ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বিশেষ কলাম

নারীর অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা

আশেক মাহমুদ
🕐 ৭:২৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৩, ২০২০

প্রতি বছরের মতো এবারও সারা দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে নানাবিধ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে বিভাগেরই উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়েছে আরও উচ্চতর ও অভিনব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। এ দিনে আমাদের আয়োজনের মধ্যে ছিল শোভাযাত্রা (নারী অধিকার সংবলিত বিভিন্ন স্লোগান লিখিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে), নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য নিরসনে অত্যাধুনিক পোস্টার প্রদর্শনী প্রতিযোগিতা ও ভিন্ন আঙ্গিকে বিতর্ক প্রতিযোগিতা। বিতর্ক প্রতিযোগিতা ছিল দারুণভাবে উপভোগ্য।

‘নারীর অগ্রযাত্রায় কোনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ? রাজনৈতিক অঙ্গীকার নাকি শিক্ষা?’ বিতর্ক ছিল এ বিষয়কে কেন্দ্র করে। বিষয়টি মাথায় রেখে আমি একটু ভিন্নভাবে কিছু কথা বলতে চাই।

এ কথা কিছুতেই মানতে পারছি না, পুরুষেরা অগ্রযাত্রায় আছে আর তাই নারীর অগ্রযাত্রা দরকার। বরং আমি পুরুষের অনগ্রসরতা দেখে বিস্মিত। হ্যাঁ, এটা সত্য যে পুরুষেরা সমস্ত ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে চলছে, ওরা নারীদের অধিকার হরণ করে চলছে, ওরা নারীর মর্যাদা পদদলিত করছে। আর এ ক্ষেত্রে পুরুষেরা কতগুলো আজগুবি ধারণা প্রচার করছে যা দিয়ে নারীদের দুর্বল করে রাখা যায়। প্রচলিত অনেক কথারই কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। আরবের তৎকালীন রাজতান্ত্রিক রাজা বাদশাহদের তত্ত্বাবধানে এগুলো বানানো হয়েছে। আর সেই ইতিহাস আমাদের কাছে অজ্ঞাত রয়ে গেছে। আরবের ইতিহাস ছিল পুরুষবাদীদের রাজত্বের ইতিহাস। সে ইতিহাসকে আবার জীবন্ত করে তোলে আরবের তৎকালীন রাজতান্ত্রিক রাজা-বাদশাহরা।

আসলে ইতিহাস ও বর্তমান চালচিত্র বিচার করলেই বোঝা যায়, যে সকল কাজ গুরুতর পাপ তার অধিকাংশই হচ্ছে পুরুষের হাতের কামাই। সারা বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি, লুটপাট, অন্যের সম্পদ হরণ, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ, খুন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, ব্যভিচার, রক্তাক্ত করে রাজ্য দখল, চুরি, ডাকাতি- এ সবের যদি পরিসংখ্যান করা হয় তাতে কি পুরুষেরাই অধিক পাপী নয়? মানব জাতির ইতিহাসে যে দু’ দুটি বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে কোটি কোটি মানুষ হত্যা করা হয় তাকি রক্তপিপাসু পুরুষেরা করেনি? সারা বিশ্বে এখনো যাদের হাতে প্রতিদিন মানুষ রক্তাক্ত খুনের শিকার তারা তো আধিপত্যবাদী পুরুষরাই। আর এ কারণেই আমি বলছি, পুরুষেরা অগ্রযাত্রায় নেই, বরং তারাই অধিক মাত্রায় পৃথিবীকে নরক বানিয়ে রেখেছে। আর তাই, নারীর অগ্রযাত্রার পথ পরিষ্কার করতে হলে অমানুষ প্রকৃতির এ সকল পুরুষের কবল থেকে মুক্তি নিশ্চিত করা দরকার।

মূলত নারী অধিকার বা নারীর অগ্রযাত্রা চার বিপদের খপ্পরে পড়ে আছে- ১. আধিপত্যবাদী পুরুষতন্ত্র ২. পশুত্ববাদ ৩. চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক প্রথা ৪. আধুনিকতার নামে ইরোটিক পুঁজিবাদ। নারী সমাজ পুরুষতন্ত্রের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি চায়, এটা সত্য। কেননা আধিপত্যের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষ তার প্রাকৃতিক দাবি পূরণ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বহু নারী অজান্তেই সামাজিক নিয়ম মনে করে পুরুষতন্ত্রকে আরো মজবুত করছে; বলছে এটা নিয়ম, এটা প্রথা, তাই মানতে হবে। অন্যদিকে অধিকাংশ পুরুষ পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর, এটা এ জন্য যে তারা পশুত্ববাদের চেতনাকে লালন করে চলছে। নারী সমাজ পুরুষতন্ত্রের সাজানো শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে আধুনিক পুঁজিবাদের কোলে যখনি আশ্রয় নিয়েছে তখনই তারা আরও বড় পরিসরে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। কেননা পুঁজিবাদ পুঁজির শক্তিতে পাবলিক পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

এ পাবলিক পুরুষতন্ত্র নারী স্বাধীনতার কথা বলে নারীদের পণ্যরূপে বাজারে হাজির করে, আর নারীরা স্বাধীনতার নামে সেই পিল গ্রহণ করে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার চরম ভোক্তাশ্রেণি এ পুরুষরাই। পুঁজিবাদের হাত ধরে যে প্রযুক্তি আমাদের হাতে এসেছে সেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পুরুষরা নারীদের অতি সহজেই ফাঁদে ফেলতে পারছে; আর নারীরা সেই ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ফেসবুক হল ডিজিটাল ফাঁদ, ডিজিটাল মোহে আচ্ছন্ন হয়ে নারীরা আত্মপ্রদর্শনকে কালচারের অনুষঙ্গ বানিয়েছে, সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাচ্ছে নিম্ন মানসিকতার পুরুষরা।

মূলত সেই দিন থেকে আধুনিক নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয় হয়েছে যেদিন থেকে তারা পুরুষদেরকেই রোল মডেল বানিয়ে নারী অধিকার আদায়ের চেষ্টা করছে। এটা এ জন্য যে নারী সমাজ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু পুরুষতন্ত্রের মূল শক্তি পশুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি। আর তাই পুঁজিবাদ আধুনিকতার নামে যে কালচার জারি রেখেছে সেই জায়গাকে নারী অধিকার হরণের আধুনিক ফাঁদ হিসেবে চিহ্নিত করে নারী অধিকারের ব্যাপারে বিজ্ঞতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারী কারো খেলার পুতুল নয়, নারী কোনো ব্যবসার পণ্য নয়, আর নারী কোনো বস্তু নয় যে তা ইরোটিক পুঁজিবাদের আর গতানুগতিক পুরুষবাদের হাতে বন্দি থাকবে। নারী ও পুরুষের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা,মানুষ হওয়ার চেষ্টা করুন, অমানুষদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় শামিল হোন, তবেই নারী- পুরুষ উভয়েরই মানবিক অধিকার অর্জিত হবে। আর এ কাজ করবে তারাই যারা সত্যিকার অর্থে মানুষ হতে পেরেছে।

আশেক মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
[email protected]

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper