ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নির্বাচন পেছানো যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

অমিত গোস্বামী
🕐 ৯:১৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২০

কুর্নিশ বাংলাদেশ। কুর্নিশ দেশের অসাম্প্রদায়িকতা বোধ। সরস্বতী পূজার দিনে ভোট না করার জোরাল দাবিতে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ঢাকা সিটি নির্বাচনের ভোট গ্রহণের তারিখ পরিবর্তন করলেন। ঢাকা দুই সিটির নির্বাচন ৩০ জানুয়ারির পরিবর্তে এখন ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। অথচ আদালতের রায় তাদের পক্ষে ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। তাদের পক্ষে জনমত জোরাল হয়ে উঠেছিল। কাজেই নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হলো।

জয়ী হলো বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িকতা বোধ। এ বোধের এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে উঠল এ নির্বাচন পেছানোর সিদ্ধান্ত। সংখ্যালঘু অনুভূতির প্রতি এক নিঃশর্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি। ভারতে যখন আহত সংখ্যালঘু অনুভূতি, দিল্লির শাহিনবাগে কলকাতার পার্কসার্কাসে দিনের পর দিন রাত জেগে একনাগাড়ে সংখ্যালঘু মানুষ ধরনায় বসে আছেন, জ্বলছে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাস্তায় নেমেছে সাধারণ মানুষ, সংবাদমাধ্যম তীব্র দুই শিবিরে বিভক্ত। এ সময়ে বাংলাদেশের এ নিদর্শন ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী স্পর্ধায় অবশ্যই ঝামা ঘষে দেওয়া।

কিন্তু প্রতিবাদের কারণ অতি সামান্য। ঢাকা শহরের মেয়র নির্বাচনের দিন স্থির হয়েছিল ৩০ জানুয়ারি। সেদিন সরস্বতী পূজা থাকায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন হিন্দু মতাবলম্বী নাগরিকরা। ছাত্রবিক্ষোভ, মানববন্ধন, অবরোধের মাধ্যমে তারা এ বিক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন যে হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, সরস্বতী পূজা ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি-দুদিন মিলে অনুষ্ঠিত হবে। তাই নির্বিঘ্নে সরস্বতী পূজার আয়োজন সম্পন্ন করতে ৩০ জানুয়ারি নির্ধারিত ঢাকার ২ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করার দাবি জানান বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি ও বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদ।

মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির যৌথ সভায় সংগঠনের নেতারা বলেন, সনাতন সম্প্রদায়ের ভোটারদের পাশাপাশি সনাতন ধর্মাবলম্বী অনেকেই ভোটকেন্দ্রে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। তাই তারা পুজোর আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হবেন। এ ছাড়াও ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি স্কুল ও কলেজে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং এর মধ্যে অনেক স্কুল ও কলেজেই নির্বাচনের কেন্দ্র হওয়ায় পূজা উদযাপন এবং নির্বাচন বিঘ্নিত হবে।

ইসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দাখিল করলেও গত মঙ্গলবার আদালত নির্বাচন পেছানোর দাবি নাকচ করে ৩০ জানুয়ারি ভোট অনুষ্ঠানের রায় দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন জানান, সরকারি ছুটির তালিকায় সরস্বতী পূজার তারিখ নির্ধারিত রয়েছে ২৯ জানুয়ারি। সে কারণে আমরা ৩০ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করেছি। এ ২৯ তারিখ সরকারিভাবে সরস্বতী পূজা ঘোষণার কারণ হিন্দু নেতারা পঞ্জিকা দেখে সরকারকে আগে এ দিন নির্দিষ্ট করে বলেছিলেন। কাজেই নির্বাচন কমিশন বা সরকারকে কোনোভাবেই দায়ী করা যেত না।

কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হলো সরস্বতী পূজার সময় অনুযায়ী দিন নির্ধারণে। মূল কারণ হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা যে দুই মতের পঞ্জিকার অনুসারী তারা দুই মত দিয়েছেন। সূর্যসিদ্ধান্ত মতের পঞ্জিকা অনুসারে ২৯ জানুয়ারি পূর্বাহ্ন মধ্যে চতুর্থী যুক্ত পঞ্চমী থাকায় ঐদিন সরস্বতী পূজা হবে। এরা যুক্তি দিচ্ছেন যে কালমাধব ধৃত হারীত বচনে বলা হয়েছে- চতুর্থীসংযুতা কার্য্যা পঞ্চমী পরয়া ন তু/ দৈবে কর্মণি পৈত্র্যে চ শুক্লপক্ষে তথাসিতে। অর্থাৎ চতুর্থী যুক্ত পঞ্চমী খণ্ডেই পঞ্চমী বিহিত কর্মকার্যের অনুষ্ঠান করতে হবে। অর্থাৎ ২৯ জানুয়ারি সরস্বতী পূজা।

কিন্তু দৃক অর্থাৎ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে পূর্বদিন অর্থাৎ ২৯ জানুয়ারি পূর্বাহ্ন মধ্যে পঞ্চমী না থাকায় পরদিবস অর্থাৎ ৩০ জানুয়ারি সরস্বতী পূজা হবে। শাস্ত্ররীতি মেনে প্রাতঃকালই সরস্বতী পূজার উপযুক্ত সময় বলে বিধান দিচ্ছেন শাস্ত্রজ্ঞরা। কিন্তু পঞ্চমী শুরু হচ্ছে ভারতের ১৪ মাঘ ১৪২৬ ও বাংলাদেশের বাংলা ক্যালেন্ডারে যা ১৫ মাঘ ১৪২৬ তারিখ, অর্থাৎ ২৯ জানুয়ারি সকাল সোয়া ৯টায়। যেহেতু সেদিন ঊষালগ্ন পাওয়া যাচ্ছে না তাই সেদিন নয় ৩০ জানুয়ারি পূজার সঠিক দিন।

এখানে এ পঞ্জিকা বিষয়ে সামান্য জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, যা অধিকাংশ হিন্দুরও নেই।

বাংলায় পঞ্জিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তখন বাংলা পঞ্জিকা জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু সংঘাত ঘটে এই গণনা পদ্ধতি নিয়ে। সূর্য বনাম দৃক। অর্থাৎ সূর্যসিদ্ধান্ত বনাম দৃকসিদ্ধান্ত। অনেকের ধারণা, সূর্যসিদ্ধান্ত প্রায় প্রাচীনতম হওয়ায় তার মধ্যে অনেক ভুলভ্রান্তি রয়েছে। তার তুলনায় বরং অনেক আধুনিক দৃক সিদ্ধান্ত। ফলে সেটি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত। সূর্যসিদ্ধান্ত অনুসারী পঞ্জিকা ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মুদ্রিত হয়, নাম- গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা। এর প্রকাশক ছিলেন দুর্গাচরণ গুপ্ত। এছাড়া আছে পি এম বাগচী, বেণীমাধব শীল প্রমুখ।

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে (১২৯৭ বঙ্গাব্দে) গণিতজ্ঞ মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক সম্পাদিত একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়, যা বিজ্ঞানভিত্তিক গণনা করে পূজার সময়ক্ষণ নির্দিষ্ট করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে এ পঞ্জিকা আজ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। ১৯৫২ সালে ভারত সরকারের অধীনে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে পঞ্জিকার সংস্কার হয় এবং এ সংস্কারপ্রাপ্ত পঞ্জিকা বা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাই ভারতের রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত হয়। এ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তে এ সংশোধিত অবস্থানকে মান্য করা হয়েছে, তাই এটি দৃকসিদ্ধান্ত। রামকৃষ্ণমঠ এ পঞ্জিকার অনুসারী।

এখানে পশ্চিমবঙ্গের অর্থাৎ রাঢ়ভূমির হিন্দুদের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থাৎ বরেন্দ্রভূমির হিন্দুদের এ নিয়ম পালনের ব্যাপারে স্পষ্ট পার্থক্য আছে। ভাটপাড়ার পণ্ডিতদের বিধান অনুযায়ী তারা পূজাপার্বণ করেন। এ পণ্ডিতরা আজও সূর্যসিদ্ধান্তে অটল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সব ধর্মের অনুসারীরা অনেক আধুনিক ও উদারমনা।

এমনকি আধুনিকীকরণের প্রয়োজনে তারা দ্বিতীয়বারের জন্য বাংলা ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করেছেন। বাংলাদেশে নতুন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী এখন থেকে বাংলা বছরের প্রথম ছয় মাস ৩১ দিনে হবে। এর আগে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র- বছরের প্রথম এ পাঁচ মাস ৩১ দিন গণনা করা হতো। এখন ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস ৩০ দিনে পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের, কেবল লিপইয়ারের বছর ফাল্গুন ৩০ দিনের মাস হবে।

বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের কাজ প্রথম শুরু হয়েছিল ভারতে ১৯৫২ সালে। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে প্রধান করে ভারতের সরকার একটি পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি করেছিল। তার আগে কেবল চান্দ্র হিসাব ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জি করা হত, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। মেঘনাদ সাহার ওই কমিটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের সুপারিশ করেন এবং তা গৃহীত হয়। পরে ১৯৫৬ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বর্ষপঞ্জি সংস্কারের কিছু সুপারিশ সরকারের কাছে করেন। নতুন বর্ষপঞ্জি তারই আলোকে করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ চলছে পুরনো নিয়মেই।

কিন্তু এই তাত্ত্বিক আলোচনা দূরে রেখে যদি দৃষ্টি ফেরাই এ নির্বাচনের দিন পরিবর্তনের দিকে তাহলে একটা বার্তা পরিষ্কার পড়তে পারা উচিত। সেই বার্তা হলো যে বর্তমান বাংলাদেশ সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ভূমিকা পালন করছে তাদের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে।

তাদের এ উদ্যোগ আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হলেও বর্তমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহাওয়ায় ভবিষ্যতের জন্য যে উদাহরণ হয়ে থাকল তাকে অস্বীকার করতে পারবে না কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। আজ ভারতীয় উপমহাদেশের সকল রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকদের মনে রাখা উচিত, নবীন প্রজন্ম কখনোই ধর্মীয় বিভেদকে প্ররোচনা বা সমর্থন দেয় না।

এ বিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদে তারা গর্জে ওঠে। যেমন উঠেছে ভারতের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে। বাংলাদেশের এ উদাহরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের মাইলফলক।

অমিত গোস্বামী : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper