ইভটিজিং থেকে বাঁচতে হবে
ইসমাইল মাহমুদ
🕐 ৯:৪৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২০
সিলেটের অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান শামীমা (ছদ্মনাম)। স্কুলের পথে প্রায় প্রতিদিনই বখাটে যুবকদের উত্ত্যক্তের শিকার হয়। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান ওই বখাটে যুবকরা তাকে পথরোধ করে প্রেমের প্রস্তাব দিলে সে (শামীমা) তা প্রত্যাখ্যান করে। এর পরদিন ওই বখাটে যুবকরা শামীমাকে স্কুলে যাওয়ার পথে পুনরায় পথরোধ করে কুপ্রস্তাব দিলে বিষয়টি সে তার পরিবারের কাছে জানায়। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় ইউপি মেম্বারের কাছে বিচার দাবি করা হয়।
এই বিচার দাবি করাই ছিল শামীমার পরিবারের সবচেয়ে বড় অপরাধ! ইউপি মেম্বারের কাছে বিচার প্রার্থী হওয়ার এক সপ্তাহ পরই স্কুলে যাওয়ার পথে শামীমাকে বখাটে যুবকরা প্রকাশ্য দিবালোকে টেনেহেঁচড়ে যৌনপীড়ন চালায়। এ ঘটনা গ্রামের বেশ কিছু মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করলেও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান বলে বখাটেদের প্রতিরোধে কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। ওইদিনই শামীমা নিজ ঘরে ফাঁস লাগিয়ে গ্লানিময় জীবন থেকে মুক্তি খোঁজে।
আলোচ্য এ ঘটনা আমাদের দেশে ঘটা একটি উদাহরণ মাত্র। এ ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে ঘটেই চলেছে। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়, স্কুল-কলেজে ইভটিজিংবিরোধী সামাজিক কমিটি গঠন ইত্যাদি কর্মপন্থা গ্রহণ করেও পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। ইভটিজিং বা নারী উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়ে দেশের আনাচে-কানাচে অকালে ঝরে পড়ছে অনেক মেয়ে। যাদের অধিকাংশই শিশু ও কিশোরী। উত্ত্যক্তকরণ বা ইভটিজিং একটি সামাজিক ব্যাধি। এ থেকে সমাজকে রক্ষা করতে বখাটেদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
ইভটিজিং বা নারী উত্ত্যক্তকরণ কী : ইভটিজিং বা নারী উত্ত্যক্তকরণ বলতে কোনো নারী, যুবতী, কিশোরী বা মেয়ে শিশুকে তার স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষেত্রে বিরক্ত করা, চলার পথে বা স্বাভাবিক কাজকর্র্ম করা অবস্থায় অশ্লীল বা অশালীন মন্তব্য করা, যে কোনো ধরনের ভয় প্রদর্শন, তার নাম ধরে ডাকা বা বিকৃত নামে তাকে সম্বোধন, চিৎকার চেঁচামেচি করা, তার দিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কিছু ছোড়া, ব্যক্তিত্বে লাগে এমন ধরনের মন্তব্য করা, যোগ্যতা নিয়ে টিটকিরি করা, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা, রাস্তায় হাঁটতে বাধা দেওয়া, অশ্লীল বা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেওয়া, সিগারেটের ধোঁয়া গায়ে ফেলা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিছু নেওয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে গান-ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা, চিঠি লেখা, পথরোধ করে দাঁড়ানো, হুমকি প্রদান ইত্যাদি ইভটিজিংয়ের মধ্যে পড়ে।
সাধারণত কিশোরী মেয়ে, মেয়ে শিশু, স্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়গামী ছাত্রী, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত নারী শ্রমিক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তারসহ সকল স্তরের নারীরা ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া পাবলিক পরিবহনে বিশেষ করে বাস, ট্রেন, অটোরিকশায়ও নারীরা ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন।
আইনে যা আছে : বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারায় ইভটিজিং সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীর শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে সে নারী যাতে শুনতে পায় এমনভাবে কোনো কথা বলে বা শব্দ করে কিংবা সে নারী যাতে দেখতে পায় এমনভাবে কোনো অঙ্গভঙ্গি করে বা কোনো বস্তু প্রদর্শন করে, কিংবা অনুরূপ নারীর গোপনীয়তা অনধিকার লঙ্ঘন করে, তা হলে সেই ব্যক্তি এক (১) বছর পর্যন্ত বা যে কোনো মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদণ্ডে কিংবা অর্থদণ্ডে কিংবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।’ ৩৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতা নষ্ট করার অভিপ্রায়ে বা সে তৎদ্বারা তার শালীনতা নষ্ট করতে পারে জেনেও তাকে আক্রমণ করে বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে তা হলে সে ব্যক্তি ২ বৎসর পর্যন্ত যেন কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে বা জরিমানা দণ্ডে বা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৯ (খ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। একই আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তা হলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং তার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ধর্ষণ-পরবর্তী নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’
দণ্ডবিধির ২৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করে কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল কার্য করে অথবা কোনো প্রকাশ্য স্থানে বা তার সন্নিকটে কোনো অশ্লীল গান, গাঁথা, সংগীত বা পদাবলি গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে তাহলে সে ব্যক্তি ৩ মাস পর্যন্ত যে কোনো ধরনের কারাদণ্ডে বা জরিমানা দণ্ডে বা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’
[তথ্যসূত্র : মো. গাউছুল আজম, র্যাবের আইন কর্মকর্তা]
ইভটিজিং বন্ধে করণীয় :
১. পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ইভটিজিং বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৩. যেসব কর্মক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী কর্মীরা একসঙ্গে কাজ করেন সেসব কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীদের নারী সহকর্মীর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪. সড়কে চলাচলকারী সাধারণ মানুষকে নারী উত্ত্যক্তকরণ বা ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
৫. প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবায় মসজিদের ইমাম সাহেব ইভটিজিংয়ের ব্যাপারে বয়ান রাখতে পারেন।
৬. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে ইভটিজিংবিরোধী সভা-সমাবেশের আয়োজন করতে পারে। এতে জনসচেতনতা সৃষ্টি হবে।
৭. স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ইভটিজিংয়ের ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকা নিতে হবে। ইভটিজিং যে বা যারা করবে তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করার পদক্ষেপ নিতে হবে জনপ্রতিনিধিদের।
সর্বোপরি ইভটিজিং বা নারী উত্ত্যক্তকরণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কোনো ধরনের ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটলে সবাইকে ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়াতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশের প্রতিটা নারীর অধিকার রয়েছে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করার। আমরা সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে অবশ্যই আমাদের কন্যা, জায়া ও জননীদের পথচলা হবে নিরাপদ।
ইসমাইল মাহমুদ : লেখক
[email protected]