বেচাকেনা তলানিতে, কৃষকের মাথায় হাত
জাফর আহমদ
🕐 ৪:১৯ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৯, ২০২০
করোনা ভাইরাস দুর্যোগ বিস্তার রোধে দেশজুড়ে ছুটি চলছে। সারাদেশে কার্যত লকডাউন অবস্থা। কাজ-কর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি-বেসরকারি সব ধরণের কলকারখানা। শহরের মানুষের বড় একটি অংশ এখন গ্রামে। ফলে বাজারে সব ধরণের পণ্যের চাহিদা নেমেছে এক-তৃতীয়াংশে। মাঠে ফসল থাকলেও বাজারজাত করা যাচ্ছে না। নগদ টাকা না থাকায় কৃষক সংকটে পড়ছেন।
এ অবস্থায় দেশের কৃষি বাজার ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ছে আর কৃষকের মাথায় হাত। অর্থনীতিবিদ ও কৃষক নেতারা বলছেন এ অবস্থা দুই সপ্তাহ প্রলম্বিত হলে দেশে কৃষি ও কৃষকের বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে যাবে। ভেঙে পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। করোনা ভাইরাস রোধে চলমান দীর্ঘ ছুটিতে রাজধানীর বাজারগুলোতে বেচাকেনায় নেমেছে স্থবিরতা।
মিরপুর-১০ এর বিভিন্ন কাঁচবাজারে দেখা গেছে আগের মত বিক্রেতা নেই, ক্রেতাও নেই। চাউল বাদে সব ধরণের কাঁচা পণ্যের দাম কেজিতে কমেছে ৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। পণ্য বিক্রির এই প্রভাব পড়েছে পাইকারি বাজার ও আড়তেও। কারওয়ান বাজার ও মিরপুর-১ এর আড়তে আগে যেখানে চার শ থেকে পাঁচ শত ট্রাক আসতো এখন তা নেমে এসেছে ৫০ টিতে। রাজধানীর বাজারগুলোতে বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে পাইকাররা যাচ্ছেন না আড়তে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বগুড়া থেকে শশা ও বেগুন এনেছেন বগুড়ার মিলন হোসেন। দেশ জুড়ে সাধারণ ছুটির আগে তিনি এই দুটি পণ্য ২ শ’ থেকে আড়াইশ’ মন নিয়ে আসতেন। শুক্রবার নিয়ে এসেছেন মাত্র ৫০ মন। তারপরও আগের মত গ্রাহক পাচ্ছেন না। কিন্তু ঠিকই তার বগুড়ার আড়তে ৬ জন শ্রমিককে মজুরি দিচ্ছেন।
বগুড়ায় খোলা কাগজের প্রতিনিধি তোফাজ্জল হোসেন জানান, জেলা জুড়ে হাট বাজারগুলো প্রায় বন্ধ অবস্থা। পুলিশ সাধারণ মানুষকে হাটবাজারে আসতে নিষেধ করছে। এর ফলে বাজারে আগের মত পণ্য আসছে না। বগুড়ার প্রধান কৃষিপণ্য বাজার মহাস্থান হাটে কেনাবেচা তলানিতে নেমেছে।
ঢাকায় পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে কাছের জেলা মানিকগঞ্জেও এর প্রভাব পড়েছে। সেখান থেকে কৃষিপণ্য আসা কমে চার ভাগের এক ভাগে নেমেছে। জেলায় ফসলের মাঠে ফসল তোলার জন্য প্রস্তুত থাকলেও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। নগদ টাকার প্রয়োজনে কৃষক নিজেরা ফসল কেটে বাজারে আনলেও দাম পাচ্ছেন না। ফলে যে সব কৃষক অর্থকারী ফসল চাষ করেন তারা পড়েছেন সংকটে। এভাবে ১৫ দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাবেন।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান জানান, জেলার সাটুরিয়া উপজেলার কাঁচামালের আড়ত থেকে প্রতিদিন ভোরে ৪০ থেকে ৫০ টি ছোট পিকআপ করে শাকসববি ঢাকায় নেওয়া হতো। করোনা ভাইরাসের কারণে সবজি পাঠানো নেমেছে মাত্র দুই পিকআপে। জেলার ঘিওর এলাকার চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের কারণে তারা সবজি ক্ষেত থেকে আগের মত সবজি তুলতে পারছেন না এবং যদিও বা তুলছেন পরিবহন ও ক্রেতা সংকটের কারণে সীমিত আকারে মানিকগঞ্জ সদরে নিয়ে আসছেন।
জেলার দুগ্ধ খামারগুলো পড়েছে সংকটে। এখানকার মিষ্টি ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান বন্ধ রাখায় বিপদে দুগ্ধ খামারের মালিকেরা। তারা গরু থেকে দুধ পেলেও বিক্রি করতে পারছেন না। ঘিওরের বাজারে প্রতি কেজি দুধের দাম নেমেছে ২০ টাকায় অথচ এক সপ্তাহ আগে ৪০ থেকে ৫০ টাকা লিটারে বিক্রি হয়েছে। পোল্ট্রি খামারগুলোও তাদের উৎপাদিত মুরগি ও ডিম নিয়ে সংকটে পড়েছে। ঢাকার মোকামে চাহিদা এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে। দেশ জুড়ে লকডাউন প্রলম্বিত হলে শিকেয় উঠবে এসব ব্যবসা। একই খবর এসেছে সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নরসিংদীসহ সারা দেশ থেকে।
দেশের প্রধান তিন খাত রপ্তানি আয়, রেমিটেন্স আর কৃষি। করোনা মহামারিতে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ে বড় ধরণের ঝাকুনি লেগেছে। রাজধানী কেন্দ্রিক বিপনন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এর ফলে কৃষকরা উৎপাদন করার পণ্যের দাম পাচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এখনি কৃষককে সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন কৃষক নেতারা। কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহির চন্দন খোলা কাগজকে বলেন, উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার অন্যান্য খাতের ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, সহায়তা দিচ্ছে। কৃষিতে ভর্তুকি দিতে হবে। তা না হলে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরণের ঝুকি তৈরি হবে।
এই দুর্যোগে কৃষকের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. আতিউর রহমান। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, কৃষক পণ্য উৎপাদন করে তা বিক্রি করতে না পারলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। কৃষি এবং কৃষককে বাঁচাতে তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। প্রথমত: শহরের মানুষের বড় অংশ এখন গ্রামে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ করে গ্রামের রোজগারহীন ও হতদরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরন করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত: সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাণিজ্যিক কৃষকদের কাছে থেকে পণ্য সংগ্রহ করে অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করা, দেশ জুড়ে মানুষকে কোয়ারেন্টাইনে রাখতে যে চেষ্টা চলছে তা পালন করেই ঢাকার গ্রাহকরা ঘরে বসেই পণ্য পেয়ে যাবে। আর তৃতীয়ত: রপ্তানি খাতের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের বেতনের বিশেষ তহবিল, উদ্যোক্তাদের ঋণের কিস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে তিন মাসের বিশেষ সুবিধাসহ যে সকল সুবিধা দেয়া হয়েছে কৃষকের জন্যও এ ধরনের বিশেষ তহবিল ঘোষণা করা।