আবার তোরা মানুষ হ
ইকবাল হাসান
🕐 ৮:৪৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৩, ২০২০
নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে ছাত্র-ছাত্রী হত্যার কথা, মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে প্রাণ যাওয়া রেনু বেগম, লবণ পাওয়া যাচ্ছে না বাজারে এরকম খবর কিংবা বর্তমানের ৩৫ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ডিং এই সবকিছু এক কথায় গুজব।
ভুল ও অসঙ্গত তথ্যের সংমিশ্রণে তৈরি হয় গুজব। এরকম গুজবে পরিস্থিতি যেকোনো সময় যেকোনো দিকে যেতে পারে। মুহূর্তে দেশ হয়ে যেতে পারে অস্থিতিশীল। রেনু বেগমের কথাই বলা যাক। তিনি গিয়েছিলেন তার চার বছরের বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির তথ্য নিতে কিন্তু তাকে ফিরতে হয়েছে লাশ হয়ে। এ নির্মম পরিস্থিতির জন্য গুজবই দায়ী। গুজবের জন্য এরকম নির্মম সত্যের সম্মুখীন হতে হয় কিন্তু আমরা সচেতন হচ্ছি না।
বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ৯ কোটি ৫ লাখ (বিটিআরসির হিসাবে) মানুষ। ১৬ কোটি মানুষের দেশে ৯ কোটি মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত থাকা নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য হচ্ছে, ৯ কোটির বড় একটি অংশ তরুণ। ইন্টারনেট একেক জন একেক রকম কাজে ব্যবহার করে। কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা কেউ চাকরির প্রয়োজনে অথবা অন্য কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকে। তরুণদের একটি বিরাট অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তাদের জীবনের একটি অংশে রূপান্তরিত করেছে। এর ফলে কেউ একটা কথা বললে তা মুহূর্তেই লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে সেটা ভুল হোক কিংবা সঠিক। মানুষ শুধু খবরটা দেখছে, খবরটা কে দিচ্ছে তা দেখছে না। একটা জিনিসের ব্যাপারে জানতে পারার পর সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে শেয়ার বাটনে চেপে দিচ্ছে। যার ফলে এই খবর মুহূর্তে হাজার থেকে লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। খবরটি যদি সঠিক হয়, আমাদের সমাজের জন্য কল্যাণকর হয় তাহলে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু খবরটি যদি মিথ্যা হয় তখন!
মানুষের কাছে ভুল একটি তথ্য যাবে এবং মানুষ আতঙ্কিত হবে। মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য কিংবা সরল মনে শেয়ার বাটন চেপে দেওয়ার ফলে অন্যরকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে দেশে। এই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি খুব কম মানুষই লক্ষ করে থাকে। বর্তমানের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ৩৫ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ডটি। যা ইতোমধ্যে দেশের সকল মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। সবাই না জেনে না বুঝে রেকর্ডটি শেয়ার দিয়েছেন। যার ফলে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত অবস্থায় একটি দেশের মানুষ সাময়িক সময়ের জন্য হলেও আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল।
এরকম গুজব তৈরি হয় ভুল তথ্য অর্থাৎ মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য এবং অসঙ্গত তথ্যের মিশ্রণে। সময়ের সৎ ব্যবহার করে গুজব সৃষ্টিকারীর দল চক্রান্ত করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। এবং না বুঝে না জেনে শুধু শেয়ার বাটনে চেপে দেওয়ার ফলে এ গুজব সহজেই প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে।
গুজবকে ছোঁয়াচে রোগের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে না। কারণ এ রোগগুলো একজন থেকে দুজন, দুজন থেকে চারজন, চারজন থেকে আটজন- এমনিভাবে জ্যামিতিক হারে বাড়ে। ঠিক তেমনি গুজবও এক কান থেকে অন্য কানে জ্যামিতিক হারে ছড়িয়ে পড়ে। গুজবের ধর্ম হল এটি ‘যত বেশি প্রচার হবে, তত বেশি শক্তিসম্পন্ন হবে।’ তবে এ প্রচার হওয়াটা নির্ভর করে যোগাযোগমাধ্যমের ওপর।
বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকায় গুজব ছড়ানোটা আরো বেশি সহজ হয়ে উঠেছে। অন্যান্য দেশ অর্থাৎ উন্নত দেশগুলোতেও অত্যাধুনিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু ‘গুজব ভাইরাস’ সেই দেশে এতটা শক্তিশালী নয়। কারণ, যারা শেয়ার বাটনে চাপছেন তারা চিন্তা-ভাবনা করে শুধু যেটা সঠিক মনে হবে সেটাই শেয়ার করছেন। ঠিক উল্টো মেরুতে অবস্থান বাংলাদেশের। আমাদের শিক্ষার হার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সব উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু মানসিক উন্নয়নটা হয়েও হচ্ছে না। কোনো কিছু চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই ছড়িয়ে দিই।
জাতি হিসেবে আমরা অনেকটা হুজুগে, এটা অস্বীকার করতে পারি না। এ হুজুগে কার্যকলাপের জন্য এরকম একটি অবস্থায় গুজব করোনা ভাইরাস থেকেও অধিক কার্যকর হয়ে উঠবে। যারা ভাইরাসে আক্রান্ত না তারা গুজবে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারেন। একজন আতঙ্কিত মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাই, দেশ ও দশের কথা চিন্তা করে আমাদের সকলের একটি সুস্থ, সুন্দর ইন্টারনেট জগৎ তৈরি করা উচিত। যাতে, বিপদের সময় কেউ যেন গুজব সৃষ্টি করে আমাদের আতঙ্কিত করতে না পারে।
ইকবাল হাসান : কলাম লেখক
[email protected]