁছাতেন। তার উপস্থিতি যে কোনো অনুষ্ঠানকে আলোময় করে তুলত। সবাই চাইত তার সান্নিধ্য। তিনি ছিলেন বাতিঘর। চারপাশের অন্ধকারকে উপস্থিতি দিয়ে ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় জীবন্ত করার জাদুকাঠিটি তার হাতে ছিল। অসুস্থতা, ব্যস্ততার ভান ছিল না।
অথচ তিনি ছিলেন ব্যস্ত মানুষ। শেষের দিকে শরীর ভালো যাচ্ছিল না। কত অনায়াসে তরুণ লেখকদের বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। অকুণ্ঠ প্রশংসায় শুধরে নেওয়ার, নতুন সৃষ্টির প্রেরণা দিয়েছেন, তার শেষ নেই। অটোগ্রাফ শিকারি, সেলফি তোলার জন্য ভিড় করা মানুষদের সব আবদার হাসি মুখে মেনে নিয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক অনাচার, নারী-শিশুর অধিকার বঞ্চনা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিরোধ এবং মুক্ত চিন্তার বাধা দূর করার জন্য তাকে রাজপথে, জনতার কাতারে দেখা গেছে।
আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি, ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনার বসিরহাটে, ১৯৩৭। পিতা এটিএম মোয়াজ্জেম (হোমিও চিকিৎসক) মা সৈয়দা খাতুন। পিতামহ সাংবাদিক, সাহিত্যিক শেখ রহিম তার মানস গঠনে প্রভাব বিস্তার করেন। পারিবারিক পর্যায়ে ছিল সাহিত্যচর্চার অনুকূল পরিবেশ। ভাই-বোনদের অনেকে লিখতেন। কলকাতার পার্কসার্কাসের হাই স্কুলে তার প্রথম পাঠ। দেশভাগের পর এ অঞ্চলে আনিসুজ্জামানের পরিবার চলে আসে। খুলনার জিলা স্কুলে তারপর এক বছরের পড়াশোনা। পাড়ি দেন ঢাকায়।
১৯৫১-তে প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৫৩-এ জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬-তে বিএ সম্মান ও ১৯৫৭-এ এমএ প্রথম ডিগ্রিতে প্রথম হন। রেজাল্ট দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তার শিক্ষকরা। তিনি বহুভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও মুনীর চৌধুরীর স্নেহধন্য ছিলেন। ১৯৫৮-তে তিনি বাংলা একাডেমি বৃত্তি পান। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডির বিষয় ছিল ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তা ধারা (১৯৫৭-১৯৫৮)। আনিসুজ্জামান ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। সরকারের গবেষণা বৃত্তি নিয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। তার পোস্ট ডক্টরেটের বিষয় ছিল উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস : ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল। ১৯৬৯-এ দেশে ফিরে এসে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে রিডার হিসেবে যোগ দিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি জীবনে আসে এক স্মরণীয় ক্ষণ। পাকিস্তান আর্মির আক্রমণ ও হত্যায় ক্ষুব্ধ বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। ড. আনিসুজ্জামান ভারত গমন করেন। শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। অস্থায়ী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫-এ তিনি লন্ডনে কমনওয়েলথ একাডেমি ফেলো স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। ১৯৭৮-৮৩-তে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত থাকেন। ১৯৮৫-তে আনিসুজ্জামান পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ফিরে আসেন। ২০০৩-এ অবসর গ্রহণ করেন। তিনি সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
দিনে দিনে ড. আনিসুজ্জামান সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন। তার গবেষণা থেমে থাকেনি। উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্র (১৯৬৯), মুনীর চৌধুরী (১৯৭৫), স্বরূপের সন্ধানে (১৯৭৬), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), পুরনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯৮৮),আমার একাত্তর (১৯৯৭), মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর (১৯৯৮), আমার চোখে (১৯৯৯), বিপুলা পৃথিবী, বাঙালি সাহিত্যে ও সমাজে, পূর্বগামী (২০০১), কাল নিরবধি (২০০৩) ইত্যাদি। আনিসুজ্জামান বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় সব কটি পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে আছে নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৬), দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৮৫), আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৩), ডিলিট ডিগ্রি, রবীন্দ্র ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (২০০৫),পদ্মভূষণ পদক (২০১৪), স্বাধীনতা পদক (২০১৫)।
ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন সবার শিক্ষক। তার মতো একজন গুণী মানুষের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে মহীরুহ। তার ছায়ায় বহু মানুষ আলোকিত হয়েছে। গবেষণা কর্মে উৎসাহ প্রদানে ছিলেন অনন্য। সাহিত্য, সাংস্কৃতিক জাগরণে ছিলেন বাতিঘর। ব্যবহার, অতিথি আপ্যায়নে তার আন্তরিকতা সবাইকে স্পর্শ করত। আমরা কোথাও আর তাকে দেখব না। আনিসুজ্জামান আমাদের স্মৃতিতে, স্মরণে চির জাগরুক থাকবেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।
সাইফুজ্জামান : প্রাবন্ধিক, কবি; উপকীপার, জাতীয় জাদুঘর