কেমন রংপুর চাই- “জাগো বাহে”
রংপুরের লোকসংস্কৃতি
আনওয়ারুল ইসলাম
🕐 ১১:০২ অপরাহ্ণ, জুলাই ৩০, ২০১৮
‘বাবা কেরামত আলীর দোয়ায় ভরা, ধরলা তিস্তার পলিত গড়া/ বেগম রোকেয়ার স্মৃতিধন্য দ্যাশ হামার রংপুর/ ওরে আইসেন বন্ধুধন গুয়াপান খায়্যা ধরি, ভাওয়াইয়া গানের সুর.’
উত্তরবাংলার একটি সুপ্রাচীন ভূ-খণ্ড এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ-‘রঙ্গপুর’ যার আজকের পরিচয় রংপুর।
এ রংপুর হামার দ্যাশ, ভাওয়াইয়ার দ্যাশ নামে খ্যাত এ রংপুরের আরেক পরিচয় ‘বাহের দ্যাশ’। ‘বাহের দ্যাশ’ নামে খ্যাত এ রংপুর এর প্রাচীন নাম ‘রঙ্গপুর’। ‘রঙ্গ রসে ভরপুর গরিয়সী রংপুর’-এর লোকসংস্কৃতিও দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় অত্যন্ত প্রাচীন এবং হিরন্ময় ঐতিহ্যমণ্ডিত ও সুসমৃদ্ধ। আর এ লোকসংস্কৃতির সূত্রেই রংপুর ‘বাহের দ্যাশ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আমাদের দেশে পুত্র বা পুত্রস্থানীয় কাউকে সম্মোধনের ক্ষেত্রে ‘বাবা হে’ কিংবা ‘বাপু হে’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের সম্মোধন পদই রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায়-বাবা-হে/বাপু-হে থেকে ‘বাহে’ শব্দে রূপান্তর লাভ করেছে এবং কেবলমাত্র পুত্র বা পুত্রস্থানীয়দেরকেই নয় রংপুরের লোকসমাজে যে কাউকে সম্মোধনের ক্ষেত্রে এ ‘বাহে’ শব্দটির বহুল ব্যবহার প্রচলিত হয়। আর এ ‘বাহে’ সম্মোধন সূত্রেই রংপুর অঞ্চলের পরিচিতি (আইডেন্টিটি) হয়ে ওঠে ‘বাহের দ্যাশ’ নামে।
সাধারণভাবে লোকসংস্কৃতি বলতে আবহমান কাল ধরে ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত সাধারণ মানুষের সংস্কৃতিকে বুঝানো হয়ে থাকে। সমাজে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের ঐতিহ্যগত বিশ্বাস, সংস্কার, চিন্তা-দর্শন, ধর্মীয় চেতনা, আচার-আচরণ, জীবন-জীবিকা, পেশা, খাদ্যাভাস, বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছদ, চিত্তবিনোদন, উৎসব, পর্ব, পার্বণ, অনুষ্ঠানাদি সব মিলে সুদীর্ঘকালে গড়ে ওঠা সামগ্রিক জীবনযাপন পদ্ধতি এবং তাদের ব্যবহারিক প্রয়োজনের তাগিদ ও স্বভাবজাত সৌন্দর্যবোধ ও নান্দনিক চেতনাপ্রসূত বস্তুগত ও অবস্তুগত সৃষ্টিসম্ভার (অর্থাৎ-লোকসাহিত্য, সংগীত, চারু ও কারুশিল্প ) ইত্যাদি বিচিত্র উপাদানে সজ্জিত লোকসংস্কৃতির ‘সাতনরীহার’। বস্তুত লোকসংস্কৃতি হচ্ছে একটি সংহত সমাজের ঐতিহ্যগতভাবে সৃষ্ট চিন্তা, বাক ও ব্যবহারিক চর্চার বহিঃপ্রকাশ এবং সামগ্রিক জীবন প্রবাহের প্রতিফলন। এ লোকসংস্কৃতি বহু ও বিচিত্র উপাদানে সমৃদ্ধ। রংপুর তথা রঙ্গপুর ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত প্রাচীন এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে ঐতিহ্যবাহী জনপদ হলেও এর আদি ইতিহাস অনেকটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন। রামায়ন, মহাভারত ও কালিকাপুরাণ ইত্যাদি হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থের কিচ’ কিছু বর্ণনার আলোকে জানা যায়, সুদূর অতীতে ‘রঙ্গপুর’ উত্তর ভারতের প্রাচীন কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর ‘রঙ্গপুর বা রংপুর’ নামকরণের শানে নজুলও খুব একটা স্বচ্ছ নয়।
এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। যেমন-কেউ কেউ মহাভারতে বর্ণিত প্রাচীন কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের প্রথম নৃপতি ভগদত্তের রঙ্গমহলের অবস্থান এ অঞ্চলে ছিল বলে এর নাম রঙ্গপুর এমন মত পোষণ করেন। আবার প্রাচীনকালে এ অঞ্চলের বস্ত্ররঞ্জনী বা রং শিল্পের বিশেষ খ্যাতি অর্জন সূত্রে কিংবা প্রচুর নীল চাষের সূত্রে রংপুর নামকরণের কথাও বলা হয়। যা হোক, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বর্তমান অবধি সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় এ রংপুর কখনো ছিল মহাভারত খ্যাত নরক-ভগদত্তের কামরূপ-প্রাগজ্যোতিষ সাম্রাজ্যের অংশ, মধ্যযুগের অধিকাংশ কেটেছে কামরূপের হিন্দু শাসক আর মুসলিম অভিযানকারীদের রণ-দামামার শব্দে। পরবর্তী সময়ে মোগল, ইংরেজ, পাকিস্তানি শাসনামল পাড়ি দিয়ে ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বশাসিত স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের রূপলাভ করে। বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলা অতীতের বৃহত্তর রঙ্গপুরের একটি খণ্ডিত অংশমাত্র।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।