ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি কতটুকু

অমিত গোস্বামী
🕐 ৬:৪০ অপরাহ্ণ, মার্চ ২০, ২০২০

করোনা নিয়ে ক্রমাগত মতপ্রকাশ চলছে। পাড়ার ঠেকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বা বৈঠকখানায় কফি উইথ করোনা। এ মুহূর্তে গ্রহব্যাপী সংক্রমণের তাড়না ও আতঙ্কে ক্রমশ নিশ্চল, নীরব এবং গৃহবন্দি হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। কিন্তু বীর বাঙালিরা? ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছে সকল আশঙ্কা। আমাগোর কিছু হইব না। অদূর ভবিষ্যতে, কিংবা অচিরেই সেই নীরব নিশ্চল কোভিড-১৯ নামক আক্ষরিক অর্থে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠবে না, এমন নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবে না। নবাগত এবং আপাতত অনিবার্য ভাইরাসটির সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব অপরিসীম। কিন্তু তার পাশাপাশি ব্যক্তি-নাগরিকের দায়ও অনেক। সমস্ত দেশে। সেই দায়ের মূল কথাটি অতি সংক্ষিপ্ত।

এক. নিজের শরীরকে, বিশেষত হাত দুটিকে যথাসম্ভব পরিষ্কার ও মুখম-ল থেকে বিযুক্ত রাখা; দুই. সামাজিক মেলামেশা যথাসাধ্য কমানো বা সামাজিক দূরত্ব যথাসাধ্য বাড়ানো, যাহার পারিভাষিক নাম: সোশ্যাল ডিস্টান্সিং। দ্বিতীয় লক্ষটি পূরণের জন্যই স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার এবং অফিস-কাছারি-সহ সমস্ত পরিসরে জনসমাগম যত দূর সম্ভব কমানোর আয়োজন অবিলম্বে করা প্রয়োজন। ভারত বা বাংলাদেশের পক্ষে এ মুহূর্তে এ সামাজিক দূরত্ব লালন করার প্রয়োজন অস্বাভাবিক রকমের বেশি, কারণ আগামী দুই থেকে চার সপ্তাহ সংক্রমণের গতি রোধ করে রাখতে পারলে বড় বিপদ এড়াবার সম্ভাবনা অনেকটা বাড়বে। গ্যারান্টি নয়, সম্ভাবনা। গ্যারান্টি আপাতত অলীক স্বপ্ন, সম্ভাবনা যথাশক্তি বাড়ানোর চেষ্টাই একমাত্র করণীয়।

কিন্তু ভারতের কিছু সংখ্যক মানুষ এবং বাংলাদেশের প্রবাস ফেরত বাঙালিরা প্রশ্ন তুলেছেন- এত কড়াকড়ি কেন? ভারতের জনসংখ্যা এবং সংক্রমণের অনুপাত হিসাব দেখিয়ে অনেকেই বলছেন, এখনই এমন বাড়াবাড়ির প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এখন তর্কের সময় নয়। অন্তত কয়েক সপ্তাহ তো নয়ই। এখন প্রয়োজন শতকরা একশ’ ভাগ সতর্ক থাকা। এককথায় বলাই যায় যুদ্ধকালীন সতর্কতা। প্রশ্ন আবার কিছু পণ্ডিত করতেই পারেন- এর ফলে মানুষ অনর্থক আতঙ্কিত হয়ে পড়বে না তো? তার উত্তর- আতঙ্ক দূরে রাখার জন্যই চূড়ান্ত সতর্কতার প্রয়োজন। যাতে বাধ্য হয়ে জনজীবন অচল করতে না হয়, সেই কারণেই জনসমাগম ও সামাজিক মেলামেশা যথাসম্ভব কমানো জরুরি। এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি মোটের উপর নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু নির্দেশ না মানার যে প্রবণতা আমরা দেখাচ্ছি তাতে ভবিষ্যতে কী দাঁড়াবে কে জানে!

করোনা প্রতিরোধে দেশে দেশে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে সফল দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। চীনে কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভাইরাস প্রতিরোধে জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রচারের কোনো খামতি হয়নি। বাস কিংবা মেট্রো সব যানবাহনে কিছুক্ষণ পরপর কোরিয়ান ও ইংরেজিতে বেজে উঠছে করোনা প্রতিরোধে সাবধানতা। এমনকি রাস্তাঘাটে বড় বড় বিলবোর্ড কিংবা প্ল্যাকার্ডে চলছে প্রচার। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি যখন দেগু সিটির শিনশিওঞ্জি চার্চের হাজারো মানুষের জনসমাগমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া গেল, তারপর থেকেই মানুষ তখন অক্ষরে অক্ষরে সরকারের নির্দেশনা ফলো করতে লাগল। যেকোনো জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হল। ধর্মালয়গুলো বন্ধ রাখার অনুরোধ করা হলো। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে বাড়ির বাইরে আসতে নিরুৎসাহিত করা হলো। সর্বাধুনিক টেলিপ্রযুক্তির সাহায্যে সম্ভাব্য রোগীদের ট্রেকিং করে ভাইরাস টেস্টের আওতায় নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে, যারা ভাইরাসে পজিটিভ হয়েছেন, তাদের গতিবিধি জনসাধারণকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল কোরিয়া সরকারের পক্ষ থেকে, যাতে মানুষ সচেতন হতে পারে। এর ফলে কোরিয়াতে তরতর করে নামছে আক্রান্তের সংখ্যা। হয়তো কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ বাড়ির বাইরে মাস্ক ব্যবহার করছে, এমনকি মাস্ক ব্যবহার না করলে গাড়িতে ওঠার কোনো অনুমতি নেই।

অফিস বিল্ডিংগুলোতে সাইড দরজা বন্ধ রেখে শুধু মেইন দরজা খোলা রাখা হয়েছে। দরজার সামনেই হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল রাখা আছে আর নোটিশে অনুরোধ করা হয়েছে, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ভালোভাবে পরিষ্কার করে বিল্ডিংয়ে প্রবেশের। প্রতিদিন অন্তত একবার পুরো বিল্ডিংকে ফগার মেশিনে স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। অন্যের সঙ্গে কথা বলতে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, কারণ ভাইরাসটি বায়ুবাহিত না হলেও মুখের ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তাই মাস্ক ব্যবহারে এ ড্রপলেট ছড়িয়ে পড়াকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সঙ্গে রোগের ট্রান্সমিশনও! কিন্তু ঢাকায়?

রাজধানীসহ সারা দেশেই গণপরিবহন-বাজারসহ যে সব জায়গায় জনসমাগম হয়, সেখানে কোনো পরিবর্তনের খবর নেই। করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বড় রকমের ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। একদিকে নমুনা পরীক্ষার জন্য কিট সঙ্কট। এ মুহূর্তে ২০০০-এর কম কিট রয়েছে। অন্যদিকে জনসচেতনতাও কম। হাসপাতালগুলোতে বেশির ভাগেরই প্রস্তুতি নেই। মাত্র দুটি হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে বিদেশ ফেরতরা কোয়ারেন্টাইনে না থেকে যার যার বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। গত ১ সপ্তাহে অনেক মানুষ দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই পরীক্ষার বাইরে থেকে গেছেন। বিশেষ করে ইতালি ফেরতরা কোয়ারেন্টাইনে না থেকে বাড়ি চলে যাওয়ায় সংশয় আরো বেড়েছে। বাংলাদেশে রোগ নির্ণয়ের কেন্দ্র রয়েছে মাত্র একটি। প্রতিদিন ১ হাজার জনের নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। যদিও বাস্তবে ৩০ জনেরও কম লোকের পরীক্ষা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ নির্ণয় সঠিকভাবে না হলে কত লোক আক্রান্ত হয়েছেন তা বলা সম্ভব নয়।

করোনা ভাইরাসের কবল থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার জন্য গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই পরিপ্রক্ষিতে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে সারা দেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অপরদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম সাময়িক বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে। কিন্তু ছুটি পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। তাতে মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। এর মধ্যে দেশের সব হল বন্ধের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

১৫ দিনের মতো দেশের সব ধরনের সিনেমা হল বন্ধ থাকছে। শুধু তাই নয়, এ করোনা আতঙ্কে এরই মধ্যে বন্ধ হয়েছে বেশ কিছু সিনেমার শুটিং। কিন্তু এই মহামারী ভাইরাস আতঙ্কের মাঝেও চলছে নাটকের শুটিং। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরা, পুবাইল, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, শ্রীমঙ্গলসহ আরও বিভিন্ন জায়গায় এখনও চলছে বিভিন্ন নাটকের শুটিং। আরও জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় ৫০টি ইউনিট নাটকের শুটিং করছে। সেইসব শুটিংয়ে জমায়েত হচ্ছে প্রায় ৩০/৪০ জনের মতো টিম। সরকারি নির্দেশনা না মেনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে বিদেশ ফেরত প্রায় অর্ধশত বাংলাদেশী নাগরিক প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা থাকলেও তারা তা অমান্য করে ঘোরাফেরা করছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ১৪ দিন সতর্কতার সঙ্গে দুটি শর্ত পালন করলে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারে বাংলাদেশ। শর্ত দুটি হচ্ছে- এক. বিদেশ থেকে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না ও দুই. ইতোমধ্যে বিদেশ ফেরতদের এবং তাদের সংস্পর্শে আসা লোকজনের যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে আগামী ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক অথবা হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। এর অন্যথা হলে এ দেশে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ। শুধু যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের সব দেশ ও আমেরিকার সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশের। তবে এখনো থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে আকাশ যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। এসব দেশ থেকে যেসব প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশি বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন, তারা করোনা ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকির কারণ হতে পারেন। সারা দেশে এখন যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই যথাযথভাবে কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন না বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে। কেউ কেউ কোয়ারেন্টাইনে থাকাবস্থায় বাজার-সদাই করছেন; বিয়েবাড়ির ভিড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

ইতোমধ্যে কয়েকজনকে জেল-জরিমানাও করা হয়েছে। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ১৪ দিনের মধ্যে যারা এসেছেন, তাদের ক্ষেত্রে হোম কোয়ারেন্টাইন প্রযোজ্য। সিভিল সার্জনদের দপ্তর থেকে পাঠানো তথ্যাদির ভিত্তিতে দেশে যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন, তাদের সংখ্যা আমরা জানিয়েছিলাম। এর বাইরে কিছু জায়গা আছে, হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তাই আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়েছি। যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন না, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন যে কোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। হোম কোয়ারেন্টাইনই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। হয়ত কিছুই হবে না। হয়ত তাপমাত্রার প্রাবল্যে এ ভাইরাস আদৌ কার্যকরী হবে না বাংলাদেশে। কিন্তু এ ভাইরাস নিজের জিনসজ্জার কার্যকরী অভিযোজন ঘটিয়েছে ৩৮০ বারের বেশি। সেক্ষেত্রে উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করার জন্যে নিজ জিনসজ্জা পরিবর্তিত করতে পারবে না তার গ্যারান্টি নেই। এ অবস্থায় প্রয়োজন তীব্র জনমত সৃষ্টি। ঝুঁকি না নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কথা মেনে চলাই শ্রেয়। তাতে অন্তত প্রাণ বাঁচবে। এখন সেটাই জরুরি।

অমিত গোস্বামী : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper