বিশেষ কলাম
ভোটের প্রচারণায় দূষণ সংস্কৃতি
সাধন সরকার
🕐 ৮:৫৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৪, ২০২০
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনী প্রচারণা চলছে। নির্বাচনী আমেজে এখন সরগরম রাজধানী ঢাকা। সব মেয়র প্রার্থীই রাজধানী ঢাকাতে বাসযোগ্য, পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ভোটের প্রচারণায় এবার বেশ জোরেশোরেই যোগ হয়েছে দূষণ সংস্কৃতি! ‘পলিথিন মোড়ানো কাগজের পোস্টারে’ ছেয়ে গেছে ঢাকা শহর। কোথাও কোথাও আবার বেশ মজবুতভাবে লেমিনেট করা পোস্টারও দেখা যাচ্ছে।
বিভিন্ন প্রার্থীর পলিথিন মোড়ানো পোস্টার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন এ পোস্টার বছরের পর বছর ব্যবহার করা হবে! এসব পলিথিন মোড়ানো পোস্টার বাস্তবে ভোটের পর কোনো হদিস পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না! নির্বাচনী সংস্কৃতি থেকে ধারণা পাওয়া যায়, ভোটের আগে পোস্টারের গুরুত্ব যতটা, ভোটের পর ততই গুরুত্বহীন এ পোস্টার।
ভোটের আগে পোস্টার লাগানোর লোকের অভাব হয় না, কিন্তু ভোট শেষে পোস্টার অপসারণ করার লোকের ততই অভাব! তাহলে এসব লক্ষ লক্ষ পলিথিন মোড়ানো পোস্টারের শেষ ঠিকানা কি ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল-নদী! নির্বাচনের পর এসব পোস্টারের কেউ কি কোনো খোঁজ রাখে? ধারণা করা হচ্ছে, এসব পলিথিন মোড়ানো লক্ষ লক্ষ পোস্টার আগামী বর্ষা মৌসুমে শহরের জলাবদ্ধতার কারণ হতে পারে।
একদিকে নির্বাচনে জলাবদ্ধতামুক্ত ঢাকা শহর গড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, অপরদিকে পলিথিন মোড়ানো পোস্টারে পুরো ঢাকা শহরকে আবদ্ধ করে জলাবদ্ধতাকে পরোক্ষভাবে স্বাগত জানানো হচ্ছে! এমনিতেই ঢাকা শহর নানাবিধ দূষণে জর্জরিত, তার ওপর এ নিষিদ্ধ পলিথিনের ছড়াছড়ি পরিবেশ দূষণকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
পরিবেশ আইন অনুযায়ী- পলিথিনের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। আর এ নিষিদ্ধ পলিথিন মোড়ানো পোস্টারই কি-না হয়ে ওঠেছে প্রচারণার প্রধান হাতিয়ার! প্লাস্টিকের কণা বছরের পর বছর টিকে থাকে এবং মাটি, পানিসহ সামগ্রিক পরিবেশ দূষণে ভূমিকা রাখে। পলিথিন মোড়ানো পোস্টারের তথা পলিথিনের ক্ষতির কথা সবাই জানে। তারপরও কেন সম্ভাব্য নগরপিতা পোস্টারে পলিথিনের ব্যবহার করছেন।
সব মেয়র প্রার্থী নতুন ঢাকা গড়ে তোলার কথা বলছেন, দূষণমুক্ত ঢাকা গড়ার কথা বলছেন। তবে নগরের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কাছ থেকে এমন পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড কি আশা করা যায়? প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত তো বটেই দূষণমুক্ত ঢাকা গড়াই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত ঢাকা গড়ার কথা বলে পলিথিন মোড়ানো পোস্টারে শহর নোংরা করা কতটা সমীচীন। তবে ভোটের প্রচারে নিষিদ্ধ পলিথিনের ছড়াছড়ি এবার-ই যে প্রথম তা কিন্তু নয়।
পলিথিন মোড়ানো পোস্টারের ব্যবহার এর আগেও দেখা গেছে, তবে এখনকার মতো এত ব্যাপক মাত্রায় ছিল না। শুধু পলিথিন দূষণ নয়, ভোটে শব্দদূষণও যে হচ্ছে না, তা বলা যাবে না। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী প্রচারে মাইক, লাউড স্পিকার বা উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে এমন কিছু ব্যবহারে নির্ধারিত সময়ের (দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত) পরও এগুলো বাজিয়ে শব্দদূষণ করা হচ্ছে। কোনো কোনো নির্বাচনী ক্যাম্পগুলোতে অহরহ মাইকের ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার উচ্চৈঃস্বরে হর্ন বাজিয়ে কোথাও দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে মোটরসাইকেল।
শহরের রাস্তায় কোথাও কোথাও এখনই দেখা যাচ্ছে ভোটের পলিথিন মোড়ানো ছেঁড়া পোস্টারের স্তূপ। ইতোমধ্যে কোথাও আবার পলিথিন মোড়ানো পোস্টারের ঠাঁই হয়েছে ড্রেনে! ঢাকা শহরকে যারা বাসযোগ্য করবেন, দূষণমুক্ত করবেন, আধুনিক করবেন; ভোটের প্রচারে কোনো প্রকার দূষণ ঘটছে কি-না এ ব্যাপারে তাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত।
আমাদের প্লাস্টিক ও পলিথিনের দূষণমুক্ত শহর গড়ার শপথ নিতে হবে। এখনই সব মেয়র প্রার্থীর উচিত প্লাস্টিক মোড়ানো পোস্টার সরিয়ে নেওয়া। কেননা এর ব্যবহার যেভাবে বাড়ছে তার দূষণের পরিণতি হবে ভয়াবহ। শোনা যাচ্ছে, অনেক হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থী ভোট গ্রহণ শেষে নিজের পোস্টার সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। এটা কতটা সত্য তা হয়তো সময়ই বলবে! নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের উচিত পলিথিন মোড়ানো পোস্টার সাঁটানো পুরোপুরি বন্ধ ও নিষিদ্ধ করা।
পলিথিন মোড়ানো পোস্টার ব্যবহারকারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। ঢাকার দুই সিটির চলতি নির্বাচনে তো বটেই আগামীতে কোনো ধরনের নির্বাচনে যেন পলিথিন মোড়ানো পোস্টার ব্যবহার করা না হয় সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বিশ্বের অন্যতম দূষণের দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশকে ‘ভোটের প্রচারণায় দূষণ সংস্কৃতি’ হিসেবে পরিচিত করে তোলার কোনো মানে হয় না। ভোটের প্রচারণায় দূষণের সংস্কৃতি চিরতরে বন্ধ হোক।
সাধন সরকার : কলাম লেখক ও পরিবেশকর্মী
[email protected]