ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের স্মৃতি

অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু
🕐 ৯:৩০ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুরের বোর্ড বাজারে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষে ২০০ জন ছাত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ভর্তির আবেদনে ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল পাঁচ পয়েন্ট। অর্থাৎ এসএসসি এবং এইচএসসিতে একটিতে প্রথম বিভাগ ও একটিতে ২য় বিভাগ বাধ্যতামূলক ছিল। তখন ছাত্রদের বৃত্তি হিসেবে ওআইসি থেকে ১৫০ মার্কিন ডলার বৃত্তি পাওয়ার কথা শুনে আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ছিলেন ড. এন এম মমতাজ উদ্দিন চৌধুরী। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কতিপয় পদক্ষেপ আমাদের হতবাক করে। ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে স্বাধীনতাবিরোধী একটি বিশেষ সংগঠনকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ প্রদান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ না দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবে ১০০ নম্বরের ইসলামি ও আরবি শিক্ষা গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করতে না দেওয়া, অমুসলিম ও ছাত্রীদের ভর্তির সুযোগ না দেওয়া, ভর্তি ক্ষেত্রে মাদ্রাসা ছাত্রদের আসনের ৭৫ শতাংশ সংরক্ষণ রাখা প্রভৃতি। ক্যাম্পাসে ছাত্র-রাজনীতি করার সুযোগ না দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করারও সুযোগ ছিল না।

১৯৮৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বিজয় দিবসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো কর্মসূচি গ্রহণ না করলে আমরা ছাত্ররা প্রতিবাদ জানাই। আমরা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে গাড়ির ব্যবস্থা করতে বললে ভিসি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনকে অনৈসলামিক ফতোয়া দেন। তিনি ঘোষণা দেন স্মৃতিসৌধে যারা ফুল দিতে যাবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গাড়ির ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আমরা ছাত্ররাই চাঁদা দিয়ে একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করে সাভারে স্মৃতিসৌধে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এতে উপাচার্য আমাদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন। এর কয়েকদিন পরই ১৯৮৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শহীদ দিবসের পূর্বেই বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনারের দাবি জানাতে গেলে ভিসি চরমভাবে আমাদের তিরস্কার করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি প্রদান করলে ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সুস্পষ্ট জানিয়ে দেই, ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার নির্মাণ না করলে আমরা ছাত্ররা নিজ উদ্যোগেই শহীদ মিনার নির্মাণ করব।

এ দাবিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির নিকট স্মারকলিপি প্রদান করি। ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বেই ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি জানিয়ে যে চারজন স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছিলাম উপাচার্য আমাদের ডেকে নিয়ে কঠোর ধমক দেন। সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে না। এটা ইসলামবিরোধী। এ ব্যাপারে যারা বাড়াবাড়ি করবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে। একপর্যায়ে উপাচার্যের সঙ্গে আমাদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।

১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হককে প্রধান অতিথি করে সেই শহীদ মিনার উদ্বোধনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। প্রগতিশীল সকল ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগের দিন ১৯ ফেব্রুয়ারি আকস্মিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং আবাসিক ছাত্রদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। কিন্তু আমরা সেই নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে হলেই অবস্থান করি। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ২০ তারিখের পরবর্তে ১৯ তারিখ রাতের মধ্যেই শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছে শহীদ মিনারের স্থান নির্বাচন করা হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সন্ধ্যায় আমরা নিজেরাই ইট, বালু, সিমেন্ট সংগ্রহ করে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু করলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ জনগণ আমাদের সহযোগিতা করেন।

ভিসির নির্দেশে হল প্রভোস্ট তাহির আহমেদ স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফদের নিয়ে বাধা দিতে এলে ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে তিনি পিছু হটেন। এ সময় উত্তেজিত ছাত্ররা স্যারের বাসায় হামলা চালায়। এ ঘটনায় পরবর্তীকালে তিনি আমাকে প্রধান আসামি করে আমাদের ১২ জনের বিরুদ্ধে জয়দেবপুর থানায় শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে শহীদ মিনার নির্মাণ বন্ধ করতে চেষ্টা চালায়। ঘটনার বাস্তবতা উপলব্ধি করে পুলিশ প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে। আমরা সারা রাত জেগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহীদ মিনার নির্মাণ করি। পরদিন ২০ ফেব্রুয়ারি প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করেন। এ সময় কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

পরদিন জাতীয় সকল পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে সংবাদটি প্রকাশিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার নির্মাণ করায় আমরা যে চারজন শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি জানিয়ে আবেদন করেছিলাম তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করার কথা উপাচার্য মিডিয়ায় প্রকাশ করেন। শহীদ মিনারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের বহিষ্কারের ঘটনায় সারা দেশে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপির চেয়ারম্যানপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতি ও ছাত্র সংগঠনের চাপের মুখে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। কিন্তু কয়েক মাস পর বিভিন্ন ইস্যুতে শহীদ মিনারের সঙ্গে জড়িত আমি, রাজ্জাক, সোহেল, শিপন, সেলিম, কালামসহ ২০ জনের প্রমোশন বাতিল করা হয়।

এ ঘটনায় ক্যাম্পাসে ব্যাপক আন্দোলনের ফলে সরকার উপাচার্য মমতাজ উদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলামকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করা হয়। সিরাজ স্যার ভিসি নিযুক্ত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যাপক আয়োজনে ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করে।

উল্লেখ্য, একদিন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের অভিযোগে বহিষ্কার হয়েছিলাম রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে দীর্ঘ এক যুগ পর কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০০০ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেছিলেন। পরম সৌভাগ্য, প্রধানমন্ত্রী ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে তার সফরসঙ্গী হিসেবে আমাকে সেই অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছে। ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়ায় আজ শুধু শহীদ মিনারই নির্মাণ নয়, সংস্কৃতিচর্চার চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে।

মো. শাহজাহান আলম সাজু : সাধারণ সম্পাদক
স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ

 
Electronic Paper