ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নির্ঘুম রাত

অনাহারী দিন

গল্প

রাশেদ রউফ
🕐 ৭:২৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০৪, ২০২০

গ্রামের লোকজন আকাশবাণী, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানও নিয়মিত শোনে এখন। উদ্দীপনামূলক গানের সঙ্গে বেশ কয়েকটি স্লোগান মানুষকে আশান্বিত করে তোলে।

তার মধ্যে রয়েছে : ‘গ্রেনেড গ্রেনেড গ্রেনেড- শত্রুর প্রচণ্ড গ্রেনেড হয়ে ফেটে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধারা’ ‘বাংলার প্রতিটি ঘর আজ রণাঙ্গন- প্রতিটি মানুষ সাহসী মুক্তিযোদ্ধা- প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার জ্বলন্ত ইতিহাস’ কিংবা হানাদার পশুরা বাংলাদেশের মানুষ হত্যা করছে- আসুন আমরা পশু হত্যা করি’।অথবা ‘শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’।
আরিফও এখন নিজেকে প্রস্তুত করতে চায়।

গ্রেনেড হয়ে ফেটে পড়তে চায়। সে পারভেজ ভাইয়াকে বলে, ‘আমাকে আপনার সঙ্গে নেবেন। আমিও গ্রেনেড ছুড়ব’। গ্রেনেড ছুড়বে বললেই তো আর ছোড়া যায় না! তার জন্যও তো ট্রেনিং দরকার। আরিফের পীড়াপীড়িতে এবার গ্রেনেড ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ দিলেন পারভেজ ভাইয়া। কয়েকদিনের মাথায় একটা অপারেশনে নামতে হলো তাদের। সেখানেও আরিফকেও রাখা হয়েছে দলে।

তাদের কাছে খবর এলো- আগামীকাল আশিয়া ও ছনহরায় নামবে পাকিস্তানি মিলিটারি। খবরটি খুবই বিশ^স্ত ও নির্ভরযোগ্য। ফলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরু বাঙালি ঠিক করলেন= যেই রাস্তা দিয়ে মিলিটারিরা আসবে, সেই রাস্তার কোনো সুবিধাজনক জায়গায় তারা অ্যাম্বুশ করবেন। তাদের গতিরোধ করে তাদের আক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে চেষ্টা করবেন।

সিদ্ধান্ত মতো কাজ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানি মিলিটারিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের খতম করার পরিকল্পনা তৈরি। এমন এক জায়গায় অ্যাম্বুশ করা হলো, যেটি সম্মুখযুদ্ধের জন্য খুব উৎকৃষ্ট স্থান। কর্তালা বেলখাইন মহাবোধি হাইস্কুলের সামান্য উত্তরে তাদের অবস্থান।

সামনে পেছনে প্রায় চারশ’ গজের ভেতর প্রয়োজনীয় সব জায়গায় যোদ্ধাদের বিন্যস্ত করলেন কমান্ডার সিরু বাঙালি। পারভেজ ভাইয়াসহ অন্যদের হাতে ভারী অস্ত্র। আরিফ ও আরও দু’জনের হাতে গ্রেনেড। দুপুর ২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে যখন দেখলেন খান সেনারা এ পথ দিয়ে আসছে না, তখন অ্যাম্বুশ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

পুঁতে রাখা সব এন্টি পার্সোনাল মাইন ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র যখনই গুছিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন, তখন দূরে চোখ পড়ে আরিফের। সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার করে কমান্ডারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কমান্ডার লক্ষ করলেন, খান সেনারা এগিয়ে আসছে সামনে। পরক্ষণেই যে যার জায়গায় প্রস্তুত।

খান সেনাদের গাড়ি এগিয়ে আসছে। আরও এগিয়ে। এমন সময় অতর্কিত আক্রমণ। ট্রা ট্রার্ রার্ রা। ট্রা ট্রার্ রার্ রা। ট্রা ট্রার্ রা ট্রা। বুম। বুম . . .। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব ক’জন মিলিটারি খতম। গ্রেনেড ও মেশিনগানের আওয়াজে সারা গ্রামের মানুষ কাঁপছে থর থর করে। ভয়ে চিৎকার করছে কেউ কেউ। কেউ দৌড়ে পালাতে লাগল, আবার কেউ ছুটে এলো ঘটনাস্থলে।

খান সেনাদের ওপর হামলার খবর শুনে আত্মহারা অনেকেই। আরিফ আজ মহাখুশি। সে সফল এক অভিযানের সহযাত্রী। সে আনন্দে নাচছে। নিজ হাতে খতম করেছে আজ পাকিস্তানি পশুদের। গতকাল সন্ধ্যায় রেডিও থেকে শোনা কথাটি মনে পড়ে গেল তার : ‘হানাদার পশুরা বাংলাদেশের মানুষ হত্যা করছে- আসুন আমরা পশু হত্যা করি’। পশু হত্যা করতে পারার মধ্যে যে কী আনন্দ, সেটা আজ বুঝতে পারছে আরিফ। ওরা যদি এ গ্রামে ঢুকতে পারত, কী ভয়ংকর কাণ্ড-ই না ঘটাত! ভাবতে শিউরে ওঠে গা।

এরপর আর মিলিটারি আসার সংবাদ আসছে না। মনে হয় ওই ঘটনার পর ওরা জানতে পারল- ওখানে মুক্তিবাহিনীর বড় ঘাঁটি। তাই এদিকে আসার সাহস পায়নি। আশপাশের গ্রামে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করছেন। একেকটা দলের সঙ্গে অন্য দলের যোগাযোগ হয়, কথা হয়, সাক্ষাৎ হয়।

আরিফ এখন কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এখন তারও ঘুম নেই। খাবার নেই। নির্ঘুম রাত, অনাহারি দিন। ভোরে ঘুম থেকে ওঠে এখন আর চানখালী নদীর কাছে যায় না। নদী এখন তার সব সময়ের সাথী। লবণের নৌকা আসে আর যায়।

এখন সেই নৌকায় আরিফেরও বাস। চানখালি তাই এখন লবণের নদী নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নদী। ওখানেই ঘুম। ওখান থেকেই নির্দেশনা মতো কাজ করা। প্রতিটি নৌকায় রেডিও। তাতে বেজে চলে : ‘জয় বাংলা বাংলার জয়। হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়, কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধ রাতে নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়’।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper