মধ্যবিত্তকে নিয়ে ভাবার কেউ নেই!
নিহার সরকার অংকুর
🕐 ১:৫৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৫, ২০২০
বিশ্বব্যবস্থাকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে করোনা ভাইরাস। যা ইতোমধ্যে মহামারির আকার ধারণ করেছে। বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে চল্লিশ হাজার। বর্তমান সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অর্থনীতিতে ভেঙে পড়ছে। সে অবস্থা থেকে বাদ পড়েনি চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি কিংবা স্পেন। দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রকম সংকট। উন্নত দেশগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট দেখা দিচ্ছে যার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, বিপুল সংখ্যক মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়া। বিশ্ব যেন এক মৃত্যুপুরীর রূপ নিচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণ ও রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা সরাসরি বলতে নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখা।
বর্তমান সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এই মহামারি থেকে রক্ষা পেতে। উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নও করছে তারা। তারপরেও কমছে না মৃত্যুর মিছিল। সেইসব রাষ্ট্রের জনগণও সহযোগিতা করছে সেখানকার সরকারকে। উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ পুরো দেশ লকডাউন করে সেই দেশের প্রত্যেকের খাবার নিশ্চিত করা, বাড়ি ভাড়া মওকুফ, চাকরিজীবীদের বেতন নির্দিষ্ট সময়ে তাদের একাউন্টে পৌঁছে দেওয়া, চিকিৎসাব্যবস্থা সরকারি অর্থায়নে করা এমনকি প্রত্যেক নাগরিককে অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করা। সব কিছুই করবে সেই সব রাষ্ট্র কিন্তু তার বিনিময়ে নাগরিকদের ঘরে থাকতে হবে। হ্যাঁ, সেই সব রাষ্ট্র তার দেওয়া কথা রাখছে আর তাই নাগরিকরাও রাষ্ট্রের দেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে ঘরেই অবস্থান করছে।
এই সকল ঘটনা আমাদের নজরে এলেও আমরা, বাংলাদেশের মানুষরা তা তেমন আমলেই নিচ্ছি না। মহামারির এই অবস্থা দেখে রাষ্ট্রের ঘর থেকে বের না হওয়ার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেই চলছে বাজার, রাস্তাঘাটে আড্ডা। অঘোষিত লকডাউন শুরু হয় ২৬ মার্চ থেকে। শুরুর দুই তিন দিন রাস্তাঘাট নীরব থাকলেও সম্প্রতি মানুষ আবার বেরোতে শুরু করেছে।
এই বের হওয়াটা আমার কাছে দোষের মনে হচ্ছে না। এই ভেবে যে আমরা যদি বের হওয়া মানুষদের প্রয়োজন (খাদ্যসামগ্রী) মেটাতে পারতাম তখন হয়ত রাষ্ট্রের দেওয়া নির্দেশ শতভাগ পালন হতে পারত। তবু এই করোনার প্রকোপে খেটেখাওয়া নিম্ন শ্রেণির মানুষদের খাদ্যসামগ্রী, মেডিসিন, সাবান দিয়ে সহযোগিতা করছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। যা প্রশংসার দাবি রাখে কিন্তু অনেকাংশেই নিরাপত্তা না মেনে জনসমাগম করে বিতরণ করা হচ্ছে ত্রাণ যা আবার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে কেউ কেউ ঘরেও পৌঁছে দিচ্ছেন ত্রাণ। আমার মতে এটিই উত্তম। আর ছবি তোলার হিড়িকের নেতিবাচক প্রভাব নাইবা বললাম। শো-অফ করার পরেও যদি কিছু মানুষ সহযোগিতা পায় আমি তাতেই খুশি তবে যারা সংকোচবোধ করে তাদের শো-অফের দুনিয়ায় আনবেন না, দাতাদের প্রতি এটা আমার অনুরোধ।
মার্ক্সীয় দর্শনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি শক্তিশালী। সমাজে মানুষের অবস্থানকে এই দর্শন গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা ও ব্যাখ্যা করে। যেখানে ভাবনাগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকে রাজনৈতিক, অর্থনীতিক বিশ্লেষণ। এই দর্শন ভাবনার বিশ্লেষণেই উঠে আসবে সমাজব্যবস্থায় এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির বর্ণনা। এই তত্ত্বের আলোকে অনেকটা ভাসমান ও নিজেদের প্রতি অস্বচ্ছ ধারণার ওপর ভেসে থাকে এই শ্রেণির মানুষ। তাই সব থেকে বেশি অনিশ্চয়তায় থাকে এই শ্রেণি। উপমার ছলে বললে বলা যায়, নদীর দুই পাড়ের এক পাড়ে নৌকা বাঁধা থাকলে যোগাযোগ করা সুন্দর ও সহজ হয় কিন্তু মাঝ নদীতে নৌকা থাকলে সেটি অনেক বা প্রায় পূর্ণ অংশেই যোগাযোগ করা ব্যর্থ হয়ে যায় যা কষ্টসাধ্য।
এই নৌকার কথা বললাম এই ভেবে, আমাদের দেশের জনগণের বড় একটি সংখ্যা অর্থনৈতিকভাবে ও শ্রেণিগত বিশ্লেষণে মধ্যবিত্ত। তারাই হলো নদীর মাঝে আটকে থাকা নৌকা। আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর তথ্যমতে দেশের ২২ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন মধ্যবিত্ত এবং ২০৩০ সালের ভেতর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মধ্যবিত্ত কাতারে উত্তীর্ণ হবে। গবেষণাটি করেছিলেন বিনায়ক সেন। তথ্যটি মাথায় রেখে দৃশ্যটির মূল্যায়ন করতে হবে।
দৃশ্যটি সব থেকে ভালো দৃশ্যমান হয় দেশের দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে। সরকার বা রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন সংগঠন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে নজর দেয় নিম্নআয়ের মানুষ বা নিম্নবিত্তের দিকে। প্রায় সচেতন সকলের নজর পড়ে এই শ্রেণির ওপর যার দরুন তুলনামূলকভাবে সময় ভালোই অতিবাহিত করে এই শ্রেণি। কাউকে প্রয়োজন এর কথা বলতে না পারা, লজ্জায় সহযোগিতার জন্যে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের দেওয়া ত্রাণ কার্যক্রমে লাইন ধরে দাঁড়াতে না পারা মানুষগুলোই মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। এই শ্রেণিভুক্ত মানুষগুলো নিজের আয়ের ওপর নির্ভর করেই চলতে চায়।
বড় কোনো সমস্যায় না পড়লে কারো কাছে সহযোগিতাও চায় না। মধ্যবিত্তদের মধ্যে বেশিরভাগ বেসরকারি চাকরি এবং ছোট থেকে মাঝারি ধরনের ব্যবসা করে থাকে এর বাইরে কিছু সংখ্যক মানুষ সরকারি চাকরি করে থাকে। সমাজে এই মানুষগুলো ভদ্র স্বভাবের অনেকটা ইস্ত্রি পোশাক পরা ফিটফাট বাবু সেজেই চলে। পকেটে বা ঘরে অভাব থাকলেও সেটি বাইরে আসে না। করোনার তাবে সব থেকে বিপাকে এই মানুষগুলো অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে। তারা জানে না তার বেতনটা ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেবে কিনা অন্তত পূর্বের ইতিহাস থেকে ধারণা নিলে সেই স্বস্তিও পাওয়া যায় না। আর দোকান বা ব্যবসা যারা করে তাদের সকল কিছুই বন্ধ কিন্তু দোকান ভাড়া থেকে কর্মচারীর বেতন নিজের বাসা ভাড়া সবই দিতে হচ্ছে কিন্তু আয় হচ্ছে না।
একটা সময়ে এসে অনিশ্চয়তায় পড়বেই এই শ্রেণিগোষ্ঠীর মানুষ। পেটে ক্ষুধা থাকলে কিছুই সহ্য হয় না হয়তো তখন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত অমান্য করেও মৃত্যুমুখে পতিত হবেন। বের হলে রোগে মৃত্যু ভেতরে ক্ষুধার মৃত্যু। এরা বলবে কাকে এটা বলতে পারবেন কোনো কর্মকর্তা, মন্ত্রী বা সরকারপ্রধান?
সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনছিলাম, ভেবেছিলাম উনার বক্তব্যে কিছু পাবে মধ্যবিত্তরা। না কিছুই পায়নি। তবে নিম্নবিত্তরা ত্রাণের আওতায় এসেছে যা প্রশংসনীয়। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। এই দুর্যোগে তাদের সেবার আওতায় রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই বর্তমানে ত্রাণ শব্দ ব্যবহার না করে সকলের খাদ্য নিশ্চিতকরণে কাজ করা রাষ্ট্রের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া উচিত। আপনি প্রত্যেকের খাদ্য নিশ্চিত করুন সেখানে এ পাবে ও পাবে না তা যেন না হয়। প্রয়োজনে যারা স্বেচ্ছায় দিচ্ছে তাদেরগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সংগ্রহ করুন এবং প্রত্যেকের মাঝে বণ্টন করার ব্যবস্থা করুন।
তারপর ঘোষণা দেন কেউ দোকান খুলবে না, রাস্তায় বেরোবে না। তখন রাষ্ট্রের দেওয়া ঘোষণা সকলেই মানবে কিন্তু যদি পেটে খাবার না দিতে পারেন তবে তারা শুনবে কী করে? মানুষ রোগের ভয়ে মরার আগে পেটের ক্ষুধায় মরবে। সময় এসেছে দেশের সকলকে এক কাতারে মূল্যায়ন করার। প্রত্যেক নাগরিককে খাদ্য নিশ্চিতকরণের আওতায় নিয়ে আসার সময় এখন। ত্রাণ বললে অনেকেই লজ্জায় আসবে না, অনেক পিছু টানে আসবে না। তাই ত্রাণ নয় খাদ্য নিশ্চিতকরণ প্রকল্প করে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ করার ব্যবস্থা রাষ্ট্র করবে এমনটাই প্রত্যাশা। তবেই বাঁচবে এই মধ্যবিত্তসহ আমার দেশের সকল মানুষ। সেই সঙ্গে প্রকাশ পাবে রাষ্ট্রের জনগণপ্রীতি। শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। সময় এখন সেটির প্রমাণ দেওয়ার।
নিহার সরকার অংকুর : সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব
হংধংধৎশধৎ@মসধরষ.পড়স