কলকাতায় কেটারিংয়ের প্রচলন
অমিত গোস্বামী
🕐 ১২:৫৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ০৬, ২০২০
আমাদের ছোটবেলায় বিয়েবাড়িতে কেটারিংয়ের চল ছিল না। ছিল ঠাকুর, ছিল হালুইকর। বাড়ির লোকজন কাঁচাবাজার করে দিত, মুদিখানা থেকে আসত তেল মশলা। মাছওয়ালা মাছ এনে হাজির করত কাকভোরে। আর হালুইকরের কাজ শুরু হত আগের দিন বিকেলে। দুধ বুঝে নেওয়া। ছানা কাটা। ময়দা মাখা। এর মধ্যে ‘কী বানালি’ দে, দেখি টেস্ট করি।
আমাদের বাড়ির ঠাকুর ছক্কা। উড়িষ্যার লোক। এলাকার যাবতীয় ভোজের কাণ্ডারি। তার কাছে গেলে প্রথমেই গড়গড় করে মেনুর ফরমাস করত। ডাঁটিওয়ালা বেগুন ভাজা, ছ্যাঁচড়া, আলুর দম, মাছের মাথা দিয়ে সোনা মুগের ডাল, মাছের কালিয়া, কচি পাঁঠার মাংস, চাটনি, পাঁপড়- বাকিটা হালুইকর।
কেউ হয়ত বলত- ছক্কাদা, এবার মেনুটা পালটাও, পোলাও-টোলাও কর। বাজখাঁই গলা ছেড়ে ছক্কা বলত- তাহলে পঞ্চা ঠাকুরের কাছে যান, ডালডা মেরে পোলাও বানাবে, মুখ মেরে দেবে, মাংস হাফসিদ্ধ, টানবে কম, দশ কেজিতে সোয়া শ’ লোক।
ছক্কার সাগরেদ সূর্য মোদক। হালুইকর। তারও হম্বিতম্বা কম লম্বা নয়। অনুষ্ঠানের আগের দিন ভর বিকেলে বাড়ির সামনে হাম্বা হাম্বা। পঁচিশটা গরু, পঁচিশটা বাছুর। কী ব্যাপার? চোখের সামনে দুধ দোয়ানো হবে। জ্যাঠা কাকারা বেরিয়ে পড়েছে। এলাহি কাণ্ড। গরুর দুধ দোয়ানো হচ্ছে। পাড়া মুখরিত চ্যাঁ চোঁ শব্দে। সদ্য গাঁজায় দম দিয়ে এবার সূর্য মোদকের সব দুধ জ্বাল দেওয়া দিয়ে মিষ্টি বানানোর উদ্বোধন শুরু।
অনুষ্ঠানের দিন ভোজের আসর বসার আগে সন্ধ্যা বেলায় গোটা কুড়ি হ্যাজাক জ্বালানো শেষ। এর মধ্যে পাড়ার অল্প বয়সী কাকারা রেডি। পরিবেশন করবে। তাদের জন্যে এসেছে নতুন গামছা। ভালো ধুতি শার্টের ওপরে নতুন গামছা জড়িয়ে পরিবেশনের সময়ে অল্পবয়সী পিসিদের কাছে- আরেকটু দিই, আরেকটু দিই করত। রমেশ দাদু একবার পল্টু কাকুকে চেঁচিয়ে বলেছিলেন- ওরে পল্টু, ওইটা আমার চতুর্থ পক্ষ, ওইখানে ঘাঁটি গাইড়া লাভ নাই। এইখানে আইয়া আমায় দুইটা মাছ দে। কিন্তু লাভ কার কী হয়েছিল পরে জানা গেল। মাস তিনেক পরে শুনলাম যে পল্টুকাকু ও রমেশ দাদুর চতুর্থ পক্ষ হাওয়া। পূর্ব পাকিস্তানে ভেগেছে।
সে সময় বরযাত্রীরা ছিল এক ভীতির বিষয়। কী যে তারা করবে তা নিয়ে সবাই তটস্থ। চল্লিশ জন আসবে বলে এক শ’ জন এল। এসে আবার নানা বায়নাক্কা। কন্যাপক্ষকে অপদস্থ করে তারা অতি জান্তব তৃপ্তি পেত। তার প্রমাণ ফিরে এসে বৈঠকখানায় বসে রসিয়ে রসিয়ে তার গল্প বলা। আমাদের পাশের এলাকার বিমল সান্যালের নাম ছিল রামখচ্চর বুড়ো। তিনি তারা চার ছেলের বিয়েতে গিয়ে কন্যাপক্ষকে কীভাবে নাকাল করেছেন তার গল্প বলতে খুব ভালোবাসতেন। বলে সে কী উল্লাস! বিমল সান্যালের পরিবার এমনিতে খুবই ভালো। এহেন সান্যাল মশাইয়ের পঞ্চম ও কনিষ্ঠ ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হল চাঁপা পিসির। সবাই চাঁপা পিসির বাবা নিতীশ দাদুকে বলল- বাহ, খুব ভালো পরিবার ওরা, রানী হবে চাঁপা। কিন্তু একটাই সমস্যা, বরযাত্রীদের নিয়ে বিমল সান্যাল কী মতলব করেন কে জানে। যতক্ষণ না নিতীশ দাদুকে অপদস্থ করে বিমল সান্যাল হেঁ হেঁ করতে পারছেন ততক্ষণই চাপ। নিতীশ দাদু এ একটা কারণেই টেনশনে তটস্থ। এ অবস্থায় হাল ধরলেন গদাই কাকা। বললেন- নিতীশ কাকা, আপনি বিমল সান্যালকে জানিয়ে দেবেন যে বরযাত্রীদের আপ্যায়নে গদাই চক্কোত্তি মজুদ থাকবে।
যথাসময়ে বিমল সান্যাল নিতীশ দাদুকে বললেন- এটা আমার শেষ বিয়ের কাজ। তাই আমার একটা শখ আছে, সেটা হল আপনারা বরযাত্রীদের সাঙ্গীতিক ভোজে আপ্যায়িত করবেন। গদাই কাকা এগিয়ে এসে বললেন- ব্যাখ্যা করুন সান্যাল মশাই, সাঙ্গীতিক ভোজ মানে আপনারা কী চাইছেন? ভোজের সঙ্গে সঙ্গীত না সঙ্গীতের সঙ্গে ভোজ? মানে কেমন চাই? তয়ফাওয়ালি? আগ্রাওয়ালি? খ্যামটা? খেউড়? ঝিনচ্যাক? বিমল সান্যাল গম্ভীর হয়ে বললেন- অশ্লীল কিছু চলবে না। সাঙ্গীতিক ভোজ বলেছি, বাকিটা আপনাদের বুদ্ধির পরীক্ষা। বুঝে আয়োজন করুন। গদাই কাকা বললেন- কুছ পরোয়া নেহি, ম্যায় হুঁ না?
বিয়ের দিন। মণ্ডপে ভোজের জায়গায় একটা মঞ্চ। সেখানে কয়েকটা মাইক আর কিছু বাদ্যযন্ত্র। বরযাত্রীরা সদলবলে এল। প্রারম্ভিক আপ্যায়ন ও পরবর্তী খাতিরদারির পরে তাদের ভোজে আহ্বান করা হল। বিমল সান্যালের নেতৃত্বে সবাই আসন গ্রহণ করলেন। মঞ্চে আরোহন করল তিনটি যুবক ও একটি বুক ঢিপঢিপ করা তরুণী। তরুণীটি মাইক্রোফোন তুলে তুলতুলে গলায় বলল- আজ এ সাঙ্গীতিক ভোজসভায় মাননীয় বিমল সান্যাল মহাশয় ও তার পরিজনদের স্বাগত।
সঙ্গে সঙ্গে বাকি তিন তরুণ বাদ্যযন্ত্রে প্যাঁ পোঁ, ঝিন কুড়কুড়। আজকের ভোজসভায় আমাদের উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইবেন বেবি নান। তবলা সঙ্গতে কিমা কারি। বাদ্যযন্ত্রে বাজল প্যাঁ পোঁ, ঝিন কুড় কুড়। বেবি নান দিয়ে কিমা কারি খাওয়া শেষ হতেই আবার ঘোষণা। এবারে ব্রেক ড্যান্স শো। শিল্পী ফিস ওরলি, কী বোর্ডে রাশিয়ান স্যালাড। বাদ্যযন্ত্রে বাজল প্যাঁ পোঁ, ঝিন কুড় কুড়। এর পরে পপ গায়িকা- চিকেন মাঞ্চুরিয়ান। বাদ্যযন্ত্রে প্যাঁ পোঁ, ঝিন কুড় কুড়। এবারে গজল গাইবেন মটন বিরিয়ানি। পাখোয়াজে দই বুরহানি। বাদ্যযন্ত্রে প্যাঁ পোঁ। এবারে কৌতুক শিল্পী চাটনি সঙ্গে উদাস বাউল পাঁপড়...। আচমকা হা হা হা করে হেসে উঠলেন বিমল সান্যাল। বললেন- বাহ, বাহ, বুদ্ধিতে আমাকে হারিয়ে দেওয়ার মত গুণী মানুষটি কে? দেখি তাকে, দারুণ বুদ্ধি তো।
গুটিগুটি এগিয়ে এল এক সুবেশ যুবক- আমি রাজা রায়, রায় ক্যাটারিংয়ের মালিক। হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাস করে ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা খুলেছি। এটাই প্রথম কাজ। বিমল সান্যাল তার বাহিনীসহ দুহাত তুলে আশীর্বাদ করলেন রাজা রায়কে। সেই শুরু হল আমাদের পাড়ায় ক্যাটারিংয়ের জয়যাত্রা।