ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বারবার আলোচনায় কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া

অরিত্র দাস
🕐 ৫:৪৯ অপরাহ্ণ, মে ০৭, ২০২০

কূল জোড়া জল, বুক ভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ার সাথে তার তন্দ্রা ভাঙে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়, রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াতে বসে কিন্তু পারে না। Ñবলছিলাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস থেকে।

কথাসাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ নদীকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবনপ্রবাহ বর্ণনা করতে গিয়ে এ কথাগুলোই বলেছিলেন। যে নদী এত সুন্দর, এত কর্মদীপ্ত চঞ্চল, সে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা জনপদও নিশ্চয়ই সুন্দর ও কর্মপ্রিয়। নদীর মত নমনীয়, উদার ও সংগ্রামী তাদের জীবন প্রবাহ। বাস্তবিক অর্থেও তাই ছিল। হ্যাঁ ছিল, এখন আর তা তেমন নেই। হারিয়ে যেতে বসেছে। যেমন করে হারিয়ে যেতে বসেছে তিতাসের পাড়ে অবস্থিত স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা উল্লাস কর দত্ত ও সুরের জাদুকর ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হারিয়ে গিয়ে হয়েছে বি-বাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম উচ্চারণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না প্রতিক্রিয়াশীলরা। তাই বি-বাড়িয়া। ফলে বাধ্য হয়ে ২০১১ সালে ‘বি-বাড়িয়া’ বলাকে আইনগত নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে প্রজ্ঞাপন জারি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন। তিতাস চলে যাচ্ছে দখলদারিদের কবলে আর পাড়ের জনগণ চলে যাচ্ছে অশিক্ষার অতল গর্ভে। রেখে যাচ্ছে কেবল অতীত গৌরবোজ্জ্বল চিহ্ন।

এই সময়ে অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা অসহিষ্ণু জেলা হয়ে উঠেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। অন্য জেলাগুলোতে যে অসহিষ্ণুতা নেই, তা নয়। আছে, কিন্তু তা মাথাচাড়া দিয়ে এখনো ওঠেনি। বর্ষার পানি যখন পুকুরের ধারণ ক্ষমতার বেশি হয়, তখন তা চারপাশের সকল কিছুকে ভাসিয়ে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবস্থাও হয়েছে ঠিক তাই। সহিংসতায় প্লাবিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া দেশভাগের পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যেও একটি মহকুমা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারত ভাগের পর কুমিল্লা জেলার একটি মহকুমা হিসাবে পরিচিতি পায়। অতঃপর খ-িত সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বেরিয়ে আসার পর আশির দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জেলায় উন্নতি করা হয়।

মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত হওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া দেখিয়েছে কিভাবে একটি জেলা সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প, বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি ও দেশপ্রেমে অবদান রাখতে পারে। কীভাবে এখানের সন্তানরা দেশমাতৃকার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছে বহুবার। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে ভাষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ সকল ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবদান ও অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। বাংলা ভাষার দাবি প্রথম উত্থাপন করেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। যাকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা করে পাকিস্তানের সেনারা।

ভাষাসৈনিক অলি আহাদ, রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস মাখন, মলয়া সঙ্গীতের পথিকৃৎ মনমোহন দত্ত, ঔপন্যাসিক হাসনাত আব্দুল হাইসহ আরো অনেকে জন্মেছেন এখানে। সকলের নাম লিখতে গেলে একটা প্রবন্ধ জুড়ে তাদের নামই লিখতে হয় শুধু।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম পুতুল নাচের উপস্থাপক এখানকার বিপিন পাল। এখানে রয়েছে তিতাস গ্যাস ফিল্ড, আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, আশুগঞ্জ সার কারখানা ও দুটি আন্তর্জাতিক বন্দর। এ থেকে প্রতীয়মান, সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ ধর্ম বলতে বুঝবেÑ মানুষ মানুষের জন্য। জীবন বলতে বুঝবেÑ শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িকতা ও দেশপ্রেম। কর্ম বলতে বুঝবেÑ উৎপাদন ও ফসলের সুষম বণ্টন। আর তীর্থ বলতে বুঝবেÑ সঙ্গীত, পরিশ্রম ও সাধনার সমন্বয় ঘটেছে যেখানে সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাদা মাটি। অথচ সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া কি করে বিপথগামী হয়ে উঠল? কেন সমৃদ্ধির পথে না হেঁটে উল্টোমুখী যাত্রা? কেনইবা এত শত্রুতা? কেন ধান কাটা নিয়ে মারামারি, লুডু খেলা নিয়ে মারামারি, খুনাখুনি, ধর্ষণ, হিংস্রতা একটার পর একটা লেগেই আছে?

১৯৮৭ সালে ভাদুঘর গ্রামে রিজভী-ওহাবি সংঘর্ষ হয়। তখন গ্রামের অনেকগুলো বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার নিদারাবাদ গ্রামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শশাঙ্ক দেবনাথ, তার স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে সম্পত্তির লোভে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলায় হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুর, মারধর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। ২০১৮ সালে বাউল শিল্পী শামসুল হক চিশতির ওপর হামলা চালিয়ে মঞ্চ, মাইক ও গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ২০১৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ আয়োজিত মহান বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর। ২০২০ সালের ঘটনা তো বলে শেষ করা যাবে না। চলছে তো চলছেই। সম্প্রতি এলাকায় গ্রাম্য আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের দু’পক্ষের সংঘর্ষ, এক পক্ষ আরেক পক্ষের পা কেটে নিয়ে জয় বাংলা ধ্বনিতে বিজয় মিছিল করে। যা দেশের সচেতন সুস্থ নাগরিকদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে।

এছাড়া নাসিরনগরে ধান মাড়াই নিয়ে দু’পক্ষের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষ। আহত অর্ধশত। এমনকি ঈদের নামাজের জামাতে বসা নিয়েও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে এখানে। মানুষের এই অন্ধত্ব, মানুষের এই ধৃষ্টতা, মানুষের এই অবিমৃষ্যকারিতা, মানুষের এই উগ্রতা, এই অধঃপতনের প্রবণতা দেখেও ক্লান্ত সংকুচিত তিতাস বয়ে চলে। তিতাসের যদি কথা বলার সুযোগ থাকত, তবে সে অবশ্যই চিৎকার করে বলত- আমি আর বইতে পারছি না।

অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলা সংঘর্ষ-সংঘাতের আরেক নাম। মুহূর্তে মুহূর্তে সরাইলের জনপথ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে শুরু হয় এই সংঘর্ষ। বছরের পর বছর চলতে থাকা এই সংঘাত যেন এখন তাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কারো হাত ঢাল-সুড়কি, কারো হাতে টেঁটা-বল্লম, কারো হাতে দেশীয় অস্ত্র, কারো হাতে গুলতি কিংবা লাঠিসোটা নিয়ে পরস্পরের প্রতি ধেয়ে যায়। ইট, কাটা মুলি বাঁশ, তীর-ধনুকও ব্যবহার হয় এখানে। নারীরাও মরিচের গুড়া সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে।

কেউ খুন হয়, কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করে আজীবনের জন্য। রক্ষা পায় না শিশুও। মৃত্যু এখানে দুধভাত। মনুষ্যত্ব এখানে দুর্লভ। আধিপত্য বিস্তার, ফল পাড়া, খড় শুকাতে দেওয়া, জায়গা নিয়ে বিরোধ, রান্নার ধোয়া অন্য বাড়িতে যাওয়া, পূর্ব শত্রুতা, সিডি-ক্যাসেট বাকিতে না দেওয়া, কানের দুল চুরি, নারী ও প্রেমঘটিত ঘটনার মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংঘর্ষ সরাইলে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

মানুষের যখন অধঃপতন ঘনিয়ে আসে, তখন তারা বিপথগামী হয়ে ওঠে। বারবার ভুল করতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় লকডাউনের মধ্যে সরাইলের এক ধর্মীয় নেতা মাওলানা জোবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজায় লাখো মানুষ জমায়েত হয়েছে। বিশ্বে করোনাভাইরাসে মৃত্যুহারের দিক থেকে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছুঁই ছুঁই। সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা শরিফ বন্ধ রয়েছে। সেই পরিপ্রক্ষিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লাখো মানুষ কী করে অজ্ঞতার পরিচয় দিল? ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী হয়েছিলেন এই মাওলানা জোবায়ের আহমেদ আনসারী। ওই আসনে তখন মোট ভোট ছিল এক লাখ ২১ হাজার ১০৫টি, প্রদত্ত ভোট ৯১ হাজার ৫৫৬। মিনার মার্কা নিয়ে নির্বাচন করে ১৬৬৮ ভোটের বেশি পাননি তিনি।

কেননা যে সরকারই আসুক ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে তারা উপেক্ষা করেছে। ভোটের রাজনীতির জন্য সমস্ত হঠকারিতা প্রশ্রয় দিয়েছে। পাশাপাশি সমাজ সংস্কারক, বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল নেতারা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পর্যাপ্ত গুরুত্বারোপ করেনি। যার কারণে একের পর এক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরেও পার পেয়ে গেছে কুচক্রীরা। দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি, গুটি কয়েক গ্রেফতার আর প্রশাসনের কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার ছাড়া। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শিক্ষার হার চল্লিশ শতাংশের ঘরে পড়ে আছে। এমনকি সরাইলে শিক্ষার হার মাত্র সাঁইত্রিশ শতাংশ। ফলে সেখানে সিংহভাগ জনগণের মধ্যে বছরের পর বছর কুসংস্কার, সংকীর্ণতা, নির্বুদ্ধিতা, কপটতা, অহমিকার চর্চাই বেশি হয়েছে। তাই অস্বীকার করার জো নেই, আজকের এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া একদিনের নয়। বহুদিনের অপচর্চার ফসল।

অরিত্র দাস : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper