করোনায় আতঙ্ক নয়, সচেতন হোন
অয়েজুল হক
🕐 ১০:২০ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৮, ২০২০
নতুন করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। বেশ কিছুদিন আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বিশ্বব্যাপী সকল দেশ ও মানুষের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। তাদের মতে করোনা ভাইরাস দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সবল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেশ যেখানে এ ভাইরাস সংক্রমণের কারণে দিশেহারা তখন আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যদি এ ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার ঘটে তাহলে ঠিক কী ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। চীনের অবস্থা আমরা দেখেছি। চীনের পর ইরান, ইতালি, সিংগাপুর, মধ্যপ্রাচ্য ও গোটা ইউরোপ থমকে গেছে। এখন তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন; প্রায় গোটা বিশ্ব।
বাংলাদেশও বসে নেই- ইউরোপ থেকে বাংলাদেশগামী সব ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। একই সঙ্গে সব দেশের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে পর্যন্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে সমূহ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য একজোট হয়ে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় আমাদের। বাংলাদেশ মারাত্মক করোনা ঝুঁকিতে থাকা দেশ থেকে আসা বাংলাদেশিদের জন্য কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেছে। অনেকে মনে করছেন, কোয়ারেন্টাইন ও বিমানবন্দরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ আরও আগে নেওয়া দরকার ছিল। থার্মাল স্ক্যানার ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যাপারে সমালোচনা হয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের বারবার সরকারের পক্ষ থেকে দেশে আসতে নিরুৎসাহিত করা হলেও ফেরত আসা প্রবাসীদের ঢল ঠেকানো যায়নি। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। সর্বপ্রথম যে তিনজন করোনা ভাইরাসের রোগী বাংলাদেশে ধরা পড়েছে তাদের দুইজন ইতালি ফেরত পুরুষ আর একজন ওই পরিবারের এক নারী সদস্য।
তারা সুস্থ হতেই আরো দু’জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত । তারাও প্রবাসী। একজন ইতালি ফেরত, একজন জার্মান ফেরত। গতকাল বুধবার পর্যন্ত শেষ খবর মোট আক্রান্ত হয় ১৪ জন। বুধবারই জানানো হয় একজনের মারা যাওয়ার খবর।
বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন প্রবাসী অনেক মানুষ। হাসপাতালেও আইসোলেশনে আছেন। এর বাইরে ঠিক কত মানুষ আছেন তা বলা মুশকিল। তবে তারা যদি দেশ ও মানুষের কথা চিন্তা করে নিজেদের আড়াল করে রাখেন, সত্যিকার অর্থে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকেন তাহলে দেশ ও মানুষের উপকার হবে। বাড়ি বা হাসপাতাল যেখানেই কোয়ারেন্টাইন হোক- করোনা ভাইরাস যেহেতু আক্রান্ত এলাকায় ভয়াবহ গতিতে সংক্রমণ ঘটায় সে কারণে যে সব এলাকায় কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে করোনা সন্দেহে মানুষজনকে রাখা হচ্ছে সেসব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। একটা ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
তবে মানুষ যতটা আতঙ্কগ্রস্থ ঠিক ততোটা সচেতন নয়। আগেই বলেছি, ভাইরাস যেহেতু নতুন সেহেতু রয়েছে নানামত। মাস্ক পরতে হবে তো মাস্ক নিয়ে হুড়োহুড়ি। একদিনে দশ টাকার মাস্ক হয়ে গেল ১শ’ টাকা। আমাদের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এমন সব সুযোগের অপেক্ষাতেই যেন বসে থাকেন। বিপদগ্রস্থ মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি। মাস্ক নিয়েও গবেষকদের ভেতর বিতর্ক রয়েছে। মার্কিন বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় মাস্কের দরকার নেই। বরং মাস্ক ব্যবহারের কারণে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে। কেউ কেউ বলছেন হাঁচি কাশির মাধ্যমে প্রায় ছয় ফুট দূরত্ব পর্যন্ত বাতাসে করোনা ভাইরাসের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে সেহেতু মাস্ক ঠিকঠাক মতো পরিধান করলে কিছুটা সুরক্ষা তো হয়। হ্যাঁ, কিছুটা সুরক্ষা হয়তো হয়? এবার একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যমতে, গত আড়াই মাসে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে। ১৫ মার্চ বাংলাদেশের সময় রাত একটা পর্যন্ত ১৪৯টি দেশ ও অঞ্চলে করোনা ছড়ানোর খবর জানিয়েছে বৈশ্বিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডমিটার। এ সময়ে সংক্রমিত হয়েছে এক লাখ ৮০ হাজারের মতো। ৭৯২ জন। মৃতের সংখ্যা সাত হাজারের মত। মৃত্যুর হার খুব বেশি না হলেও লেখা হচ্ছে মরণ ব্যাধি করোনা। এর কারণ সম্ভবত এর কোন প্রতিষেধক নেই। টিকা নেই। ওষুধ নেই। স্বাভাবিকভাবে যার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি থাকবে তিনি হয়তো টিকতে পারবেন। সবাই পারবেন এ কথাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। নানাজনের নানামুখী বিশ্লেষণ, মতামত। মানুষ দিশেহারা। তবে জরিপের ফলাফল ঘাটলে দেখা যায় বেশিরভাগ মানুষ হালকা উপসর্গের ভেতর দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তবে প্রচুর সংখ্যক মানুষ যখন একসঙ্গে আক্রান্ত হয় এবং সংখ্যা যখন ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে তখন সেটা বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি সত্যিই বড় আশংকার কারণ। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও সচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। যেখানে সেখানে নোংরা পরিবেশ নয়। আমাদের ঘরবাড়িগুলোকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। বার বার হাত ধোঁয়া। জনসমাগম থেকে দূরে থাকা। প্রয়োজনে জনসমাগমের ক্ষেত্রগুলোকে বন্ধ করা। গণপরিবহন এড়িয়ে চলা বা সতর্কতা অবলম্বন করা। হ্যান্ড স্যানেটারি, স্যাভলন বা জীবাণুনাশক ব্যবহার করা। হাঁচি কাশির সময় টিস্যু বা কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা। জ্বর, সর্দি, কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত নিকস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করা। প্রয়োজনে হেল্পলাইনে কল করে সাহায্য নেওয়া।
সর্বোপরি, আতঙ্কিত হয়ে কোন লাভ নেই। আতঙ্ক ছড়ানোও মারাত্মক অপরাধ। কেউ গুজব ছড়ালে সরকারের উচিত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা। করোনা মানেই মৃত্যু নয়, কিছু আর্টিকেল তথ্য উপাত্ত থেকে আমাদের দেশের কিছু চিকিৎসক মৃত্যুহার ও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এবং সুস্থতার হিসাব তুলে ধরে আশার বানী শোনাচ্ছেন। তাদের কথায় আমরা আশ^স্ত হতে চাই। বাংলাদেশের মতো দেশে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যে কোন ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বা অবদান রাখার সুযোগ থাকে। যেমন চলতি অবস্থায় ডাক্তার ও ধর্মবিদদের কথাকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই এটা খুব বড় কিছু নয়। আমাদের আবহাওয়া উষ্ণ হতে শুরু করেছে। গরম বাড়ছে। কেউ কেউ বলছেন গরমে করোনা ভাইরাস বংশ বিস্তার করতে পারে না। এই ঠাণ্ডা গরম নিয়েও মতবিরোধ। কোভিড নাইনটিন বা করোনা ভাইরাস সম্পূর্ণ নতুন হওয়ার কারণে বিজ্ঞানী ও গবেষকগণের গতিবিধি, প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত সঠিক তথ্য এখনো দিতে পারছেন না। এজন্য কেউ বলছেন গরমে প্রকোপ কমবে, কেউ বলছেন এ কথার কোন ভিত্তি নেই।
যদি সত্যিই গরমে করোনা ভাইরাস কমে তাহলে আমাদের জন্য সুসংবাদ। এ সংবাদ ঠিক হলে আশা করা যায় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের পর হয়তো করোনার প্রকোপ ধীরে ধীরে কমে যাবে, বা থাকবে না।
কিন্তু ততদিন আমাদের এ ভাইরাসের বিস্তার রোধে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। আসুন এক হই। দেশ ও মানুষের জন্য। দুর্যোগে তোষামোদ আর দোষারোপের অভ্যাস পরিত্যাগ করে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
অয়েজুল হক : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]