ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভয়ঙ্কর গুজবে অস্থির বিশ্ব

শেখ আনোয়ার
🕐 ১:৩০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০১, ২০২০

বাংলাদেশেও এসেছে করোনার থাবা। তার চেয়েও এদেশে বেশি এসেছে গুজব ও আতঙ্ক। এমনিতেই নাড়িপোতা গ্রামের মেঠোপথে বেড়ে ওঠা সহজ সরল বাঙালি স্বাভাবিকভাবেই একটু কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। যদিও ডিজিটাল জীয়ন কাঠির ছোঁয়ায় এখন বাংলাদেশ থেকে কুসংস্কারভূত পালানোর উপক্রম হয়েছে। গ্রাম আর এখন আগেকার গ্রাম নেই। মিনি শহর হয়ে গেছে। তবে করোনা কালের এ সময়ে কি শহর কি গ্রাম, সব জায়গার মানুষের ভেতর করোনা নিয়ে একধরনের গুজব ও চাপা আতঙ্ক বিরাজমান। আতঙ্কের কারণ রোগটা ছোঁয়াচে। এখন আতঙ্কের আরও বড় কারণ- করোনা ঠাণ্ডা গরম বোঝে না।

ভাইরাসটা এতটাই খতরনাক, গরম আবহাওয়া ওর ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। অনেকেই আশা করেছিলেন চৈত্র মাসের খরতাপের প্রভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনা ভাইরাসের বিদায় হবে। কিন্তু গবেষকরা জানিয়েছেন তা হওয়ার নয়। কেননা এশিয়ায় সবচেয়ে উঞ্চ অঞ্চল প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি গরম শুরু হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বিপুল বিক্রমে দাপট দেখাচ্ছে করোনা ভাইরাস। ভারতে সংক্রমণের সংখ্যা এক হাজার ১০০ ছাড়িয়েছে। মৃত ২৯ জন। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ায় গ্রীষ্মকাল চলছে। তা সত্ত্বেও সেখানে কমপক্ষে ৪০০ জনের দেহে সংক্রমণ ছড়িয়েছে এবং ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আগে বলা হতো, পানিতে ফ্লু-জনিত ভাইরাস গরমে বেঁচে থাকতে পারে না। নতুন গবেষণায় নিশ্চিত, গরম এবং স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়াতেও করোনা ভাইরাস প্রবল বেগে টিকে থাকতে সক্ষম। গরম আবহাওয়ায় ড্রপলেট থেকে করোনার সংক্রমণের আশঙ্কা কম থাকার ক’দিন আগেকার থিওরি পাল্টে দিয়েছে করোনা। গবেষকরা মনে করছেন, গরমে কোনওভাবেই সংক্রমণ থামবে না করোনার।

এদিকে করোনা নিয়ে নানান গুজব চলছে। গুজবে অস্থির বিশ্ব। চারিদিকে এমন গুজবও রয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হলেই আপনি মারা যাবেন। যদিও বেশির ভাগ করোনা আক্রান্ত রোগী ভালো হয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৫১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন। আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মোট ২৫ জন সুস্থ হয়েছেন। তার মানে কী? এই ভাইরাসে আক্রান্ত সিংহভাগ মানুষই কয়েকদিনের মধ্যে এই বাংলাদেশেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। তাই বলা যায়, করোনা ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে যতটুকু ধস নামাতে চেষ্টা করছে তার চেয়ে বেশি ধস নামাচ্ছে গুজব নামের ভাইরাস। চীনে যখন করোনা হানা দেয় তখন শোনা যেত, হাজার হাজার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত লাশ পুড়িয়ে ফেলেছে চীন! অবশ্য এমন সন্দেহের কারণও রয়েছে। করোনা উপদ্রুত উহানের বায়ুম-লে দেখা যায় রহস্যজনক ধোঁয়াশাকু-লী। অথচ পুরো শহর লকডাউন। মানে সংক্রমণের ভয়ে তখন উহানের অধিবাসীরা কোয়ারেন্টাইন বা গৃহবন্দি হয়ে রয়েছেন। অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির। কলকারখানা বন্ধ।

সত্যিই তো! তাহলে ধোঁয়া হলো কেন? এমন খবর প্রকাশ করল ব্রিটেনের ডেইলি মেল এবং সানডে এক্সপ্রেস পত্রিকা। দ্য সান পত্রিকা লিখে দিল, চীন করোনার প্রমাণ ধ্বংস করছে। সবাই জানে এবং বিশ্বাস করে, মাও সেতুংয়ের চীন সম্পূর্ণ অন্যরকম দেশ। ওরা সবকিছু পারে বটে। তাই চীনকে বলা হয় হেকমতে চীন। গোটা দুনিয়ার সমালোচকরা চোখ বুজে বিশ্বাস করে, চীন তথ্য লুকোয়। গোপনে অনেক অপকর্ম করে। সুতরাং খবরটা ঢোল হতে বেশি সময় লাগেনি। খবরটা ছড়িয়ে পড়ে ডিজিটাল সোশ্যাল মিডিয়ায় হাতের মুঠোয় গেজেটে। ট্যাবলয়েড ছাড়াও অনলাইন নিউজের অসংখ্য ওয়েবসাইট ওত পেতে থাকে এমন চটকদার, গালগল্পের অপেক্ষায়। উইন্ডি ডট কম নামে একটা টুইটার অ্যাকাউন্টে মিলল আতঙ্কের আরেক খবর।

কয়েকটা স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা গেছে, উহানে আগুন জ্বলছে। বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ওই স্যাটেলাইট ভিডিওচিত্র। ওদিকে খবর হয় উহানের বাতাসে মারাত্মক ক্ষতিকর মাত্রার সালফার ডাই-অক্সাইড জমা হচ্ছে। সাধারণত কেমিকেল ঢেলে হাজার হাজার মৃত প্রাণী পোড়ালে এমনটা হওয়ার কথা। অতএব, গোটা বিশ্বে একটা অনুমান ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমণ ঠেকাতে লাশ তো বটেই। সম্ভবত করোনায় আক্রান্ত মৃতপ্রায় রোগীদেরও পুড়িয়ে মারছে চীন। কিন্তু পরে জানা যায়, স্যাটেলাইটের ছবিগুলো আসলে আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসার ‘জিইওএস-৫’ নামে একটা পরিবেশ দূষণের পূর্বানুমানের মডেলিংয়ের ভিডিওচিত্র। ভবিষ্যতে বায়ুম-লে ক্ষতিকর রাসায়নিকের অস্তিত্ব ও পরিবেশ বিপর্যয় কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এই মডেলিং এ সেই ধারণা দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে করোনা ভাইরাসের কোনও সম্পর্ক নেই। তাছাড়া উহানের বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব করোনা হওয়ার আগে থেকেই বিপজ্জনক পর্যায়ের ছিল। যা সবসময়ই তাই থাকে। অথচ পত্র-পত্রিকা, টিভি ও ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে মুহূর্তেই শাখায়-প্রশাখায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, করোনার জটিল পরিস্থিতির কারণে অপরিসীম ক্ষমতাধর চীনের প্রশাসনও কিন্তু নিজেদের দেশের ভেতরেই গুজব সামলাতে পারেনি। যখন সত্য জানার উপায় থাকে না, তখনই গুজব ছড়ায়। রাষ্ট্র সত্য না বললে বা অন্যদের সত্য বলতে না দিলে জনগণ বিকল্প সত্য বিশ্বাস করতে শুরু করে। চীনের সরকার সেই ভুলের মাশুল গুনছে এখন এই করোনা কালে। আন্তর্জাতিকভাবে চীনের ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ পরিচিতি সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার কারণে বিশ্বময় করোনা ভাইরাস ভীতি গণআতঙ্কের রূপ নেয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এবার চোখ রাখা যাক ইতালির দিকে।

আধুনিক সভ্যদেশ ইতালিতে গত ৬ মার্চ নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩ হাজারের মতো। মারা গিয়েছিল ১৪৮ জন। তখনও ইতালির বেশিরভাগ মানুষ এই ভাইরাসকে পাত্তা না দিয়ে নানান গুজব আর ভুয়া খবরেই বেশি মেতে ছিল। যে কারণে আজ ইতালিতে করোনার এত ভয়ানক অবস্থা। করোনার এই লকডাউন কালেও ভেনিসের একটা এলাকার দোকান ও বাড়িতে বাড়িতে লিফলেট ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে লেখা কোভিড-১৯ প্রতিরোধে অস্ট্রেলিয়ায় টিকা আবিষ্কার হয়েছে এবং বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে সুইজারল্যান্ড তা কিনেছে।

লিফলেটে বলা হয়, ভ্যাকসিনের ছয়টি ডোজ নিলে এক বছরের জন্য করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকা যাবে এবং মাত্র ৫০ ইউরোয় পাওয়া যাবে। যোগাযোগের জন্য ই-মেইল অ্যাড্রেসও দেওয়া হয়েছিল সেখানে। তবে বাস্তবতা হলো বিশ্বে এখনও টিকা আবিষ্কার হয়নি এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ তা হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশকারী ইতালিয়ান ওয়েবসাইট জানায়, ‘করোনার টিকা’র কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে যেটা আছে সেটা হলো মিথ্যা বলে লোকজন মজা নিচ্ছে।

পিছু ছাড়ে না গুজব। শুধু চীন ইতালি কেন? গুজব আতঙ্ক আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। ক’দিন আগে রাতদুপুরে করোনা রোধে সম্মিলিতভাবে একই সময়ে আজান দেওয়ার ব্যাপারটা যেমন গুজব ঠিক তেমনি মুরগি খেলে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে হবে এটাও গুজব! ভ্রান্ত ধারণায় অনেকেই মুরগি খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। ও ভাই, কী করে জানতে পারলেন চিকেনে করোনা ভাইরাস আছে? জিজ্ঞাসা করুন, অনেকেই বলবেন, হোয়াটসঅ্যাপে দেখেছি। সোশ্যাল মিডিয়া মারফত এই ভুয়া প্রচারে পোল্ট্রি শিল্পের কত টাকা যে ক্ষতি হয় সেই হিসাব কি কেউ রাখেন? অন্যদিকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় করোনা ভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক নানান টোটকা পরামর্শ। এসব পরামর্শের বেশিরভাগই ভুয়া। গবেষকরা বলছেন, ‘এগুলো ক্ষতিকর নাও হতে পারে। আবার বিপজ্জনকও হতে পারে।
যেমন ধরা যাক রসুন, কাঁচা হলুদ, থানকুনি পাতা ইত্যাদি।’

ফেসবুকে রসুন নিয়ে অনেক পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে বলছে, রসুন খেলে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ সম্ভব। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, রসুন একটা স্বাস্থ্যকর খাবার। প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে রসুন অনেক ধরনের সংক্রমণ রোধ করতে পারে। তবে এ রকম কোনও প্রমাণ নেই যে, রসুন খেলে মানুষ করোনো ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবে। দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের খবরে জানা যায়, করোনার ভয়ে এক মহিলা নাকি দেড় কেজি রসুন খেয়ে ফেলেছিলেন। গলায় সংক্রমণের পর পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। সাধারণভাবে ফল, সবজি ও পানি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো বলে বিবেচিত হয়। তবে এমন কোনও প্রমাণ কোথাও নেই, এগুলো খেলে করোনো ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব। ফেসবুকের কিছু পোস্টে দেখা যায়, জাপানি এক চিকিৎসক প্রতি ১৫ মিনিটে পানি খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, এতে প্রতিরোধ করা সম্ভব। ঘন ঘন পানি খেলে করোনা ভাইরাস সরাসরি পেটে পৌঁছে যাবে। তারপর পাকস্থলীর অমøরস একে ধ্বংস করে ফেলবে। এমন পরামর্শ কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত-তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিবিসি জানায়, ‘এটা নিছকই গুজব।

ঘন ঘন পানি পান করলেই করোনা ভাইরাস মরছে না।’ এ ব্যাপারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ট্রুডি ল্যাং সাফ জানিয়েছেন, ‘করোনো ভাইরাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়। এর মধ্যে কিছু ভাইরাস মুখেও যেতে পারে। তবে ঘন ঘন পানি খেলে এই ভাইরাস প্রতিরোধ করা যাবে, এমন কোনও প্রমাণ কোথাও নেই।’ তারপরও কী করলে কোভিড-১৯ থেকে রেহাই মিলবে তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছে নানান টোটকা। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণরোধে গরম পানি পান, গরম পানিতে গোসল করা ও চুল শুকানোর যন্ত্র (হেয়ার ড্রায়ার) ব্যবহার করার কথাও বলা হয়েছে। আইসক্রিম না খেতেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি অনেক পোস্টে ইউনিসেফ এই ধরনের পরামর্শ দিয়েছে বলে প্রচার চালানো হচ্ছে। অথচ ইউনিসেফ এ ধরনের প্রচারকে পুরোপুরি মিথ্যে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যে গুজবে বিশ্বাস করে ব্লিচিং পাউডার পানিতে গুলে খাওয়া, ইরানে গুজবে মদ খেয়ে শতশত মানুষের মৃত্যু ইত্যাদি ঘটনাকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গুজব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে। গবেষকরা বলছেন, ‘আমরা জানি, পানিতে ফ্লু-জনিত ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারে না। তবে আমরা এখনও জানি না যে, করোনা ভাইরাসের ওপর গরম পানি কিংবা গরম আবহাওয়া কি প্রভাব ফেলতে পারে।’ তাই এ ভাইরাস নিয়ে গুজব আর আতঙ্ক ক্ষতির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণ। করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব আতঙ্ক ছড়ানোর এইসব কারিকুরি নিয়ে সম্প্রতি সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু কে শোনে কার কথা? তাই বলা চলে, বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে তড়িৎক্রিয়া। কিন্তু সহজ করেছে হিস্টিরিয়া।

জি হ্যাঁ। ইতিহাসই প্রমাণ, প্রতিটি মহামারিতেই গুজব বাতাসের আগে ছড়ায়। গুজবগুলো সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঠেলে দেয়। কথাটা ঠিক কিনা বাপ-চাচার মুখে শুনে দেখবেন। আগে মাঝে মধ্যেই ওলাওঠা রোগ ছড়াত। বাংলায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত এই রোগে। একটা গুজব কীভাবে যেন প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল যে, গ্রামে ‘ওলাবিবি’ নামে এক ডাইনি এলেই ওলাওঠা মহামারির রূপ নেয়। খোঁড়া ন্যাড়া কুকুরদের ওপর ভর করে ওলাবিবি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়।

ফলে ওলাওঠা দেখা গেলেই খোঁড়া হোক বা না হোক, নির্বিচারে কুকুর নিধন শুরু হয়ে যেত। কুকুর বিড়াল নিধনযজ্ঞ শেষে শুরু হত ডায়রিয়া ও কলেরার মহামারি। গ্রামে স্যানিটেশনের ব্যবস্থা এখনকার মতো উন্নত ছিল না। ফলে মানুষ মারা যেত। বিষ্ঠাভোজী কুকুরের অভাবে যত্রতত্র করা কাঁচা মল পরিষ্কার হতো না। সেগুলোতে মাছি বসত। মাছি বসত খাবারে। ফলে দেখা দিত কলেরা-ডায়রিয়ার মহামারি। আশার কথা, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার, মীনা কার্টুন ও সিসিমপুর দেখিয়ে দেখিয়ে গ্রামের মানুষকে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা শিক্ষা দিয়েছে। তবে গুজব যে কী ভয়াবহ জিনিস, কী যে মহামারির জন্ম দিতে পারে, সেটা দেখতে পাওয়া যায় মধ্যযুগে ইউরোপ ও ইউরোপের উপনিবেশগুলোয় কয়েক কোটি মানুষের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ বা প্লেগে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে কালো বিড়াল নিধন শুরু হয়। কালো বিড়ালে ভর করে শয়তান বা অপ-আত্মা সমাজে নানা অনিষ্ট তৈরি করে। এই ছিল কালো বিড়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ। জনমনোস্তত্ত্ব এমনই, ভয় পেলে বাছবিচার ভুলে যায়।

কালো বিড়াল, সাদা বিড়াল না দেখে বিড়াল দেখা মাত্রই নিধনযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। বিড়াল মরে সাফ হয়ে যাওয়ায় ইঁদুরের দখলে চলে যায় গোটা ইউরোপ। কোটি কোটি ইঁদুর। ফসল কাটে। খাবারে মুখ দেয়। মানুষও মারে। ইঁদুরের গায়ে উকুনের মতো পরজীবী অণুজীবই ছিল প্লেগের জীবাণু। ফলে লাখে লাখে মানুষ মরতে শুরু করলো ইউরোপে। একই সময়ে উপনিবেশ তৈরির জন্য নতুন নতুন জায়গার অন্বেষণে সমুদ্রপথে বেরিয়ে পড়েছিল ইউরোপীয়রা। খাবার-পানীয়র বাক্সপেটরায় চড়ে জাহাজগুলোতে উঠে পড়েছিল অসংখ্য ইঁদুরও। ফলে প্লেগের দাপটে জাহাজেই মরেছিল বহু মানুষ। নতুন জমি দখল করার পর নব্য উপনিবেশগুলোতেও নেমে পড়েছিল ইঁদুরের দঙ্গল। ফলে উপনিবেশগুলোতেও প্লেগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ক’দিন আগে করোনা কালে চীনসহ কিছু দেশে একই রকম গুজবে বাদুড় ও অন্যান্য পাখি নিধন শুরু হয়। তারপর খবর বেরোয়, বাদুড় মারার সঙ্গে সঙ্গেই চীনে পঙ্গপালের উৎপাত বেড়েছে। বাদুড়ের অভাবে পঙ্গপাল বাড়লে ব্যাপক ফসলহানি ঘটবে। খাদ্যনিরাপত্তা ব্যাহত হবে। মশকজাতীয় পোকামাকড় বাড়বে। ফলে ডেঙ্গু বাড়বে। ম্যালেরিয়া ফিরে আসবে। বিড়ালসংক্রান্ত গুজব জনমনোস্তত্ত্বে যে গণআতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, বর্তমান অবস্থাটা সে রকম না হলেও সতর্ক হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।

দেশের এই দুঃসময়ে সবাইকে সম্মিলিতভাবে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় দায়িত্বশীল হতে হবে। নয়ত প্রতিরোধের চেষ্টাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে গুজবনির্ভর ভীতি এবং বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া। ভাইরাসটির ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের জন্য এই সময়ে যখন গোটা দুনিয়ার সব ক’টি দেশের সমন্বিত চেষ্টা প্রয়োজন, তখন গুজবের ডালপালা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিদ্বেষকে না কমিয়ে বরং আরও উসকে দিচ্ছে প্রতিদিনই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার, প্রতিষ্ঠান ও জনগণ যখন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য একযোগে কাজ করছে, তখন বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্যসমৃদ্ধ গুজব ছড়াচ্ছে কেউ কেউ। এটা সামাজিকভাবে ভয়ঙ্কর অপরাধ। এর ফল মারাত্মক! গুজব প্রতিরোধে প্রশাসন সম্প্রতি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ গার্মেন্টসে শীর্ষ দেশ। তাই এখানে সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব নেই।

চিকিৎসা সামগ্রীর ঘাটতি নেই। কারণ বাংলাদেশ ১০ বছর আগের সেই দেশ আর নেই। এখন এদেশ থেকেই ওষুধ রপ্তানি হয় বিদেশে। তাই অনলাইনে যা দেখবেন, সব বিশ্বাস না করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের সন্ধান করুন। সাবান, স্যানিটাইজার নিজে কিনে কিনে জমিয়ে রাখবেন না। আপনি নিরাপদ থাকলেও আপনার আশপাশের মানুষ নিরাপদ না থাকার ফলে সহজেই তার কাছ থেকে ছড়াবে ভাইরাস। নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যদেরও থাকার সুযোগ দিন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন। আমাদের পরম সৌভাগ্য, ভ্যাক্সিন হিরো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঙ্গে রয়েছেন। তার পরামর্শ ও আহ্বান সংবলিত সাম্প্রতিক বার্তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলুন। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হবেন না। বাইরে বের হলে মানুষের ভিড় এড়িয়ে চলুন। যারা আক্রান্ত হয়ে বিদেশ থেকে ফিরেছেন, তারা ১৪ দিন সম্পূর্ণ আলাদা থাকুন। সাবান-পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুতে হবে। হাঁচি-কাশি দিতে হলে রুমাল বা টিস্যু পেপার দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে নিন। যেখানে-সেখানে কফ-থুথু ফেলবেন না। করমর্দন বা কোলাকুলি থেকে বিরত থাকুন। মুসলমান ভাইয়েরা ঘরেই নামাজ আদায় করুন। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ঘরে বসে প্রার্থনা করুন। পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী এবং দেশের মানুষের জীবন রক্ষার্থে এসব পরামর্শ মেনে চলুন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন। সাবধান ও সচেতন থাকুন! আর হ্যাঁ, গুজব রটাবেন না। গুজবকে মোটেই পাত্তা দেবেন না।

শেখ আনোয়ার : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
[email protected]

 
Electronic Paper