ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

উৎসববিহীন ঈদ

আরাফাত শাহীন
🕐 ৬:১২ অপরাহ্ণ, মে ২২, ২০২০

ঈদ শব্দটি শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে চারিদিকে আনন্দঘন একটি পরিবেশ। সবাই নতুন নতুন পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে ঈদের মাঠে যায় এবং সমাজের সকল মানুষ মিলেমিশে বুকে বুক মিলিয়ে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পথ প্রশস্ত করে তোলে। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, ঈদের সময়টাতে যে যেখানে অবস্থান করুক না কেন, ঠিকই সময়মতো বাড়িতে পৌঁছে যান।

বাড়িতে পুরো পরিবার অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে কাক্সিক্ষত ব্যক্তিটি যখন এসে পৌঁছান, তখন আনন্দের হাওয়া বয়ে যায়। সেই হাওয়াতে কত দিনের জমে থাকা বিষাদ যে নিমিষে বাষ্প হয়ে উড়ে যায় তার কোনো ঠিক নেই। আমাদের মুসলিম জীবনে বছরে মাত্র দুইটা ঈদ আসে। ফলে আমাদের অপেক্ষার পালা যেমন দীর্ঘ হয় তেমনি তাতে আনন্দের মাত্রাও থাকে অনেক বেশি।

কিন্তু ভাগ্য যখন আমাদের নিয়ে নির্মম পরিহাস শুরু করে তখন কী হয় একবার ভেবে দেখুন তো! সমস্ত আনন্দ-উত্তেজনা বিষাদে পরিণত হতে মোটেও সময় লাগে না। এবারের ব্যাপারটিই ধরুন। আমরা সারা বছর যে মানুষগুলোর প্রতীক্ষায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকি, তারা প্রায় সবাই ঈদের সময়টাতে বাড়িতে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ তো দীর্ঘ দুই মাস বাড়িতে এসে বসে রয়েছেন।

স্বভাবতই এবার সকলের একত্রিত হয়ে দেখা করার এবং আনন্দ উপভোগ করার সবচেয়ে বেশি সুযোগ ছিল। কিন্তু  কপাল খারাপ হলে যা হয়ে থাকে তা মোটেও সুখকর নয়। করোনাভাইরাস আনন্দকে গলা টিপে হত্যা করে সেখানে দীর্ঘ বিষাদের ছায়া লেপ্টে দিয়েছে। ঈদের মাঠে গিয়ে নামাজে শরিক হতে পারছি না; পরস্পরের বুকে বুক মিলিয়ে ‘কেমন আছো?’ প্রশ্নটাও করতে পারছি না। রমজানে রোজা পালন করে প্রত্যেকের চেহারায় যে মলিন আভা পড়ে, ঈদের দিনে মাত্র দুই রাকাত নামাজ আদায় করে তার সবটুকু দূর হয়ে যায়।

কিন্তু এবার আর সে সুযোগ কোথায়! আমরা ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, ঈদ মানে আনন্দ। নির্মম হলেও সত্য, এখন লেশমাত্রও দেখতে পাচ্ছি না। পুরো পৃথিবীটাই অশান্তির কারখানায় পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মারাত্মক ধস নামার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমাজের নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের হাতে অর্থ নেই। অথচ ঘরে অর্থের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। ঘরে ঘরে এখন খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। জানি না এই অবস্থা কতদিন স্থায়ী হবে। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাই।

আমি বাড়িতে এসেছি দুই মাসের বেশি হয়ে গেল। সাধারণত ছুটি পেয়ে বাড়ি আসতে পারলে মনটা ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম ব্যাপার ঘটেছে। মানুষ আসলে একটানা কিছুই করতে পারে না; মাঝেমধ্যে বিরতি দেওয়া প্রয়োজন। ছুটি এমনিতে ভালো। কিন্তু এভাবে একটানা কোনো কাজ না করে বসে থাকাটা সত্যিই কষ্টকর। গ্রামে এতদিন থাকার ফলে অবশ্য একটা উপকার হয়েছে। মানুষকে খুব কাছে থেকে অনুভব করার সুযোগ পাচ্ছি। ঢাকা শহর ফাঁকা করে দিয়ে বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে ফিরে এসেছেন। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী সবাই বাড়িতে এসে বেকার বসে রয়েছেন। তাদের ভেতর অদ্ভুত একটা অস্থিরতা দেখতে পেয়েছি। সারা বছর নিরলস পরিশ্রম করতে করতে যে মানুষগুলো অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তারা হঠাৎ করে পাওয়া এত বড় ছুটিটা মেনে নিতে পারছেন না। তাছাড়া যে মানুষগুলো দৈনিক চুক্তিতে কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাদের ঘরে অর্থের জোগান নেই। ফলে প্রত্যেকেই একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে।

কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি ছবি আমার মনকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে; চোখকে অশ্রুসিক্ত করেছে। ছবিতে দেখেছি, সিরিয়ার একটি পরিবার ধ্বংসস্তূপে বসে ইফতার সম্পন্ন করছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে যুদ্ধবিগ্রহের তেমন কোনো সংবাদ পাচ্ছিলাম না বহুদিন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর দিকে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুদ্ধের আগুন এখনও নেভেনি; হয়ত কোনোদিন নিভবেও না।

লিবিয়াতে বোমার আঘাতে বাংলাদেশি এক শিশু নিহত হয়েছে এবং তার পুরো পরিবার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন যে দেশগুলোতে যুদ্ধের দাবানল জ্বলছে এই ঈদ কীভাবে তাদের জন্য স্বস্তি ও শান্তির বার্তা বয়ে নিয়ে আসতে পারে? একদিকে করোনাভাইরাস বিপর্যস্ত করে চলেছে অপরদিকে বিশ্বের কোটি কোটি মানবসন্তান ক্ষমতার কাছে বলি হয়ে যাচ্ছে। আমরাও খুব একটা শান্তিতে নেই। বরং বিশ্বের বাকি অংশের চেয়ে অশান্তি কোনো অংশেই কম নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম প্রতিনিয়ত হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। নিম্নআয়ের মানুষ নিদারুণ কষ্টে দিন অতিবাহিত করছে। করোনা আঘাত হানার পর একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর জন্ম হয়েছে।

তারা জনগণকে চুষে খেয়ে ফেলছে। করোনার কারণে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে বহু মানুষ। ফলে পরিবারের কাছাকাছি অবস্থান করার পরও তাদের মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। সন্তানসন্ততিকে চাহিদামতো জিনিসপত্র কিনে দিতে না পারার মতো কষ্ট আর কিছুতেই নেই। অনেক সন্তান এবার বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না। এই ব্যর্থতার দরুন তাদের মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেছে। সরকারের তরফ থেকে কয়েকদিনের জন্য লকডাউন শিথিল করার পর দেখেছি রাস্তায় মানুষের সে কী হুড়োহুড়ি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। যেখানে করোনার মোকাবেলা করে আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনার কথা ছিল, সেখানে হুট করে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।

শুধু তাই নয়, মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। এই মৃত্যু ও আর্তনাদের ভেতর আমরা কীভাবে ভালো থাকতে পারি? কয়েকদিন শহর থেকে গ্রাম অভিমুখী মানুষের ঢল কম ছিল। কিন্তু ঈদকে সামনে রেখে মানবঢল আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গ্রামে দ্রুত করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে ঈদের আনন্দ যে শতভাগ মাটি হয়ে যাবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগে কখনো এমন কবরের মতো নীরবতা দেখতে পাইনি। আমাদের জীবদ্দশায় করোনার মতো এমন ভয়াবহ মহামারি দেখা দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ এমনিতেই বেশ আমোদপ্রিয়। আমরা বহু সমস্যায় জর্জরিত থেকেও আমোদে চলতে ভালোবাসি।

যদি বিশেষ কোনো উপলক্ষ পাওয়া যায় তাহলে আনন্দের কোনো সীমা থাকে না। চায়ের দোকানগুলোতে সবসময় মেলা লেগে থাকে, বাজারগুলো থাকে লোকে লোকারণ্য, খেলার মাঠ মুখরিত থাকে ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে। ঘাতক করোনা আসার পর সবকিছু কেমন স্থবির হয়ে পড়েছে; মানুষ কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ঈদের মতো উপলক্ষও তেমন দোলা দিতে পারছে না। আর মানুষের মন যদি একবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাকে পুনরায় চাঙ্গা করে তোলা কষ্টসাধ্য। ঈদের সময়টাতে আত্মীয়ের বাড়িতে দল বেঁধে বেড়াতে যাওয়া পুরনো রীতি। সবাই এটা দারুণভাবে উপভোগ করি। কিন্তু এবার তো সেই উপায়ও নেই! এভাবে আমরা যখন একপ্রকার গৃহবন্দি অবস্থায় ঈদের আনন্দ উপভোগ করার চিন্তা করি, তখন স্বভাবতই মনটা বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখন একমাত্র চাওয়া, সামনের কোরবানির ঈদটা যেন পরিপূর্ণ আনন্দের সঙ্গে সবাই মিলে উপভোগ করতে পারি। জানি না, ভাগ্য আগামীতে কী উপহার নিয়ে বসে রয়েছে।

আরাফাত শাহীন : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

 
Electronic Paper