দুর্নীতি : ধনী হওয়ার সংক্ষিপ্ত পথ
অলোক আচার্য
🕐 ৯:৩২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২০
সবাই বড়লোক হতে চায়। বড়লোক মানে মানুষ হিসেবে বড় না, টাকার হিসেবে বড়। কেউ কেউ পরিশ্রম করে সেই জায়গায় পৌঁছায় তবে বেশিরভাগের ধৈর্য্যশক্তি অত নেই। তারা খোঁজে শর্ট কাট রাস্তা। কেউ মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পরে, কেউ ভণ্ড সাধু সন্যাসীর বেশ ধরে, কেউ টোটকা ওষুধের রাস্তা ধরে, কেউ জ্বীনের বাদশা সাজে। মোট কথা, ধান্দার খাতায় নাম লেখায়। আমরা সবাই কম বেশি ধান্দা খুঁজি।
যারা অল্প সময়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে চায় তারা সব থেকে বড় ধান্দাবাজ। বড়লোক হওয়ার একশ একটা উপায় আছে। এটা আমার কথা নয়। একটা কৌতুক আছে। রাস্তায় ভিক্ষে নেওয়ার সময় ভিক্ষাদাতাকে ভিক্ষুক বললেন, ভাই আমার একটা বই আছে বড়লোক হওয়ার একশ উপায় নামে। লোকটি তখন জিজ্ঞেস করল, ভাই আপনি যদি বই লিখেন তাহলে ভিক্ষা করছেন কেন? ভিক্ষুকটি জবাব দিল ওই একশটি উপায়ের মধ্যে ভিক্ষে করাটাও একটি উপায়।
এটা কৌতুক হলেও বিষয়টি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একদম সত্যি। কেবল আরাম আয়েশে থাকার জন্যও আমাদের দেশে অনেকে ভিক্ষা করে। কারণ ভিক্ষা করা সহজ আর একবার হাত পাতলেই লজ্জা বিষয়টা আর মাথাতে আসে না। আবার যারা ভিক্ষুকদের সর্দার হিসেবে কাজ করে তারা বাড়ি গাড়িরও মালিক।
টিভিতে প্রচারিত একটি প্রতিবেদনে দেখেছিলাম আমাদের দেশের এক ভিক্ষুকের মাসিক আয় চল্লিশ হাজার টাকা। সে প্রতি তিন মাসে একবার ভারতে যায় ভিক্ষা করতে। এই হলো অবস্থা। ভিক্ষাটা এখানে পেশা। আর সেই পেশাটা যদি হয় আরাম আয়েসের তাহলে তো কথাই নেই! সম্মান অসম্মানের কথা আজ কেই বা ভাবে।
ভদ্র সমাজেও তো অনেক মুখোশধারী রয়েছেন যারা পোশাক-আশাকে ভদ্রলোক সেজে অফিসে যান তারপর পকেট ভর্তি করে ঘুষের টাকা নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফেরেন। এই ঘুষটাকেও এক ধরনের ভিক্ষা বলা যায়। হাত পেতেই তো ঘুষের টাকা নেওয়া হয়। আর এই ঘুষের টাকা দিয়ে নামী দামী আসবাবপত্র, ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষা সব মিলিয়ে ভদ্র সমাজের স্ট্যাটাসটা অন্ততপক্ষে নিজের গায়ে লাগিয়ে নেওয়া যায়।
এরা সমাজের মান্য গণ্য ব্যক্তি। আমরা তাদের হাটে বাজারে দেখলে শ্রদ্ধা করি। ভেতর থেকে যদিও শ্রদ্ধা আসে না। আসলে চক্ষুলজ্জা বলে তো একটা বিষয় আছে। এই চক্ষুলজ্জাতেই তাদেরকে সম্মান দিতে হয়। এখনও এই সমাজে কত সমস্যা।
সমাজটাকে যেমন ভিক্ষুকমুক্ত করা দরকার তেমনি ঘুষ দুর্নীতিমুক্ত করা দরকার। এই ভদ্র লেবাসধারী ভিক্ষুকরা তো সমাজের আরও বেশি ক্ষতি করছে। সমাজে এরা নীতি বিক্রি করে। যারা নীতি বিক্রি করে টাকা আয় করে তারা ভয়ঙ্কর। সত্যি কথা হলো যে, অবস্থা আমার বর্ণনার চাইতেও ভয়ঙ্কর। আমরা যখন দেশটিকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে চাইছি তখন এটিকে অনেকেই পেশা হিসেবে নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। একসময় কোন উপায় না পেয়ে ভিক্ষা করতো আর এখন অন্য উপায়ের চেয়ে ভিক্ষা করে আয় করাটা সহজ উপায় হওয়ায় মানুষ ভিক্ষা করছে।
ভিক্ষুকের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। দেশ উন্নত হওয়ার দিকে চলেছে আর আমাদের সমাজে ভিক্ষুক হওয়ার মানসিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় যখন আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব তখনও যদি এরকম ভিক্ষুকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে বিষয়টি সত্যি খুব দুঃখজনক হবে। ভিক্ষা করার জন্য আসলে অভাব দায়ী নয় স্বভাব দায়ী। ভিক্ষা অসম্মানের এই ধারণাটাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি।
তবে এসব ভিক্ষা করে রোজগার ছাড়াও আমাদের দেশে মোটা টাকা কামাই করার আরও অনেক উপায় আছে। যাতে খুব দ্রুত টাকা উপার্জন করা যায়। তার একটি হলো বিভিন্নভাবে প্রতারণা। আমাদের দেশের মানুষের সহজ সরলতাকে কাজে লাগিয়ে নিত্য নতুন প্রতারণার উপায় খুঁজতে আমাদের দেশের মানুষের দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। একবার যদি কেউ মনে করে অল্প সময়ে বেশ কিছু টাকা আয় করা দরকার তাহলে এইসব প্রতারণার আশ্রয় নেয় এসব ভদ্রবেশি প্রতারক। পত্রিকার পাতায় নিত্যদিন পাত্র-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দেখা যায়। বছরের পর বছর এসব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়।
কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরাসরি পাত্রীকে বিয়ে করে সেখানে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়। এই শর্টকাট রাস্তায় বিদেশে যাওয়ার সুযোগ অনেক বেকার যুবক হাতছাড়া করতে চায় না। তারা এসব জায়গায় যোগাযোগ করে। তারপর সবকিছু খুইয়ে হতাশ জীবনযাপন করে। আসলে এসব কানাডীয়ান প্রতারকদের টার্গেট থাকে বেকার হতাশাগ্রস্ত যুবক।
কয়েকদিন আগে এসব প্রতারণার খবর নিয়ে বিশাল এক প্রতিবেদন বের হয়েছে পত্রিকায়। তাতে কি আমরা সচেতন হবো? এর পরও কি আর কেউ বিয়ে করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে। কারণ, আমাদের লোভ বারবার ফাঁদে পা দিতে বাধ্য করে। এ তো গেল প্রতারণার এক দিক। বাঙালির বিশ্বাস ভক্তি শ্রদ্ধাকে কাজে লাগিয়ে কত প্রতারণা হয় এদেশে। তার একটি হলো জ্বীনের বাদশা। এসব জ্বীনের বাদশারা আমাদের সমাজের অত্যন্ত চতুর টাইপের মানুষ।
এদের মূল টার্গেট থাকে বাড়ির মহিলারা। কারণ, এদের নাকি প্রভাবিত করা সহজ। একবার আমার কাছেও জ্বীনের বাদশা ফোন করেছিল রাত বারোটার পর। তবে বেচারা বেশিক্ষণ সুবিধা করতে পারেনি। নিজে থেকেই ফোন কেটে দিয়েছিল। কোন গুপ্তধন পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে এরা নারীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। আজ পর্যন্ত কত নারী এসব গুপ্তধনের লোভে কাউকে না জানিয়ে কত টাকাপয়সা হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এখানেও কিন্তু সেই লোভই কাজ করে।
অল্প সময়ে বেশি টাকার লোভ কতজনই বা ছাড়তে পারে। আমরা যে প্রতারণার খবর মাঝে মধ্যে পাই না তা কিন্তু না। চাইলে কিন্তু আমরা সচেতন হতে পারি। কিন্তু হই না। প্রতারকরা নতুন নতুন প্রতারণার আইডিয়া খুঁজে বের করে আর আমরা সেই নতুন নতুন প্রতারণার ফাঁদে পা দেই। অনেক সময় এটাও হয় যে, যারা প্রতারণা করছে তারাও জানে এটা প্রতারণা; আবার যারা প্রতারণার শিকার হয় তারাও অনেক সময় জানে এটা প্রতারণা। আমরা নিজের ভাগ্য জানার আকুলতায় যখন রাস্তার পাশের টিয়া পাখিটার হাতে নিজের হাত ছেড়ে দেই তাহলে সেটাকে কি বলা যায়। অন্তত টিয়াপাখি আমাদের ভাগ্য বলে দিতে পারে তা আমার বিশ্বাস হয় না।
এমনিভাবে আমরা জানি যে, লটারি বা এরকম কোন উপায় ছাড়া হঠাৎ এতগুলো টাকা পেয়ে বড়লোক হওয়ার কোন উপায় নেই তা সত্ত্বেও কিন্তু আমরা তা হতে চাই। আর হতে গিয়ে যখন ঠকি তখন কিন্তু দোষ দেই প্রতারকদের। বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে প্রতারকদের খপ্পরে পরে কত যুবকের ভিটে মাটি বিক্রি করতে হয়েছে তার হিসাব কারো কাছে নেই।
মাঝে মধ্যেই নানা ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে হাজির হয় কবিরাজ। কেউ লাথি দিলেই সব রোগ থেকে মুক্তি মেলে! আমরাও সেই বাবার লাথি খাওয়ার জন্য ছুটে যাই আস্তানায়। সেই বাবার সাথে আশপাশে বোতলের ব্যবসা, জলের ব্যবসা নিয়ে আরও অনেক বাবার আবির্ভাব ঘটে। অনেক ওষুধে আবার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলাফলের গ্যারান্টি দেওয়া হয়।
আমরা জানি কোন ওষুধ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফল দিতে পারে না তারপরও আমরা এসব ওষুধ খেতে ভিড় জমাই। আমরা অপেক্ষা করতে রাজী নই। দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও অন্ধ বিশ্বাসের মানুষের সংখ্যা কমছে বলে মনে হয় না। কারণ, এসব প্রতারণায় পা দেওয়া মানুষের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ড সাধু সন্যাসী, ফকিরদের দ্বারে দিনের পর দিন পরে থেকে ধন সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভ্রমহানিও হয়েছে অনেক নারীর। ভারতে এরকম ঘটনা বেশ আলোচিত।
তাছাড়া লাথি বাবা, ফুঁ বাবার মত কত বাবা হঠাৎ হঠাৎ বিপুল ক্ষমতা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় আবার কিছুদিন পর তা মিলিয়েও যায়। কিন্তু কেবল পানিতে ফুঁ দিয়েই তার বহু টাকার মালিক বনে যাওয়া যায়। ডাক্তারের কাছে বা বিজ্ঞানের কাছে ওষুধ না থাকলেও রাস্তা ঘাটে চলতে ফিরতে মরণ ব্যাধি ক্যান্সারের চিকিৎসা পর্যন্ত দেওয়ার লিফলেট চোখে পরে। অথচ একটু সচেতন হলেই এরা ব্যবসা ফাঁদতে পারে না। আমরাই তাদের টাকা উপার্জনের সুযোগ করে দেই।
অলোক আচার্য : কলাম লেখক, পাবনা
[email protected]