ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বইয়ের শব্দ দাগ কাটুক হৃদয়ে

অরিত্র দাস
🕐 ৯:৫৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২০

ভাষার মাস। প্রাণের মাস। বাঙালির পবিত্র রক্তে রঞ্জিত গর্বিত ইতিহাসের মাস। ‘ম’ একটি অতীব অর্থবহ শব্দ যেন গোটা বাঙালি ভাষাভাষীদের কাছে। ম মানে মা, মাটি এবং মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় রচিত হয় সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি। আর এ মা, মাটি, মাতৃভাষা, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির ছাঁচে ফেলে প্রত্যেক মানুষকে ভেঙেচুরে তৈরি করে দেয় দেশ।

জীবন দিয়ে সে কাজটি অত্যন্ত সহজ করেছেন শহীদরা। তারা জীবন দিয়েছেন বলেই বাংলাদেশ হয়েছে। হয়েছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। অতঃপর স্বাধীনচিত্তে সাহিত্য রচনা হচ্ছে বাংলা ভাষায়। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য বিশ^সাহিত্য অঙ্গনে অলংকৃত করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্যদিকে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা এনে দিয়েছে হাজার বছরের বাঙালি জাতির দামাল সন্তানরা। নয়ত পরাধীনতার শিকলে বন্দি জীবন দাসত্বে কাটাতে হত ষোল কোটি বাঙালিকে। সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথ এবং বাঙালি জাতি একই বৃন্তে দুটি ফুল। শত শত বছরের শোষণ ও দাসত্ব থেকে মুক্তির এ বারতা এনে দিয়েছে প্রকৃতপক্ষে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন। কেননা ভাষা আন্দোলনের জলন্ত স্ফুলিঙ্গ ৭১ এনে দিয়েছে। ৭১ এনে দিয়েছে স্বাধীনতা। ভাষা একটি শক্তিশালী এবং স্পর্শকাতর আগ্নেয়াস্ত্র। ভাষা নিমিষে একটি জাতিকে আলাদা করে দিতে পারে, ভাগ করে দিতে পারে অঞ্চল যা ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠী কখনো পারে না। সেই ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পৃথিবীর দীর্ঘ সময়ব্যাপী বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে। ১৯৮৪ সাল থেকে এই মেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে যে নামটি তরু লতার মত আষ্টে-পিষ্টে জড়িয়ে আছে, তিনি হলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সঙ্গের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার শুরু করেন। বইগুলো প্রকাশিত হয় তারই হাতে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে। সে বইগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থীদের লেখা। ১৯৭৬ সাল অব্ধি তিনি একাই এ বইমেলা এগিয়ে নিয়ে যান।

তারপর সেই ছোট্ট পরিসরের বইমেলা আস্তে আস্তে আজ বৃহৎ আকারে ধারণ করেছে। প্রকাশকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাড়ানো হয়েছে মেলার পরিধি। ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়। চলতি বছরে মেলায় আটশ’র অধিক প্রকাশনী সংস্থা স্টল পেয়েছে, স্টল পায়নি তাদের সংখ্যাও কম নয়। সেই পরিসংখ্যানে প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাজারের বেশি। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। বইমেলার বিস্তৃতি, লেখক পাঠকের উপচেপড়া সমাগম দেখে অনেকে বলে, বাঙালির প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে বইমেলা। পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়, লেখক প্রকাশক পাঠকদের মহামিলন মেলায় আবর্তিত বইমেলা। সত্যি কি তাই? প্রাণের বইমেলায় প্রাণ কি আদৌ আছে? প্রাণ কেড়ে নেওয়া কি হয়নি?

এই যে অজস্র প্রকাশনী অথচ বই বের করার সময় কোনো প্রকাশনী পাওয়া যায় না। প্রকাশনী পেলেও বই প্রকাশিত হয় না। কারণ কী? কারণ হলো অর্থ। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। পাণ্ডুলিপিতে কী লেখা আছে, আদৌ কিছু লেখা আছে কিনা, ধর্তব্যের বিষয় নয়। ধর্তবের বিষয়, কোমরে কড়ি বেঁধে এ পথে নামতে হবে, সঙ্গে নিতে হবে তেল জল ঘি মাঘন ও মিডিয়া। যাদের টাকা হয়েছে তারাই এখন বই বের করছে। কারণ টাকা থাকলে বই করা ও বইয়ের দামি দামি বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন দেওয়া আজকাল দুধভাত। তাছাড়া বই বের করা এ যুগে একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

ধরুন, একজন বাঙালির বাড়ি গাড়ি অর্থ যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি সব আছে, নিজের লেখা একটা বই নেই- এটা যেন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মেনে নিতে পারে না তাই যেনতেন বই লিখে আলালের ঘরের দুলালরা প্রকাশককে ‘রয়্যালটি’ দিয়ে বই বের করছে। ফলে প্রকাশকরা রয়্যালটি পাওয়ার অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। তাই এখন আর প্রকাশকরা লেখককে রয়্যালটি দেন না। বরং লেখকরা প্রকাশককে রয়্যালটি দেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেলিব্রেটি, তবে তো কোনো কথাই নেই। পাণ্ডুলিপি নেওয়ার জন্য অনেক প্রকাশক মুখিয়ে আছে। কেননা, প্রকাশক চায় বইয়ের কাটতি। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা স্ট্যাটাস একত্রিত করেও বই প্রকাশ করতে দেখেছি, সেই বইয়ের হাজার হাজার কপি বিক্রি হতে দেখেছি। রাতারাতি তারা লেখক উপাধি পেয়েছে। অতঃপর বই রিভিউতে পাঠকদের বলতে শুনেছি, ‘আমার অর্থ ফেরত দেন।’ অথচ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক পরিচালক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ফ. র. আল সিদ্দিকের বই ‘বাঙালির জয়, বাঙালির ব্যর্থতা’ বিক্রি হতে দেখিনি। ২০০০ সালে পরমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটি সম্পর্কে পাঠক জানতে পারে ২০২০ সালের বইমেলায়, তাও সম্ভব হয়েছে তার বই প্রচারের একটি করুণ ছবি ভাইরাল হওয়ার কল্যাণে। অর্থাৎ ভাইরাল শব্দটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ দেশের সাহিত্যপাড়ায়। ভাইরাল হওয়ার জন্য ভদ্রলোককে অপেক্ষা করতে হয়েছে বিশটি বছর।

কিছু প্রকাশনী অবশ্য আছে, যারা অর্থ নয়, সেলেব্রেটি নয়। লেখার মানের ওপর ভিত্তি করে বই প্রকাশ করে। তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। ফলে বাংলা সাহিত্যের মান বাড়ছে না। বাড়ছে লেখকের সংখ্যা, প্রকাশকের সংখ্যা। লেখক হতে গিয়ে অর্থলোভী প্রকাশকের লালসার শিকার হচ্ছে তরুণ লেখকরা। প্রতারিত হচ্ছে। প্রকাশক তাদের পাণ্ডুলিপি নিয়ে বই ছাপাচ্ছেন না। লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়েও বই প্রকাশ করছেন না। অনেক প্রকাশক আগ্রহভরে পাণ্ডুলিপি জমা নিয়ে, বই বের করবেন বলে আশ্বাস দিয়েও বই বের করছে না। কারণ যারা টাকা দিয়েছে তাদের বই আগে বের করতে হবে। এবং তাদের বই বইমেলায় আনতে আনতে আশান্বিত লেখকের বই আর আলোর মুখ দেখে না। পাঠকের কাছে বই তুলে ধরতে পারে না। ফলে হতাশার কালগ্রাসে, ব্যর্থতা প্রত্যাখানের কড়াঘাতে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রতিভাবান লেখক। এর মূল কারণ, এ দেশে প্রকাশকরা সেলিব্রেটি ও পয়সাওয়ালা নিয়ে কাজ করতে অতিমাত্রায় আগ্রহী। একটা সময় লিখতে লিখতে একজন ব্যক্তি লেখক হয়ে উঠত, এখন সেলিব্রেটি থেকে লেখক হয়। হাজার হাজার টাকা ব্যয়ে বইয়ের বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে দিয়ে লেখক হওয়া যায়। বাংলাদেশের লেখক বলতে এখন ধনী সম্প্রদায়। অর্থ, মিডিয়া ও সামাজিক জনপ্রিয়তা এখানে লেখক প্রসব করে।

অন্যদিকে বাঙালির চিন্তা করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তারা চিন্তার চেয়ে বলতে চায় বেশি, তাদের লেখার চেয়ে প্রচারণায় ঝোঁক থাকে বেশি। অন্যদিকে এ প্রজন্মের পাঠকের কাছে মোটিভেশনাল বই অধিক পছন্দের লক্ষ্যবস্তু। এ থেকে প্রতীয়মান যে, এক বিশাল শ্রেণি অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত। যে বীরের জাতি রক্ত দিয়ে আন্দোলন করেছে, সংগ্রাম করেছে, একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। সেই জাতি হঠাৎ করে মোটিভেশনাল বইয়ের বাজারে ভীড় জমাচ্ছে কেন- সেটা গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। উদ্বেগের জন্ম দেয়, এদেশের নতুন প্রজন্ম ভালো বই ও ভালো লেখক থেকে কেন বঞ্চিত হচ্ছে?

আমাদের প্রকাশকরা বই প্রকাশকে বাণিজ্য ছাড়া খুব বেশি দূর ভাবতে শেখেননি। ফলে বইয়ের বাজার বাণিজ্যিক এবং মানহীন বইয়ে ঠাসা। যার কারণে কাঁধে ঝুলি ব্যাগ নিয়ে বইমেলার একটি স্টল থেকে অন্য স্টলে ঘুরে বেড়াতে হয় শিক্ষিত মেধাবী লেখকদের। ঘুরতে হয় প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে। এটা এ জাতির জন্য লজ্জার। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথাটা মনে পড়ে গেল, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না। আসলেই জন্মায় না। জন্মায় আমলা। এবং আমলাদের সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়।

ফিরে যাই পূর্বের কথায়। ভাইরাল হওয়ার পর একদিন খবরের কাগজে এল ফ. র. আল সিদ্দিকের বই ‘বাঙালির জয়, বাঙালির ব্যর্থতা’ প্রকাশে আগ্রহী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এতে অনেকেই দেখেছি উচ্ছ্বসিত, আমি তখন বিব্রত। এখানে সার্থকতার তো কিছু নেই। বাহবা পাওয়ারও কিছু নেই। বরং লজ্জিত হওয়ার, ঘৃণা করার এবং পরিহাস করার অনেক কিছু আছে। নিগূঢ় সত্য হলো, এই যে প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসছে, তার পেছনে অন্যতম কারণ প্রবীণ বিজ্ঞানী ড. ফয়জুর রহমান আল সিদ্দিকের এখন পাবলিসিটি হয়েছে। একটি ছবি ভাইরাল হয়ে তাকে রাতারাতি সেলেব্রিটি বনে পাঠিয়েছে। তার বই বিক্রি হওয়ার এখন সম্ভবনা বেশি। তিনি এখন সোনার ডিমপাড়া হাঁস। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো তো তার পেছনে ছুটবেই। সোনার ডিমপাড়া হাঁসের পেছনে ছুটে বেড়ানোই তাদের ধর্ম।

এ দেশে যারা লেখালেখি করেন, তারা জানেন- প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো কেমন! এ চরিত্র যে নতুন তা কিন্তু নয়। অনেক পুরনো। তবে পুরনো হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রকাশক মহাদয়রা লেখার মান বিচারের ওপর ভিত্তি করে অর্থ নির্ধারণ করতেন বা করতেন না, বিংশ শতাব্দীর সিংহভাগ প্রকাশকরা অর্থের মানদণ্ড বিচার করার পর লেখার মান নির্ধারণ করেন। তারা সাহিত্য বোঝে না, কবিতা বোঝে না, প্রবন্ধ বোঝে না; বোঝে অর্থ! তারা লেখকের কষ্ট বোঝে না, পরিশ্রম বুঝে না; বোঝে লেখকের পাবলিসিটি।

ফলশ্রুতিতে প্রকাশনী সংস্থাগুলো রীতিমতো একটা লাভজনক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ফলে ধনকুবের ব্যবসায়িক নবাগত হাইব্রিড রাজনৈতিক নেতার কাছে তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতারা যেমন অবমূল্যায়িত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি পয়সাওয়ালা সস্তা মৌসুমি লেখকের কাছে মেধাবী লেখকরা হারিয়ে যাচ্ছে। একদিকে হচ্ছে নেতৃত্বশূন্য দেশ, অন্যদিকে মেধাশূন্য সাহিত্য জগৎ।

প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’ কথাটা পাঠকদের বেলায় সত্য হলেও লেখকদের বেলায় সত্য নাও হতে পারে। কেননা, বই প্রকাশ করে বাংলার অনেক লেখকরা হারিয়ে গেছে বা দেউলিয়া হয়েছে। এখনো যাচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতেও যাবে। নয়তো অর্থাভাবে মৃত্যুবরণ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। কারণ এ দেশে প্রকাশকরা লেখকদের রয়্যালটি দিতে চান না এবং সাধারণত রয়্যালটি দেন না। জনপ্রিয় লেখক না হলে রয়্যালটি প্রত্যাশা করাও যেন মস্ত বড় পাপ। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কথাই বলা যাক। তার বই প্রকাশ করে প্রকাশকরা আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠলেও নজরুল তার জীবদ্দশার সচ্ছলতার মুখ দেখেননি। অনিশ্চিত জীবিকা ও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিভিন্ন প্রকাশক, সম্পাদক ও বই পসারির কাছে অর্থ চেয়ে জীবনানন্দ দাশের লেখা চিঠির অনুনয়-বিনয়ের কথা কারও অজানা নয়। অজানা নয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। দারিদ্র্যের কারণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার স্ত্রীর গহনা বন্ধক রেখেছিলেন। এছাড়া বাসা ভাড়া বাকির জন্য একবার বাড়ির মালিক তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলো। তাই হয়ত জীবিত অবস্থায় সাহিত্য অঙ্গনে খ্যাতির শীর্ষে থেকেও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন- ‘দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’ কিন্তু তার বই বিক্রি করে প্রকাশকরা পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করেছে। এখনো বইমেলায় তাদের বই সর্বোচ্চ বিক্রির তালিকায়। এ সংস্কৃতি থেকে কবে বাংলা সাহিত্য মুক্তি পাবে?

যদিও বইমেলাকে বাঙালির উৎসব বলা হয় আজকাল। কিন্তু উৎসব কি কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারে? উৎসব তো সর্বজনীন। উৎসব মানে হৈ-হুল্লোড়। উৎসব মুক্তি ও উদারতার কথা বলে। অথচ কিনা বইমেলাকে বলা হয় উৎসব! বইমেলায় কোনো বই নিয়ে আলোচনা নেই, সমালোচনা নেই, নেই তর্ক-বিতর্ক। জাঁদরেল লেখক নেই, আলোচনা সমালোচনা হবে কার বই নিয়ে? বইমেলায় হৈ-হুল্লোড় নেই। বইমেলা ঘুমায়।

লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে একটা দূরত্ব সর্বত্র। এখন বই লিখতে লেখকরা ভয় পায়। আলোচনায় কথা বলতে চায় না, কোন কথায় কখন মামলা, কখন চাপাতির কোপ পড়ে। এ বইমেলা থেকে ফেরার পথে সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদকে কোপানো হয়, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় খুন হন, খুন হয়েছেন অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং আক্রমণের শিকার হয়েও বেঁচে গেছেন আরেক প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল। রাজিব, দ্বীপ, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নিলয়কে লেখালেখির জন্য হত্যা করা হয়েছে। অনেক লেখক ও ব্লগারকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। পালিয়ে যাচ্ছেনও। প্রকাশকরা মুক্তচর্চার বই ছাপাতে চাচ্ছেন না। অন্যদিকে হারিয়ে যেতে বসেছে লিটল ম্যাগাজিন বা স্পার্ক জেনারেশন। তাদের দিকে কারো কোনো নজর নেই। উদ্যোগ নেই। অযত্ন অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে মৃতপ্রায় লিটন ম্যাগাজিন। অথচ একসময় বাংলা সাহিত্যকে রস জোগাতো এ লিটল ম্যাগাজিন। কবি লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিকদের আড্ডা মানেই লিটন ম্যাগাজিন চত্বর, এখন সেটা নেই। তাহলে কী করে বলব, বইমেলা প্রাণের মেলা? বইমেলা উৎসব!

বইয়ের শব্দ মানবহৃদয়ে দাগ কাটুক। মনুষ্যত্ব হোক শব্দের আধার। এ আশায় বুক বাঁধি, আশা করতে কোনো পাপ নেই, ভয় নেই। তাই আশা করি, এ দেশে কোনো একদিন একটা সাহিত্য বিপ্লব ঘটবে। মেধাবীদের মূল্যায়ন হবে। শব্দের প্রতিবাদ হবে শব্দ দিয়ে। প্রকাশক এবং লেখকের মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে। প্রতিক্রিয়াশীল বই ও প্রতিক্রিয়াশীলরা দমে যাবে। পাঠকরা ভালো বইয়ের স্বাদ ও সন্ধান পাবে। হুমায়ুন আজাদ যেমনটি বলেছিলেন ‘বই’ নামক কবিতায়- যে-বই তোমায় দেখায় ভয়, সেগুলো কোনো বই-ই নয়/ সে-বই তুমি পড়বে না/ যে-বই তোমায় অন্ধ করে, যে-বই তোমায় বন্ধ করে/ সে-বই তুমি ধরবে না।

অরিত্র দাস : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper