ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পৃথিবীতে সভ্যতার আলো

বিবিধ ডেস্ক
🕐 ২:৪৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০৮, ২০২০

পৃথিবী এ পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে চারটি বরফ যুগ ও চারটি আন্তঃবরফ যুগ। তাতে উষ্ণ অঞ্চলে টিকে থাকা প্রাণীদের দেহের আকৃতিতে কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। পরিবর্তন দেখা দেয় মানুষের ক্ষেত্রেও। ধীরে ধীরে মানুষ হয়েছে উন্নত। তৈরি করেছে সভ্যতা। সভ্যতার ক্রমান্বয়ে উন্নতির ফলেই মানুষের জীবনযাত্রা সহজ থেকে সহজতর হয়েছে। আজকের আধুনিক যুগও সভ্যতার কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে। বন্যতা থেকে বর্বরতা এবং বর্বরতা থেকে মানুষ ধীরে ধীরে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে

মিসরীয় সভ্যতা
ইতিহাসের জনক হেরোডেটাস মিসরকে বলেছেন ‘নীলনদের দান’। কেননা নীলনদকে ঘিরেই গড়ে ওঠেমিসরীয় সভ্যতা।মিসরীয়দের প্রধান দেবতা ছিল সূর্যদেবতা, নাম ‘আমন’।মিসরীয় রাজা ফারাওদের ধারণা, তারা সূর্য দেবতার বংশধর। তাই তারা অমর এবং এই বিশ্বাসের দরুন তারা মৃত্যুর পর নিজেদের দেহ মমি করে রাখতো।

আরেকজন দেবতা ছিলেন ‘ওসাইরিস’, তিনি প্রাকৃতিক শক্তি, শস্য ও নীলনদের দেবতা ছিলেন। ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ বহু দেবতার বদলে এক দেবতা অর্থাৎ সূর্যদেবতার পূজা করার প্রচলন করেন। তিনি সূর্যদেবতার নাম বদলে ‘আতেন’ রাখেন এবং দেবতার নামের সাথে মিলিয়ে নিজের নাম দেন ‘আখেনাতেন’।

মূর্তি নির্মাণেমিসরীয়রা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আখেনাতেন ও রানী নেফারতিতির চুনাপাথরের মূর্তি দেখলে এখনো তাদের জীবন্ত মনে হয়। মিশরের চিত্রলিপির নাম ‘হায়ারোগ্লিফিক’, এটি গ্রিকদের দেয়া নাম, যার অর্থ ‘পবিত্র লিপি’। নলখাগড়া জাতীয় ঝোপ ‘প্যাপিরাস’ থেকে কাগজ তৈরি করে লেখা হতো। সম্রাট নেপোলিয়নমিসরীয় সভ্যতার ‘রোজেটা’ নামক পাথর খুঁজে পান, যা থেকে পরবর্তীতে হায়ারোগ্লিফিক ভাষার পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুনিয়ায় জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রের বিকাশ ছিলমিসরীয়দের প্রথম সাফল্য। পাশাপাশিমিসরীয়রা পাটিগণিত ও জ্যামিতির উদ্ভাবন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। কারণ ত্রিকোণ পিরামিড তৈরিতে জ্যামিতির জ্ঞান থাকা জরুরি ছিল।


চৈনিক সভ্যতা
চীনা সভ্যতা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও নদীকেন্দ্রিক সমৃদ্ধ সভ্যতা। অনেকের মতে, এর উদ্ভব চীনের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের তারিম উপত্যকায়। কুয়েন্ডলুং পর্বত অতিক্রম করে হোয়াংহো নদীর তীর বরাবর গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। উত্তর চীনে বর্তমানে যে জাতীয় মানুষের বসবাস, প্রস্তর যুগেও তাদের আকার আকৃতিবিশিষ্ট জনগোষ্ঠীর বসতি ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

চীনে বহু বিশ্ব-বিশ্রুত মনীষী, ধর্মগুরু ও দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- কনফুসিয়াস, লাও-তসু ও সিনাৎসিয়ান। চীনা লোক কাহিনী, লোকগীতি ও পুরানকথার অনেক কিছুই কালজয়ী সাহিত্য কর্মের মর্যাদা অর্জন করেছে। প্রাচীন চীনা চিকিৎসকগণ বিভিন্ন ব্যাধি ও ক্ষত নিরাময়ের ভেষজ ও শল্য চিকিৎসা জানতেন। চীনা আকুপাংচার পদ্ধতি এখনো প্রচলিত। প্রাচীন চীনের ধর্ম ছিল অনেকটা অবিন্যস্ত ও অস্পষ্ট। নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাস তাদের মধ্যে লক্ষ করা যায়নি। তাদের ধর্মীয় জগৎ স্বর্গীয়, প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক প্রভাবে প্রভাবিত ছিল।


সিন্ধু সভ্যতা
সিন্ধুনদের তীরে গড়ে উঠেছিল মহেঞ্জোদারো নগরী আর সিন্ধুর উপনদী রাভীর তীরে বিকাশ ঘটেছিল হরপ্পা নগরীর। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় অসাধারণ স্থাপত্যকলার নিদর্শন পাওয়া গেলেও তা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, প্রাসাদ ইত্যাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় রীতিমতো আধুনিক নগর গড়ে উঠেছিল। ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের সড়ক ছিল, পানি সরবরাহের জন্য কূপসহ নানা ব্যবস্থা ছিল, পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ড্রেন ছিল, স্নানাগার ছিল, রাস্তায় ড্রেন ও সড়ক বাতি ছিল, নগরীতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল।

এই দুই নগরীতে প্রায় ২৫০০টি সীল পাওয়া যায় যার বেশিরভাগে বিভিন্ন চিহ্ন, ষাঁড়, মহিষ প্রভৃতি পশুর প্রতিকৃতি ছিল। সিন্ধু সভ্যতার গোড়াপত্তন কারা করেছিল এ নিয়ে মতবিরোধ আছে। নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণায় এখানে প্রোটে অস্ট্রালয়েড মেডিটেরিনিয়ান, আলপাইন, ও মঙ্গোলয়েড জনগোষ্টীর কঙ্কাল পাওয়া গেছে।

নৃ-তাত্ত্বিকদের ধারণা, মেডিটেরিনিয়ান বা দ্রাবিড় গোষ্ঠীই এ সভ্যতার প্রবর্তক। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে আর্যদের আক্রমণে এ সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়।


মায়া সভ্যতা
মেসো শব্দটা গ্রিক। যার অর্থ ‘মধ্য’। যেমন, মেসোপটেমিয়া। এর মানে দুই নদীর মধ্যখানের অঞ্চল। তেমনি, মেসো-আমিরিকায় বলতে বোঝায় মধ্য-আমেরিকাকে, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যবর্তী অঞ্চলটিকে (প্রধানত মেক্সিকো। মেসো-আমেরিকায় কতগুলি সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল। যেমন- ওলমেক, অ্যাজটেক, মায়া। এর মধ্যে মায়া সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ ছিল অভূতপূর্ব। বর্তমান মেক্সিকো, গুয়েতেমালা, বেলিজ ও হন্ডুরাসজুড়ে ছড়িয়ে ছিল মায়া সভ্যতা। লিখিত ভাষাসহ মেসো-আমেরিকার সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা ছিল মায়া সভ্যতা। মায়া সভ্যতার উত্থানকাল ধরা হয় ২৫০ খ্রিস্টাব্দ।

মায়ারা অনেক দেবতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সে দেবতা ভালো কি মন্দ হতেন। ইটজামনা ছিলেন তাদের প্রধান দেবতা। তিনি সৃষ্টিকর্তা, আগুন ও উনুনের দেবতা। মায়ারা গণিত ও জ্যোতির্শাস্ত্র অভূতপূর্ব উন্নতি করেছিল। অবশ্য সে জ্ঞান অর্জন ছিল ধর্মীয় কৃত্যের সঙ্গে জড়িত। গণিতে শূন্যের ব্যবহার, পজিশনাল নোটেশন নির্ধারণ করেছিল মায়ারা; জ্যোতির্শাস্ত্রে সৌর বৎসরের গণনা, চন্দ্র ও শুক্র গ্রহের অবস্থান এমনকি সূর্যগ্রহনও আগেভাবে বলে দিতে পারত তারা! নরবলি বা হিউম্যান স্যাক্রিফাইস ছিল মায়াদের ধর্মবিশ্বাসের মূলে। মায়ারা নরবলি দিত উর্বরতা, ধর্মনিষ্টা দেবতার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে। মায়া পুরোহিত বিশ্বাস করত দেবতা মানুষের রক্তে পুষ্ট হন! রক্তই দেবতাদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়।


গ্রিক সভ্যতা
অনেক পাহাড়ের কারণে গ্রিস ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং অনেকগুলো নগররাষ্ট্র তৈরি হয়। গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে ছিল এথেন্স, থিবস ও মেগারা এবং পেলোপনেসাস অঞ্চলে ছিল স্পার্টা ও কোরিন্থ; এশিয়া মাইনরের তীরে ছিল মিলেটাস। এদের মধ্যে নেতৃত্বে ছিল এথেন্স ও স্পার্টা। গ্রিকদের বিশ্বাস দেবতা ডিয়াকোলানের পুত্র হেলেনের বংশধর তারা। হেলেনের বংশধর বলে গ্রিকদের নিজেদের হেলেনীয় বলতো। আর স্পার্টানরা ছিল গণতন্ত্র ও প্রগতিবিরোধী। এদের আদি নিবাস ছিল পেলোপনেসাস অঞ্চলের পূর্ব দিকে।

অস্ত্রের দাপটে এরা স্পার্টা দখল করে নিয়ে আদিবাসীদের ভূমিদাস বানায়। এই দাসদের বলা হতো হেলট। দীর্ঘদিন যুদ্ধ করার ফলে এবং হেলটদের বিদ্রোহ ঠেকাতে ঠেকাতে স্পার্টানরা একসময় যোদ্ধা জাতিতে পরিণত হয়। প্রায় সমস্ত নাগরিককে যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করা হতো, যেন পুরো স্পার্টা একটা যুদ্ধশিবির। অন্যদিকে এথেন্সের কথাই আলাদা। এথেন্সে তৈরি হয়েছিল আধুনিক গণতন্ত্রের কাঠামো। স্পার্টার প্রতিবেশি হয়েও এথেন্স সমস্ত নাগরিক সুবিধা দিয়েছিল তার নাগরিকদের। গ্রিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসক পেরিক্লিস এথেন্সের ক্ষমতায় বসেন ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এই যুগকে এথেন্সের স্বর্ণযুগ বলা হয়। কিন্তু একসময় স্পার্টার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পেলোপনেসীয় ও এথেন্সের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ডেলিয়ান লীগের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায় এবং এথেন্সের পতন হয়। এথেন্স স্পার্টার অধীনে চলে যায়।


অ্যাসিরীয় সভ্যতা
মেসোপটেমিয়া জুড়ে (বর্তমান ইরাক, তুরস্ক এবং সিরিয়া) ছিল অ্যাসিরীয়দের রাজত্ব। তারা রাজত্ব ভাগাভাগি করে নিয়েছিল ব্যাবিলনীয়দের সাথে। ব্যাবিলনিয়াতে যখন রাজ্য চালাত পুরোহিতরা, অ্যাসিরিয়া তখন চলতো রাজা আর সেনাপতিদের মাধ্যমে। ফলে অ্যাসিরীয়রা কিছুদিনের মধ্যেই বেশ বড় একটা সামরিক পরাশক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায় এবং নিজেদের সাম্রাজ্যও বড় করে তোলে। নিনেভেহ আর আরবেলের উর্বর জমির মধ্যে অ্যাসিরীয়দের জনসংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছিল, বিশেষ করে আরবেল, আসুর আর নিমরুদ শহর লোকজনের পদভারে ছিল মুখরিত। আক্কাদীয় ভাষাভাষী অ্যাসিরীয়রা পৃথিবীর প্রথম সভ্যতাগুলোর একটি যারা নিজেদের গল্পগুলো পার্চমেন্ট, প্যাপিরাস আর পাথরে খোদাই করে লিখে গিয়েছে।

জন্তু-জানোয়ার সংরক্ষণেও অ্যাসিরীয়দের অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল, অ্যাসিরীয় রাজা টিগলাথ-পিলেজারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কিছু চিড়িয়াখানাও গড়ে উঠেছিল অ্যাসিরিয়ায়। ব্রোঞ্জ আর লোহার অস্ত্রের সাহায্যে সহজেই হিট্টাইটদেরকে নিহরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত করে অ্যাসিরীয়রা। অ্যাসিরীয়দের নিয়ম ছিল দখল করা জায়গা থেকে স্থানীয়দের বিতাড়িত করা, যেন পরে কোনো বিদ্রোহের সূচনা না হয়। শুধুমাত্র বিজ্ঞানী-পণ্ডিত কিংবা যারা অ্যাসিরীয়দের কাজে লাগতে পারে এরকম ব্যক্তিবর্গ ছাড়া সবাইকেই অন্যত্র পাঠিয়ে দিত অ্যাসিরীয়রা। কম করে হলেও ৪ কোটি লোককে তাই নিজেদের বাসভূমি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতে হয়েছে অ্যাসিরীয়দের এই নীতির কারণে। অ্যাসিরীয়দের অন্যতম অর্জনগুলোর মধ্যে একটি হলো শিক্ষাব্যবস্থা, ৩৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘স্কুল অব নিসিবিস’কে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ধরেন অনেক ইতিহাসবিদ।

১৮০০ বছর ধরে মেসোপটেমিয়া শাসন করা অ্যাসিরীয়রা গড়ে তুলেছিল বিশাল সব নগরী, শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নগরীর চারপাশে পুরু দেওয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল, বিশেষ করে রাজধানীর চারপাশের দেয়ালই ছিল ১৫ মিটার পুরু! অ্যাসিরীয়দের পতন কীভাবে ঘটেছিল তা এখনো একটা রহস্য। তবে ধারণা করা হয়, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে চলতে থাকা যুদ্ধ তাদের ক্রমেই দুর্বল করে তুলছিলো। অ্যাসিরিয়া সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য তা দখল করে নেয়।


ব্যাবিলনীয় সভ্যতা
প্রাচীন কালে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে যে সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ব্যাবিলনীয় সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ অব্দে সুমের আক্কাদ বা প্রাচীন ব্যাবিলন সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম সারগন। রাজা হাম্বুরাবি ছিলেন সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শাসক। হাম্মুরারি দুর্ধরষ যোদ্ধা, সংগঠক, প্রশাসক, ও আইন সংকলক ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত নগর রাষ্ট্রকে একত্রিত করেন।

প্রায় ৪২ বছর (১৭৯২-১৮৫০ খ্রি:পূর্বাব্দ) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে তিনি সমগ্র মেসোপটেমিয়া ভূমধ্যসসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ও এশিয়ার উপর কর্তৃত্ব করে ‘সর্বাধিপতি’ উপাধি ধারণ করেন। তার রাজত্বকালে শুধু বিজয়ই নয় বরং শক্তিশালী কেন্দ্রিয় শাসন, আইনসহ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ব্যাবিলনের ইতিহাস ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে পরিচিত। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন। প্রাচীন ব্যাবিলনে ‘কিউনিফর্ম’ অর্থাৎ কীলক আকারের লিখন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এই পদ্ধতি প্রাচীন মিশনের ‘চিত্রলিখন’ পদ্ধতি অপেক্ষা উন্নত ছিল। ব্যাবিলনীয় ভাষা ছিল ৩০০ ধ্বনি চিহ্ন বিশিষ্ট।

ব্যাবিলনীয়রা অসংখ্য দেব-দেবীর পূজা করত। সূর্যদেব মারদুক ছিল তাদের শ্রেষ্ঠ দেবতা। ব্যাবিলনের বিখ্যাত ‘শূন্য উদ্যান’ পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম। শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ব্যাবিলনীয়রা উন্নত ছিল। কাঁচ শিল্পের উন্নতি সাধন ও প্রসারে তাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। চিত্রাঙ্কন বিদ্যা, জ্যোতিষ শাস্ত্র, অঙ্ক শাস্ত্র এবং আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে তাদের অতুলনীয় পারদর্শিতা ছিল। গ্রহ-নক্ষত্রাদি সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের সীমা বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। সূর্য ও জলঘড়ির সাহায্যে তারা সময় নিরূপণ করত। চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ সম্পর্কেও তাদের ধারণা ছিল যথাযথ। সেই সুদুর প্রাচীনকালে দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির গণনা ব্যাবিলন থেকেই প্রসার লাভ করে। এ ছাড়া ব্যাবিলনের রয়েছে ‘গিলগামেশের মহাকাব্য’।


হিব্রু সভ্যতা
বর্তমান প্যালেস্টাইন অঞ্চল ঘিরে প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। হিব্রু একটি সেমেটিক ভাষা। এই ভাষায় কথা বলা লোকেরাই হিব্রু নামে পরিচিত। হিব্রুরা সারা পৃথিবীর ধর্মবিশ্বাসের এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এরাই প্রথম সারা পৃথিবীকে একেশ্বরবাদের ধারণা দেয়।

সারা দুনিয়ার সমস্ত ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের সূতিকাগার বলা চলে এই হিব্রু সভ্যতাকে। হিব্রু সাহিত্য প্রাচ্যের যে কোন প্রাচীন সাহিত্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট ছিল। তাদের সাহিত্যে ধর্মের প্রভাব ছিল প্রবল। ওল্ড টেস্টামেন্ট মূলত বিভিন্ন সাহিত্য কর্মের সংকলন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হিব্রুদের তেমন অবদান নেই। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা কিছু অবদান রেখেছে।


সুমেরীয় সভ্যতা
গ্রিক শব্দ ‘মেসোপটেমিয়া’র অর্থ ‘দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমি’। মেসোপটেমিয়ার পূর্বদিকে টাইগ্রিস বা দজলা নদী, এবং পশ্চিমে ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদী। মেসোপটেমিয়ার অনেকগুলো সভ্যতার মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা সবচেয়ে প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে এর জন্ম। এ সভ্যতার লিখন পদ্ধতির নাম ‘কিউনিফর্ম’, যা কাদামাটির নরম শ্লেটে লেখা হতো। সুমেরের প্রাচীন শহর নিপ্পুরের এক মন্দিরে চার হাজার মাটির চাকতির একটি লাইব্রেরি পাওয়া গেছে। সুমেরীয়রা অনেক দেবতায় বিশ^াস করলেও তাদের মধ্যে পরকালের ধারণা ছিল না, তাই এ সভ্যতা থেকে কোনো মমি পাওয়া যায় না। এদের প্রধান দেবতা ছিলেন সূর্যদেব ‘শামাশ’।


অ্যাসিরীয় সভ্যতা
মেসোপটেমিয়া জুড়ে (বর্তমান ইরাক, তুরস্ক এবং সিরিয়া) ছিল অ্যাসিরীয়দের রাজত্ব। তারা রাজত্ব ভাগাভাগি করে নিয়েছিল ব্যাবিলনীয়দের সাথে। ব্যাবিলনিয়াতে যখন রাজ্য চালাত পুরোহিতরা, অ্যাসিরিয়া তখন চলতো রাজা আর সেনাপতিদের মাধ্যমে। ফলে অ্যাসিরীয়রা কিছুদিনের মধ্যেই বেশ বড় একটা সামরিক পরাশক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায় এবং নিজেদের সাম্রাজ্যও বড় করে তোলে। নিনেভেহ আর আরবেলের উর্বর জমির মধ্যে অ্যাসিরীয়দের জনসংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছিল, বিশেষ করে আরবেল, আসুর আর নিমরুদ শহর লোকজনের পদভারে ছিল মুখরিত। আক্কাদীয় ভাষাভাষী অ্যাসিরীয়রা পৃথিবীর প্রথম সভ্যতাগুলোর একটি যারা নিজেদের গল্পগুলো পার্চমেন্ট, প্যাপিরাস আর পাথরে খোদাই করে লিখে গিয়েছে।

জন্তু-জানোয়ার সংরক্ষণেও অ্যাসিরীয়দের অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল, অ্যাসিরীয় রাজা টিগলাথ-পিলেজারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কিছু চিড়িয়াখানাও গড়ে উঠেছিল অ্যাসিরিয়ায়। ব্রোঞ্জ আর লোহার অস্ত্রের সাহায্যে সহজেই হিট্টাইটদেরকে নিহরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত করে অ্যাসিরীয়রা। অ্যাসিরীয়দের নিয়ম ছিল দখল করা জায়গা থেকে স্থানীয়দের বিতাড়িত করা, যেন পরে কোনো বিদ্রোহের সূচনা না হয়। শুধুমাত্র বিজ্ঞানী-পণ্ডিত কিংবা যারা অ্যাসিরীয়দের কাজে লাগতে পারে এরকম ব্যক্তিবর্গ ছাড়া সবাইকেই অন্যত্র পাঠিয়ে দিত অ্যাসিরীয়রা। কম করে হলেও ৪ কোটি লোককে তাই নিজেদের বাসভূমি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতে হয়েছে অ্যাসিরীয়দের এই নীতির কারণে। অ্যাসিরীয়দের অন্যতম অর্জনগুলোর মধ্যে একটি হলো শিক্ষাব্যবস্থা, ৩৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘স্কুল অব নিসিবিস’কে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ধরেন অনেক ইতিহাসবিদ।

১৮০০ বছর ধরে মেসোপটেমিয়া শাসন করা অ্যাসিরীয়রা গড়ে তুলেছিল বিশাল সব নগরী, শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নগরীর চারপাশে পুরু দেওয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল, বিশেষ করে রাজধানীর চারপাশের দেয়ালই ছিল ১৫ মিটার পুরু! অ্যাসিরীয়দের পতন কীভাবে ঘটেছিল তা এখনো একটা রহস্য। তবে ধারণা করা হয়, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে চলতে থাকা যুদ্ধ তাদের ক্রমেই দুর্বল করে তুলছিলো। অ্যাসিরিয়া সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য তা দখল করে নেয়।

ইনকা সভ্যতা
পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর। এরপর আন্দেজ পর্বতমালার পুবমুখি বিস্তার। পেরু নামে একটি দেশ। এই পেরুর পুবেই কুজকো নগর। এসবই আন্দেজ পর্বতমালার মধ্যে। যে আন্দেজ পর্বতমালাটির বিস্তার উত্তর-দক্ষিণে ২৫০০ মাইল! সেই কুজকো নগর ঘিরেই সূত্রপাত হয়েছিল কুজকো রাজ্যের (কিংডম অভ কুজকো) যা পরে হয়ে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম পরাক্রমশালী ইনকা সাম্রাজ্য। ইনকা সাম্রাজ্য ছড়িয়ে ছিল পেরু, বলিভিয়া, উত্তর আর্জেন্টিনা, চিলি ও ইকিউডোরে। এত বিশাল সাম্রাজ্য সড়ক পথে যোগাযোগ রক্ষা করত ইনকারা। এই উদ্দেশ্যে ইনকারা নির্মান করেছিল বিস্ময়কর সড়ক; যাকে বলে, ‘ইনকা ট্রেইল’।

কৃৎকৌশলের দিক থেকে যা ছিল সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর। মনোরম উপত্যকা ও দুর্গম গিরির ভিতর দিয়ে চলে গেছে ইনকা ট্রেইল। আজও ধ্বংসাবশেষ দেখে চেনা যায়। মূল ২টি পথ ছিল- উত্তর-দক্ষিণে; কোনও কোনও পথ ১৬০০০ ফুট ওপরে ৪০০০০ কিলোমিটার। সামরিক ও বেসামরিক উভয় শ্রেনির লোকই চলাচল করত। আর চলত লামা ক্যারাভান। সাধারণ লোকের সে পথে চলতে হলে ইনকা সম্রাটের অনুমতি লাগত। পথের মাঝে ছিল সেতু। সেতুতে টোলব্যবস্থা ছিল। ইনকা সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। সাম্রাজ্যের সময়কাল ১২০০ থেকে ১৫৩৩। ইনকা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার নাম মানকো কাপাক।


রোমান সভ্যতা
রোমান সভ্যতা বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ সভ্যতা। রোম, গ্রীস, কার্থেক ও প্যালেস্টাইন সহ ভূমধ্যসাগর অঞ্চল জুড়ে বিদ্যমান সকল রাষ্ট্রকে এটি যেমন অধিকার করে, তেমনি অধিকৃত রাষ্ট্রসমূহের শিল্প সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণা আত্মস্থ করে নিজস্ব অবদানে তা সমৃদ্ধও করে। বিশ্ব সভ্যতার ক্ষেত্রে রোমান সভ্যতার প্রধানতম অবদান রাজনৈতিক ও সরকার পরিচালনা ব্যবস্থা সংক্রান্ত রীতি পদ্ধতি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে রোম শহরের পত্তন হয়।

কালক্রমে টাইবার নদীর মোহনায় সাতটি পার্বত্য টিলাকে কেন্দ্র করে এই নগরীর বিস্তৃতি ঘটে। এই সাতটি নগরীকে নিয়ে পরে গড়ে তোলা হয় একটি একক নগররাষ্ট্র।

এখনো দেশে দেশে রোমান আইন স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। গোথ, হুন ও ভান্ডালদের পৌনঃপুনিক আক্রমণে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

খেমার সাম্রাজ্য
বর্তমান ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস আর থাইল্যান্ডের বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় সভ্যতাগুলোর একটি।

পানিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বেশিরভাগ সভ্যতা, আর এই পানিকে কাজে লাগিয়েই সবচেয়ে দ্রুত নিজেদের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে ৮০০ থেকে ১৪০০ সাল পর্যন্ত উন্নতির শিখরে থাকা এই খেমার সাম্রাজ্য।

মেকং নদীর কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা রাজধানী অ্যাংকরকে বলা যায় প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বিশাল শহর, যা দখল করে রেখেছিল ১০০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি জায়গা আর আশ্রয় দিয়েছিল প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে।

শহরের অসাধারণ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সাহায্যে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে গিয়েছিলো। পানিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সেই শহরের পানির ব্যবস্থা ছিল স্বয়ংক্রিয়, যে কারণে ইতিহাসবিদরা একে উপাধি দিয়েছেন হাইড্রলিক শহর নামে। শক্তিশালী অর্থনীতির জোরে খেমার সাম্রাজ্য কম্বোডিয়া ছাড়িয়ে প্রবেশ করলো লাওস, থাইল্যান্ড আর ভিয়েতনামে, সংস্পর্শে আসলো পশ্চিমের সুতখোনিয়া সাম্রাজ্য আর পূর্বে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী শ্যামের। খেমারদের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা দ্বিতীয় জয়বর্মন শ্যামদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করলেন, দখল করে নিলেন বেশ বড় এলাকা।

বিশাল বড় সাম্রাজ্যকে ভাগ করা হলো ২০টি প্রদেশে, চীনের সাথে বাণিজ্য-ব্যবসা তুঙ্গে উঠলো। কাঠ, আইভরি, মশলা, মোম, সোনা, রূপা আর সিল্ক রপ্তানির অর্থের ভারে অ্যাংকর ডুবে যেতে থাকলো।

তবে এই অবস্থা বেশিদিন চলতে পারেনি, কিছুদিনের মধ্যেই খেমারদের পতন ঘটল। পৃথিবী থেকে মুছে গেল আরো একটি সভ্যতা।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper