ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মারাত্মক ঝুঁকিতে কয়েক লাখ পোশাক কর্মী

তোফাজ্জল হোসেন
🕐 ৩:৫৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৫, ২০২০

করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন অংশে চরম সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে দেশের কয়েকলাখ পোশাক কর্মী। গত দুই দিনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেটে ঢাকা ও আশপাশ এলাকার পোশাক কারখানায় কর্মস্থলে হাজির হয়েছে তারা। এতে করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে আশঙ্কায় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, পোশাক শ্রমিকদের ঢাকা আগমন ঠেকাতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে গত শনিবার রাতে নির্দেশনা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যদিও উৎপাদন ও রপ্তানিমুখি শিল্প কারখানা খোলা রাখার সুযোগ দেওয়া হয় জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপনেই। গত ১ এপ্রিল সরকারি ছুটি বাড়িয়ে দেওয়ার প্রজ্ঞাপনে এই সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়।

করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এ সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকবে বলা হয়। দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সচিবালয়ে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ ঘোষণা দেন।

তিনি জানান, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও তার পরের দুই দিন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। এর সঙ্গে মার্চের ২৯, ৩০, ৩১ এবং এপ্রিলের ১, ২ তারিখ সাধারণ ছুটি সংযুক্ত করা হয়েছে। এরপর ৩ ও ৪ এপ্রিল আবার সাপ্তাহিক ছুটি। এছাড়া বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জন্য বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে সেনাবাহিনী নিয়োজিত হবে।

এ সময় কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান, খাবারের দোকান ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান ছাড়া অন্য সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বন্ধ থাকবে সব ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মসজিদে না গিয়ে বাড়িতে নামাজ পড়ার জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

গণপরিবহণ বন্ধ না করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় গ্রামমুখী হয় মানুষ। এতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিলে গণপরিবহণ বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয় সরকার। এই ছুটি শেষ হওয়ার আগেই করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে গত ১ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রজ্ঞাপনে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে দেয় সরকার। এই প্রজ্ঞাপনে প্রয়োজনে ঔষধ শিল্প, উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা চালু রাখা যাবে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফলে সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেয় গার্মেন্টস মালিকরা। তারা ৫ তারিখে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে। বেতন ও চাকুরির অনিশ্চয়তার ভয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামাজিক দূরত্ব উপেক্ষা করে এমনকি গণপরিবহণ না পেয়ে পায়ে হেটে কর্মস্থলের দিকে রওনা দেয় শ্রমিকরা।

বিষয়টি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার ও বিজিএমইএ। রাজধানী অভিমুখে মানুষের ঢল ঠেকাতে শনিবার রাতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেন স্বরাষ্টমন্ত্রী।

চ্যালেঞ্জ স্বাস্থ্যের, প্রণদোনা ব্যবসায়ীদের :
করোনা ভাইরাসে বর্তমানে সবচেয়ে বেশী বিপর্যন্ত দেশ আমেরিকা। দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়েছে। মারা গেছে প্রায় ৮ হাজার নাগরিক। দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেক উন্নত। আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশটি এক লক্ষ ৭০ হাজার ভেন্টিলেটর নিয়ে যুদ্ধ করছে। এর পরেও তারা বলছে মৃত্যু সংখ্যা ২ লাখে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলেও তারা খুশি। অন্যদিকে বর্তমানে আমাদের দেশে মোট ভেন্টিলেটর আছে মাত্র ৭৫০ টি। করোনায় আক্রান্ত রোগীর সেবায় নিয়োজিতরা মানসম্মত পিপিই পাচ্ছেননা। এই দুর্যোগে ঝুঁকি নিয়ে যারা কাজ করতে এসেছেন তাদের জন্য নেই কোন প্রণোদনা।

ফলে তারা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা নিজেদের নিরাপত্তার অভাবে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছেন। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের উৎসাহিত করতে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

ঝুঁকি নিয়ে মাঠে থাকলেও উপেক্ষিত পুলিশ :
করোনা মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে চরম সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে নিজেদের কর্মকর্তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বৈরিতা। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের বঞ্চনার কথা তুলে ধরছেন। বিশ্বের দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং দিক নির্দেশনা দেওয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য ও সেবা বিভাগ।

এতে সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২৬জন সচিব থাকলেও সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) রাখা হয়নি। করোনা মোকাবেলায় দুই লক্ষ পুলিশ সদস্য কাজ করলেও পুুলিশ প্রধানকে কমিটিতে না রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা নিজেদের ফেসবুক পেজে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের এই কমিটিতে পুলিশ প্রধানকে অন্তর্ভূক্ত করে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এছাড়াও সিটি করপোরেশন জেলা/উপজেলাতে করোনা প্রতিরোধে গঠিত কমিটিতে পুলিশ প্রশাসনকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এমন অভিযোগ মাঠ প্রশাসনে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের।

গত ১ এপ্রিল সরকারি ছুটি বাড়িয়ে জ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেই প্রজ্ঞাপনে সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, জেলা প্রশাসক, ইউএনওসহ ১৬জনকে দেওয়া হলেও দেওয়া হয়নি সিনিয়র সচিব পদ মর্যাদার পুলিশ মহাপরিদর্শককে। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

রাজধানীমুখী মানুষের ঢল থামাতে আইজিপিকে নির্দেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর :
বিজিএমইএ গার্মেন্টস খোলার ঘোষণা দিলে রাজধানীর অভিমুখে ঢল নামে পোশাক শ্রমিকদের। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে সেটি সামাজিক ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। পরে রাজধানীমুখী মানুষের ঢল থামাতে শনিবার রাত ১০ টার দিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারীকে নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। রাতে মন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, আর যেন কাউকে রাজধানীতে ঢুকতে না দেওয়া হয় সে জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে এ ছাড়া পোশাক শ্রমিকদের বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে বিজিএমইএকে বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বিজিএমই জেষ্ঠ সভাপতি ফয়সাল সামাদ বলেন, এখন পর্যন্ত যা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা শ্রমিক ও শিল্পের স্বার্থ বিবেচনা করে নেওয়া হয়েছে। তবে কার্যাদেশ বাতিলসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে আছি। এখন এ পরিস্থিতি কীভাবে সমাল দেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবছি আমরা।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার ও বিজিএমইএ চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। এখানে চরম সমন্বয়হীনতার দেখা গেছে। চরম দুর্যোগের সময় এ ধরনের সমন্বয়নহীনতায় চরম ঝুঁকিতে পড়বে দেশের মানুষ। সরকরকে এ সময়ে আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

আইনজ্ঞও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. তুহিন মালিক বলেন, পোষাক শিল্পকে অবশ্যই বাঁচাতে হবে। কিন্তু তা কোনভাবেই শ্রমিকের জীবনের বিনিময়ে নয়। সরকারের আগাগোড়াই ব্যবসায়ী দিয়ে গড়া। বাণিজ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী এমপিরা সব বড় বড় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। যাদেরকে আজ আপনারা মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিচ্ছেন কালকে তাদের সংক্রমণ হলে তা একসময় আপনাদের রাজপ্রাসাদে হানা দেবেই।

 
Electronic Paper