ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শিল্প-সাহিত্যে ভাষাযুদ্ধ ও মুক্তিগাথা

শফিক হাসান
🕐 ১২:২৬ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২০

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১-এর পথপরিক্রমা বাঙালি জীবনের মহাকাব্যিক আখ্যান। একসাগর রক্ত ঝরিয়ে আসে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। মুক্তি ও ভাষাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তিনটি মাস অবিস্মরণীয়। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও ডিসেম্বর। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নানাভাবেই উঠেছে এসেছে ৫২ ও ৭১-এর মর্মন্তুদ অধ্যায়। সৃজনের বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখার আয়োজন আজকের বিবিধ। গ্রন্থনা করেছেন শফিক হাসান---

মুক্তিযুদ্ধের সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র

মুক্তিযুদ্ধ ও মহান স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে বহু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সাড়াজাগানো কয়েকটি চলচ্চিত্রে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত...ওরা ১১ জন
মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম এবং সবচেয়ে সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন। ১৯৭২ সালে ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু অংশ দেখানো হয়েছিল এতে। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, খসরু, সৈয়দ হাসান ইমাম ও খলিলউল্লাহ খান প্রমুখ।

অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর নির্মিত এ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত পরিচালক সুভাষ দত্ত। এর তিনটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন চিত্রনায়িকা ববিতা, নায়ক উজ্জ্বল ও আনোয়ার হোসেন। বিষয়বস্তুগত দিক থেকে ছবিটিকে সে সময় একেবারেই অন্যরকম বলে মন্তব্য করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা।

আলোর মিছিল
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ ছবি মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। এটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা। এ ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারুক, ববিতা, রাজ্জাক ও সুজাতা।

আগুনের পরশমণি
১৯৯৪ সালে ছবিটি নির্মিত হয় কথাসাহিত্যিক, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের হাতে। সরকারি অনুদানে তৈরি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিটি আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর। আরও ছিলেন বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, ডলি জহুর ও হুমায়ূন কন্যা শিলা আহমেদ।

হাঙ্গর নদীর গ্রেনে
সেলিনা হোসেনের রচিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প ‘হাঙ্গর নদীর গ্রেনেড’ অবলম্বনে ১৯৯৭ সালে একই নামে ছবি নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। এ ছবিতে রয়েছে একজন সন্তানহারা মায়ের গল্প। যে চরিত্রটি করেছিলেন চিত্রনায়িকা সুচরিতা। এছাড়া ছবির বিভিন্ন চরিত্রে আরও আছেন সোহেল রানা, অরুণা বিশ্বাস, অন্তরা ও ইমরান।

মুক্তির গান
তারেক মাসুদ এবং তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলা প্রামাণ্য চিত্র এটি। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। এটি দক্ষিণ এশিয়া চলচ্চিত্র পুরস্কারে বিশেষ উল্লেখ পুরস্কার এবং ২০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।

এখনো অনেক রাত
১৯৯৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। এটি পরিচালনা করেন খান আতাউর রহমান। এটি তার পরিচালিত শেষ চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এতে। এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারুক, সুচরিতা, আলীরাজ, ববিতা ও পরিচালকের ছেলে কণ্ঠশিল্পী আগুন।

শ্যামল ছায়া
হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ছবি এটি। মুক্তি পেয়েছিল ২০০৩ সালে। এ ছবিতে মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে দেখা গিয়েছিল কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদিকে। আরও ছিলেন নায়ক রিয়াজ, মেহের আফরোজ শাওন, স্বাধীন খসরু, শিমুল, চ্যালেঞ্জার, ফারুক আহমেদ, ডা. এজাজ ও তানিয়া আহমেদ।

জয়যাত্রা
এটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০৪ সালে। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেনের কাহিনী নিয়ে এ ছবির সংলাপ, চিত্রনাট্য লেখা ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন তৌকীর আহমেদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন একদল মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মৃত্যু ও বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প আছে এখানে। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন আজিজুল হাকিম, বিপাশা হায়াত, মাহফুজ আহমেদ, হুমায়ূন ফরীদি, তারিক আনাম খান, আবুল হায়াত ও চাঁদনী।

গেরিলা
নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ২০১১ সালে। মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মিতে নির্মিত এ ছবিটিতে অভিনয় করেন সহস্রাধিক শিল্পী। প্রধান চরিত্রে ছিলেন জয়া আহসান ও ফেরদৌস। অন্য শিল্পীরা হলেন- এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা ও গাজী রাকায়েত।

আমার বন্ধু রাশেদ
২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। মুহম্মদ জাফর ইকবালের শিশুতোষ উপন্যাস থেকে এটি পরিচালনা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। অভিনয় করেছেন চৌধুরী জাওয়াতা আফনান। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন- রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইনামুল হক, হোমায়রা হিমু ও ওয়াহিদা মল্লিক জলি। শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছেন- রায়ান ইবতেশাম চৌধুরী, কাজী রায়হান রাব্বি, লিখন রাহি, ফাইয়াজ বিন জিয়া, রাফায়েত জিন্নাত, কাওসার আবেদীন।

একাত্তরের যীশু
শাহরিয়ার কবিরের উপন্যাস অবলম্বনে ‘একাত্তরের যীশু’ নির্মাণ করেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মুক্তি পায় ১৯৯৩ সালে। অভিনয় করেছেন পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ুন ফরীদি, জহির উদ্দিন পীয়াল, আবুল খায়ের, আনোয়ার ফারুক, কামাল বায়েজীদ ও শহীদুজ্জামান সেলিম।

ফাদার মারিনো রিগন বিদেশি বন্ধু
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত ইতালিয়ান নাগরিক ফাদার মারিনো রিগনের ঘটনাবহুল জীবনকে আখ্যান করে নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র ‘দ্য ফাদার : এন আনটোল্ড স্টোরি’। কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের চিত্রনাট্যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করছেন হেমন্ত সাদীক। সম্প্রতি ফাদারের ৯৫তম জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে চলচ্চিত্রটির কলাকুশলী ও ফাদার রিগানের ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে একটি অনাড়ম্বর স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে চলচ্চিত্র সংসদ সিনেমা বাংলাদেশ ও ঢাকাস্থ ইএমকে সেন্টার।

ফাদার রিগনই প্রথম ব্যক্তি, যিনি বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতাধিত বই সরাসরি বাংলা থেকে ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করেছেন লালনের ৩৫০টি গানও।

একজন দেশপ্রেমিক বাঙালির মতো যুদ্ধপীড়িত সাধারণ মানুষ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও চিকিৎসা দিয়েছেন। মানবসেবা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ড অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে প্রদান করেছে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব।

মুক্তিযুদ্ধে তার অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য বাঙালি জাতির শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ ২০১২ সালে তাকে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা।
তার উদ্যোগে ইতালিতে একাধিক বাংলা নাটক ও নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নামে ইতালির একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণ করেছেন তিনি। মোংলা, বাগেরহাট, খুলনা, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে তুলেছেন ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এসব প্রতিষ্ঠানের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন বৃত্তিরও। দুঃস্থ নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য গড়েছেন সেলাই কেন্দ্র। ফাদার রিগান বার্ধক্যজনিত কারণে ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর ৯২ বছর বয়সে ইতালির ভিসেনজায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ২১ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মোংলার শেলাবুনিয়ায় সমাহিত করা হয়।

চিত্রকলায় মুক্তিযুদ্ধ
চিত্রকলাতেই বাংলার মুক্তি সংগ্রামের প্রথম প্রকাশ ঘটে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নিউ বেঙ্গল স্কুল’ ছিল ব্রিটিশ শাসনের (শিক্ষা) বিপরীতে বাংলা তথা ভারতের স্বকীয়তার সন্ধান। স্বদেশী আন্দোলনকে এরপর গানে গানে ভরিয়ে তোলেন বাংলার নগরবাউলরা। যামিনী রায় সে সংগ্রামেরই আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া যা পরবর্তীকালে জয়নুলের ‘পাইনার মা’ বা অন্যান্য চিত্র। কামরুল হাসান ও কাইয়ুম চৌধুরী তাকে এগিয়ে নিয়েছেন আরও।

বিষয় বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের শিল্পকলাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ক. ৫২ থেকে ৭১-এর মুক্তি সংগ্রাম ও সংগ্রাম প্রাণিত শিল্পকলা; খ. মুক্তিযুদ্ধকালীন শিল্পকলা গ. যুদ্ধ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কিংবা মুক্তিযুদ্ধ প্রাণিত শিল্পকলা।

১৯৪৮-এ ঢাকা আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠাই ছিল ‘পাকিস্তানি ইসলামি’ ধারণার বিপরীতে একটি সংগ্রাম। ৪৮-এ যখন বাংলাভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি তৎপরতা শুরু হয় তখন থেকেই এ স্কুলের ছাত্ররা ছিল সে তৎপরতার বিরুদ্ধে। ১৯৫২ সালে তাই এ স্কুলের ছাত্রদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল অবশ্যম্ভাবী।

সে সব পোস্টার ফেস্টুন আজ কালের গর্ভে বিলীন। তবে মুর্তজা বশীর ও বিজন চৌধুরীর রেখাচিত্র ও লিনোকাট ইতিহাসের দলিল। ৪৮ থেকে ৭১ এর মার্চ পযন্ত যত রাজনৈতিক পোস্টার, প্লাকার্ড, ফেস্টুন, দেয়াল লিখন, মঞ্চসজ্জা তার সবই মুক্তিযুদ্ধের শিল্পকলার অংশ। সবই কালের গর্ভে বিলীন হলেও কিছু নমুনা রয়ে গেছে সাদাকালো আলোকচিত্রে ও কিছু প্রকাশনায়।

হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদের ‘একুশের শহীদ মিনার’ এ সময়কালের কিংবা চিরকালের ‘মুক্তিযুদ্ধের শিল্পকলা’র অনন্য উদাহরণ। পাকিস্তানি ‘ইসলামী আরবি লিপিকলা’ বিপরীতে ‘বিমূর্ত’ চিত্রকলার চর্চার পথ খুঁজে নেওয়াকে বিবেচনায় নিলে মুর্তজা বশীরের ‘দেয়াল’ চিত্রমালা আলোচনার দাবি রাখে।

তবে জয়নুলের ‘পাইনার মা’ কিংবা ‘সংগ্রাম’, ইত্যাদি সমকালীন বাংলার মুক্তি সংগ্রামের অনন্য চিত্রভাষ্য। মুজিবনগর সরকার বা অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রচার ও প্রচারণা বিভাগের পোস্টার লিফলেট ডাকটিকিট ইত্যাদি। যদিও এসব সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তবে মান প্রশ্নে এগুলোর তুলনা বিশ্ব ইতিহাসেই বিরল। মুক্তিযোদ্ধাদের অঙ্কন আজও সংগ্রহ করা হয়নি। অর্থ সংগ্রহ ও প্রচারণামূলক প্রদর্শনীর চিত্রকর্মসমূহও উল্লেখের দাবি রাখে। এসব প্রদর্শনী আয়োজনে তৎকালীন তরুণ চিত্রকর স্বপন চৌধুরীর নাম উল্লেখযোগ্য অবশ্যই। এসব প্রদর্শনীতেই প্রধান চিত্রকরদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম চিত্রকর্মটির সন্ধান মেলে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক শিল্পকলা : যোদ্ধা ছিলেন না কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বা যোদ্ধাদের নিয়ে চিত্র ভাস্কর্য করছেন যুদ্ধে অংশ নিতে না পারার যন্ত্রণায় এমন বিবেচনায় মুর্তজা বশীরের ‘এপিটাফ’ চিত্রমালা ও আব্দুল্লাহ খালীদের ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’র (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৯) কথা সর্বাগ্রে আসে।

জনকের মুখ

সাল ১৯৭৫। প্রত্যন্ত গ্রামের একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে থাকেন সোলেমানের মা, যে সোলেমান মারা গেছে মুক্তিযুদ্ধে, ১৪ আগস্টে। সেদিন থেকেই এ মা আর আঙিনার ফুলের সুবাস পায় না। পায় না পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণ। গত তিন বছরের মতো সেবারও ছেলের মৃত্যুর দিনে মা ফিরনি রাঁধে। কিন্তু পুড়ে যায় সেই ফিরনি। এ কি কোনো অশুভ সংকেত? ১৫ আগস্ট ভোররাতে সেই মা স্বপ্নে দেখে, তার সন্তান মরে পড়ে আছে।

কালো কাপড়ে আচ্ছন্ন তার সারা শরীর। ঘুম ভেঙে উঠে বুক ধড়ফড় করে মায়ের। তিনি ভাবেন, তার একটাই সন্তান। দুবার মারা যায় কীভাবে? বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় ও মুজিব বর্ষ উদ্?যাপন কমিটির আর্থিক অনুদানে নির্মিত ছবিটি পরিচালনা করেছেন মান্নান হীরা।

ফারজানা ছবি বলেন, বেশকিছু দৃশ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার কাল্পনিক কথোপকথন দেখানো হয়েছে। এ চরিত্রের বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং অসীম শক্তির মাঝে আমি ব্যক্তি ছবিকে ভুলে ছিলাম। আমাকে বয়স এবং চিন্তায় অনেকটা সামনে এগোতে হয়েছে। কিন্তু গল্পের সময়টা আবার পেছনের, আমার অদেখা। সেসব অনুভব ধারণ করা আমার জন্য এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা, আর অভিনয় জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি।

পরিচালক জানান, কাজটি যেমনভাবে করতে চেয়েছিলেন, সেভাবেই হয়েছে। আগামী মার্চে দেশের মানুষ দেখতে পারবে ‘জনকের মুখ’। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত একজন শহীদের মায়ের জীবনের ছবি আঁকা হয়েছে এ চলচ্চিত্রে। সন্তান মারা যাওয়ার পর যার একমাত্র আস্থা, শক্তি আর অবলম্বন ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের স্বেচ্ছাশ্রমিক
মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী সমাধিসৌধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন শেখ মতিউর রহমান। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ফেরি করে মাছ বিক্রি করেন তিনি। তারপর চলে আসেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কাছে। কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করেই। তার স্বেচ্ছাশ্রম ও দেশপ্রেমের কথা বলেছেন খোলা কাগজকে...

একজন মানুষ যদি মন থেকে নিজেকে বাঙালি ভাবেন, আত্মপরিচয়ে গর্ববোধ করেন তাহলে অবশ্যই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান করবেন, তাদের স্মরণ করবেন কৃতজ্ঞচিত্তে। বিশেষ করে যার ডাকে পরাধীন নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি স্বাধীনতার নেশায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই সংগ্রামী মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে আজীবন স্মরণ করতেই হবে। যারা জীবন উৎসর্গ করে স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছেন সেই বীর সন্তানদের কাছে আমরা চিরঋণী। এ ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না। প্রত্যেক বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবো।

আমরা যার যার অবস্থান থেকে যদি সোনার বাংলা গড়ার জন্য একে অন্যকে সহযোগিতা না করি তাহলে শহীদদের আত্মা কষ্ট পাবে। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুকে এবং তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের ভালোবেসে থাকি, তাহলে তারা যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছেন আমরা যেন সেই কাক্সিক্ষত বাংলা অবশ্যই গড়ে তুলতে পারি। তাহলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ইচ্ছে করলেও দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পাই না।

যা করতে চাই অর্থের অভাবের কারণে করা সম্ভব হয় না। ভূমিহীন কৃষকের সন্তান তবে আমি কখনো নিজেকে ভূমিহীন মনে করিনি। মনে করি, পুরো বাংলাদেশই আমার। দেশটা যারা স্বাধীন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন আমরা তাদের কতটুকু দিতে পেরেছি।

দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পাইনি বলে যারা শহীদ হয়েছেন আমি যদি তাদের সমাধিস্থল পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে কিছু করে, সমাধির পাশে চারা রোপণ করে পবিত্রতা রক্ষা করতে পারি তাহলে হয়ত কিছুটা ঋণ শোধ হবে। মনকে বোঝাতে পারব, দেশের জন্য যারা জীবনটাকে উৎসর্গ করেছেন তাদের একটু হলেও সেবা করতে পেরেছি। আমি প্রতিদিন ভোরে কারওয়ান বাজারে গিয়ে কিছু মাছ কিনে আনি। তারপর মাথায় করে বিক্রি করে জীবন-জীবিকা চালিয়ে নিচ্ছি। মাছ বিক্রির শেষে বাসায় ফিরি।

স্নানাহার শেষে আমার প্রচণ্ড ঘুম আসে। সেই ঘুম ত্যাগ করে সূর্যসন্তানদের সমাধিস্থল মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অনেক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি। এখানে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় অপমান অপদস্থও হতে হয়েছে। মনে করি, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা শুধু তাদের পরিবারের নন। তারা দেশের, জনগণের। তাদের সমাধিস্থল সুন্দর করে রাখা আমাদের দায়িত্ব। দরিদ্রতার কারণে যেভাবে চাই তেমন সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে পারছি না। আবার মাঝে-মধ্যে বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

তখন কষ্ট পেয়ে শহীদদের কবরের দিকে তাকিয়ে নীরবে কাঁদি। কিছুক্ষণ কান্নার পর মনে আবার শান্তি ফিরে আসে। অনেক সময় আমি যখন কাজ করি, আমার আল্লাহ ও কবরবাসী ছাড়া পাশে কেউ থাকে না। তারপরও আমার কেন জানি ভয় আসে না। ভয় শুধু একটা জায়গাতেই- কতিপয় জীবিত মানুষকে নিয়ে! যারা আমাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয় না, ভালোবাসতে দেয় না। যারা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন আমি তাদের যেন স্বাধীনভাবে ভালোবাসতে পারি, শ্রদ্ধা করতে পারি।

উল্লেখ্য, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান এবং বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান শুয়ে আছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। এ দুজনকে বিশেষভাবে এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর সমাধিসৌধে আমি কাজ করছি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। জাগতিক কোনো প্রাপ্তির জন্য নয়, এটা আমার আনন্দের, ভালোবাসার জায়গা!

কথাসাহিত্যে যুদ্ধ আখ্যান
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের সূচনা হয় ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী সময় থেকে। ১৯৫২ সালকে এর সূতিকাগৃহ বলা চলে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনায়াসে ঢুকে পড়ে। যা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ-লড়াই একই বিন্দুতে এসে পৌঁছে। কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক-প্রস্তুতি পূর্ব কিংবা এর পটভূমি হিসেবে স্বাধীনতা-উত্তর সময়কে বিবেচনা করা হয়। কেননা প্রথম দিকের কথাসাহিত্যগুলোতে সময়ের প্রতিফলন দেখা যায়। যেখানে স্বাধীন-সার্বভৌম স্বদেশের যে স্বপ্ন ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুক্তির আকাক্সক্ষা এবং এর ক্রিয়াশীলতা কথাসাহিত্যে উপস্থিতির কারণে ভাষা আন্দোলন থেকেই স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ের বিভিন্ন আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পর্বগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়।

ভাষা আন্দোলনকে উপলক্ষ করে যে কথাসাহিত্য প্রকাশিত হয়, সর্বপ্রথম উল্লেখ করতে হয় জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯)। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করতে গিয়ে তরুণদের যে কারাবরণ ও তাদের মর্মন্তুদ কাহিনি। আরেকটি উপন্যাস শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’। ১৯৭৫-এ প্রকাশিত আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’-এ প্রতীকী ভাষায় প্রকাশ পায় ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে মিছিলবিমুখ স্বামীর সংসার থেকে বের হয়ে একটি বোবা মেয়ে মিছিলে যোগ দেয়। ‘বাঙলা’ উচ্চারণে ফিরে পায় তার বাকশক্তি। রাবেয়া খাতুনের ‘রাজাবাগ’ (১৯৫৪) ও শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ (১৯৬৩), সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ’ও প্রণিধানযোগ্য।

১৯৭১-এ লিখিত আনোয়ার পাশার আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ (১৯৭৩)-এর কথা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রশীদ করীমের ‘আমার যত গ্লানি’ (১৯৭৩) উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী উপন্যাস। লেখকের আরেকটি উপন্যাস ‘অন্ধ কথামালা’ (১৯৮২), যা মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা বাহিনীর অভিযানের অভিজ্ঞতায় রচিত। মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ (১৯৭৬) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে শওকত আলীর উপন্যাস ‘যাত্রা’ (১৯৭৬)। একই বছর বেরোয় সেলিনা হোসেনের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’। হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ (১৯৭৪), ‘সৌরভ’ (১৯৭৮), ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৮৬), ‘জোছনা ও জনীর গল্প’ (২০০৪) উপন্যাসগুলো উল্লেখযোগ্য।
তথ্যঋণ : হামিদ রায়হান

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper