ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পেঙ্গুলিন

আহমেদ শরীফ শুভ
🕐 ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২৪, ২০২০

আসিফ, অথবা পেঙ্গুলিন কোনো রকমে গড়িয়ে গড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে থাকে। মাঝামাঝি নেমে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। নাদিরা তখনো শক্ত করে ঈশিতাকে ধরে আছে। ওদের দুজনের চোখেই রাজ্যের ভীতি। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। নাদিরার চোখে জল, ঈশিতারও। ভয়ের না কষ্টের আসিফ, অথবা পেঙ্গুলিন বুঝতে পারে না। তার ভীষণ মায়া হয়। কান্না পায়। কিন্তু পেঙ্গুলিন অশ্রুপাত করতে পারে না।

কিছুক্ষণ পেছন ফিরে দাঁড়ানোর পর আবার মাথা নিচু করে নিচে নামতে থাকে। নিচতলায় নেমে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেই বাসার পেছনে পুরনো এক ডোবা, তারপর ঘন ঝোপ। আপাতত সেখানেই গন্তব্য। এর বেশি তেমন কিছু ভাবেনি সে। শুক্রবার সকালটায় একটু আয়েস করে ঘুমায় আসিফ। অন কলে থাকলে হয়ত হাসপাতাল থেকে দু’একবার ফোন আসে। কিন্তু যেতে হয় না তেমন। ফোনেই জুনিয়র ডাক্তারদের পরামর্শ দিতে পারে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে হাসপাতালে চাপ বেড়েছে। আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগী আছে ১১ জন, আইসিইউতে ৩ জন। তাই ফোনও একটু বেশি আসে। তবে আজ এখনো আসেনি। তাই আয়েসের ঘুমেও তেমন ব্যঘাত নেই। আসিফ কি তাহলে নিজের বাসায় ঘুমাচ্ছে? আইসোলেশনের রোগী দেখে বাসায় ফিরতে পারে? নিজেই ভাবতে থাকে।

নাদিরা প্রতিদিনের মতোই ঘুম থেকে উঠে যায় ভোরে। ঈশিতাকে ডাকে না। শুক্রবার সকালে মেয়েটা উঠেই বা কী করবে! করোনার ভয়ে কাজের মেয়েকে আগাম বেতন দিয়ে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। নিজেই নাস্তা সাজাতে থাকে। আজকের মেন্যু পরোটা, আলু ভাজি, ডিমের ওমলেট আর বুটের ডাল। আসিফ ডিম পছন্দ করে না। কিন্তু নাদিরা জানে, গত রাতের ঝড়ের পর আসিফের অন্তত দু’টা ডিম খাওয়া উচিত। ক্ষতিটুকু পুষিয়ে নিতে হবে না! এক্কেবারে পশু একটা। নাস্তা রেডি করে আসিফকে ডাকতে আসে সে। আসিফ তখনো অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

দু’একট ঝাঁকুনি দিতেই আসিফের ঘুম ভেঙে যায়। গায়ের ওপর রাখা হালকা চাদরটা সরাতে গিয়ে আসিফ টের পায় ওর শরীর কেমন যেন হালকা হয়ে উঠছে, কিন্তু নড়তে পারছে না। হাত-পাগুলো কেমন যেন বাঁকা হয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ছোট হয়ে আসছে সারা শরীর, মেরুদ-ের গোড়া থেকে কী যেন একটা বের হয়ে লম্বালম্বি নিচে নামছে। আসিফের উঠতে দেরি দেখে চাদরটা টান দিয়ে সরাতে গিয়ে নাদিরার মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। ততক্ষণে তার রূপান্তর পূর্ণ হয়ে গেছে। নাদিরা ‘পেঙ্গুলিন...’ বলে অস্ফুট আর্তনাদ করে ছিটকে যায়। এর পরের কয়েক মিনিটের কথা আসিফ আর মনে করতে পারে না।

অদ্ভুত জীবটিকে আগে কখনো দেখা দূরের কথা, নামও শোনেনি নাদিরা। দুনিয়াময় করোনার রাজত্বকালেই প্রথম শুনেছে আসিফের কাছে। চীনের এই প্রাণীই নাকি করোনাভাইরাসের বাদুড় এবং মানুষের মধ্যবর্তী বাহক। আসিফ নেট ঘেঁটে ছবি দেখিয়েছে। কী বিচ্ছিরি! চীনারা তাহলে এগুলোও খায়! ওয়াক! সংবিত ফিরে পেয়ে আসিফ নিজেকে আবিষ্কার করে মেঝেতে, পুরোপুরি একটি পেঙ্গুলিন হিসেবে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। নাদিরা কোনো রকমে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিংবা দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। সে জিভ বের করে নাদিরাকে বলতে চায়, ‘আমি তো তোমারই আসিফ। করোনায় মারা যেতে পারতাম। তা না হয়ে পেঙ্গুলিন হয়ে গেলাম। তবুও তো বেঁচে রইলাম তোমাদের মাঝে। আমি কোনো ক্ষতি করব না। খাটের নিচে চুপচাপ শুয়ে থাকব যতদিন বাঁচি। তবুও তো কাছাকাছি থাকা হবে। ক্ষিদে পেলে খাবার দিয়ে যেও মাঝে মধ্যে। নেট থেকে দেখে নিও পেঙ্গুলিনরা কী খায়। দেবে থাকতে?’

মানুষ পেঙ্গুলিনের ভাষা বোঝে না। নাদিরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ভয়ে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। নীরবে ভাষা বিনিময় করে আসিফের সঙ্গে ‘তুমি তো জানো, আমি সাপ, টিকিটিকি, গিরগিটি, তক্ষক এগুলোকে কেমন ভয় পাই। ঈশিতাও ভীষণ ভয় পায়। তুমি ঘরে না থাকলে তোমার কষ্ট হবে জানি। কিন্তু...। আচ্ছা, তারচেয়ে বরং তুমি এখানে থাকো। আমি আর ঈশিতা না হয় মা’র কাছে গিয়ে থাকি।

আসিফ, অথবা পেঙ্গুলিন কথা বাড়ায় না। বন্যেরা বনে সুন্দর, নিরাপদও বটে!

স্বামী-স্ত্রীর এই নীরব কথোপকথনের মধ্যেই ঈশিতা ওদের রুমে ঢুকে। ও চিৎকার দেওয়ার আগেই নাদিরা এসে জড়িয়ে ধরে। শুধু বলতে পারে, ‘তোমার বাবা...’। আর কোনো শব্দ বের হয় না কারো মুখ থেকে। মা-মেয়ে পরস্পর জড়াজড়ি করে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে পেঙ্গুলিনের পেছনে পেছনে হাঁটে। সে ততক্ষণে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করে দিয়েছে।

দুই.

সুরেলা রিংটোনে আসিফের ঘুম ভেঙে যায়। ও প্রান্তে ডা. রায়হানের বেসুরে গলা, ‘স্যার, ৩৫ নম্বর বেডের রোগীর অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। অক্সিজেন দিচ্ছি। তাও স্যাচুরেশন ৭০-এ নেমে যাচ্ছে। নিউমোনিয়া হল কিনা বুঝতে পারছি না’। আসিফ আধো ঘুমে নিজেকে চিমটি কেটে দেখে। কোথাও কোনো আঁশ নেই, লেজ নেই। নাদিরাও বিছানায় নেই। নো ট্রান্সফরমেশন আফটার অল...। বলে, ‘তুমি পেসেন্টকে আইসিইউতে শিফট করার ব্যবস্থা করো। আর, এক্সরে করাও রেডিওগ্রাফার এলে। এখন ক্লোরকুইন আর এজিথ্রোমাইসিনের কম্বিনেশন শুরু করে দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যেই’।

হাসপাতালে করোনার রোগী আসা শুরু করার পর থেকেই আসিফ থাকছে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে। সঙ্গে আছেন আরো কয়েকজন ডাক্তার, যারা সবাই করোনার রোগীদের দেখাশোনা করছেন। তাহলে শুধু পেঙ্গুলিনের ব্যাপারই নয়, রাতে নাদিরার সঙ্গে যে ঝড় তোলার দৃশ্যÑ তাও স্বপ্ন? এখন তো হাসপাতালে ছুটে যাওয়ার আগে আবার গোসলও করতে হবে! ধুর!

আসিফের ইচ্ছে হয় একবার ছুটে গিয়ে নাদিরা আর ঈশিতাকে দেখে আসে। মানুষ হয়ত পেঙ্গুলিনে রূপান্তরিত হয় না, কিন্তু করোনায় মারা যায়। ডাক্তাররাও মারা যাচ্ছে। যতদিন করোনার রোগী চিকিৎসা করছে ততদিন তো বাসায় যাওয়ার উপায় নেই। অল্প সময়ের জন্য পেঙ্গুলিনে রূপান্তরিত হয়েও যদি যাওয়া যেত...! নাদিরা মূর্ছা গেলে যাক। আসিফের তবুও বাসায় যেতে ইচ্ছে করে।

 
Electronic Paper