ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

তাদের স্বপ্নে এগিয়ে চলুক দেশ

বিবিধ ডেস্ক
🕐 ৪:২৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয় তখন চূড়ান্ত। একে একে বিভিন্ন জেলা থেকে আসছিল বিজয়ের খবর, ঠিক সেই সময় পরাজয় নিশ্চিত জেনে নতুন একটি জাতিকে কোণঠাসা করতে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা ভয়ানক ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। তারা এ দেশের শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও মেধাবী সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

নীলনকশা
একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর থেকে গভর্নর এ এম মালিক ও সেনাপ্রধান জেনারেল নিয়াজির তরফে হেডকোয়ার্টারে লড়াই বন্ধের বার্তা পাঠানো শুরু হয়। মিত্রবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেলে তাদের পরাজয় আরো জরালোভাবে নিশ্চিত হয়। শর্ত হিসেবে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানি বাহিনীকে যেন নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে দেয়া হয়। অথচ তখন একই সঙ্গে চলে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা। পাকিস্তানি বাহিনী গঠিত দেশীয় গুপ্তঘাতক আলবদরের সদস্যরা নীল সংকেত পেয়ে নির্দেশনা অনুযায়ী, নির্বাচিত বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে আনে এবং মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে আটক করে নির্মম অত্যাচারের পর ১৪ ডিসেম্বর ভোরের আলো ফোটার আগে হত্যা করে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ওই ইটের ভাটায় গাদাগাদি করে ফেলে রাখে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বেসরকারি সংগঠন ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে তালিকা করে বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করেছিল। পরে এদেরকেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী। আর হত্যাকা-ের প্রধান সহযোগী হিসেবে আলবদর, রাজাকার, আল-শামস বাহিনীর ৫০০ সদস্যকে নিয়োজিত করা হয়। বুদ্ধিজীবী নিধনের মূল পরিকল্পনাটি হয় ১০ ডিসেম্বর। ওইদিন সন্ধ্যায় পিলখানায় ঢাকা কমাণ্ডের সদর দপ্তরে জেনারেল নিয়াজি, ফরমান ও জামশেদ উচ্চ পর্যায়ের সভা করেছিলেন। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ধরে আনার জন্য আগে থেকেই গাড়ির বহর প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। জেনারেল ফরমান আলীর ডেস্ক ক্যালেন্ডারের পাতায় লেখা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সবুজকে লাল রং করে দেয়া হবে। যেখানে হত্যার জন্য নির্বাচিত বুদ্ধিজীবীদের নামের আদ্যক্ষরগুলো পরপর লেখা ছিল।

রাও ফরমান আলি তার বাংলাদেশের জন্ম বইয়ে এই গ্রেপ্তার অভিযানের কথা স্বীকার করেন। তার ভাষ্যে, ১০ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের একটি নতুন আদেশের কথা তিনি জানতে পান। এর আগে এ ধরনের আরো একটি আদেশ সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে জারি করা হয়েছিল। ফরমান আলি তার বইয়ে গ্রেপ্তার বুদ্ধিজীবীদের কোথায় রাখা হয়েছিল সে বিষয়ে তথ্য না দিলেও এটি স্বীকার করেছেন যে এই বুদ্ধিজীবী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রহরায় ছিল রাজাকার-আলবদর বাহিনী।

কেন এই হত্যাযজ্ঞ
একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত বিজয় শিখরে পৌঁছাবে, ঠিক তখনই বুদ্ধিজীবীদের ওপর শেষ আঘাতটা হেনেছিল দখলদার পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী। বাঙালি জাতিকে চিরতরে মেধাশূন্য করার হীন চক্রান্তে সুপরিকল্পিতভাবে বেছে বেছে হত্যা করা হয় শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকদের। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যেন মেধায়-মননে শক্তিশালী না হয়, বাংলাদেশ যেন আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে- এটাই ছিল ঘাতকদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। এছাড়া আসন্ন পরাজয়ের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাও বুদ্ধিজীবী নিধনের আরেকটি কারণ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী এক চরম নিষ্ঠুর খেলায় তারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। বিকৃতির চরম পর্যায়ে না পড়লে তারা অবধারিত আত্মসমর্পণের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এমন নৃশংসতার পরিচয় দিত না। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যা শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা বিস্তৃত হয় সারা দেশে এবং ৯ মাসজুড়ে। সে সব বুদ্ধিজীবী হয়তো জাতীয় পর্যায়ের ছিলেন না। কিন্তু জেলা, থানা ও গ্রাম পর্যায়ে তাদের প্রভাব ছিল। জাতির মূল্যবোধ গঠনে তারা বড় ধরনের অবদানও রেখেছেন।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণ এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শুধু কয়েকটি প্রাণ নেওয়া হয়নি, পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল পুরো একটি জাতিকে। ইতিহাসবিদদের মতে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্তিম আঘাত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতা অর্জনের এতো বছর পরও জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। ফলে বাঙালি আজো জানতে পারলো না, জাতির কতজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে নোংরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করেছে পাকিস্তানীরা।

অজানা তথ্য
বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের মূল পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। স্বাধীনতার পর বঙ্গভবনে রাও ফরমান আলীর একটি ডায়েরি পাওয়া যায়। ওই ডায়েরিতে নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীদের তালিকা পাওয়া যায়। ডায়েরিতে উল্লেখ ছিল, ‘আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে। এই বদর বাহিনীর সদস্যরা হত্যার উদ্দেশ্যে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে’। স্বাধীনতার পর ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’ গঠিত হয়। ওই কমিশনের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়, পাকিস্তানি মেজর রাও ফরমান আলী শুধু ডিসেম্বরেই ২০ হাজার বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। ঘাতকদের নেতৃত্বে ছিলেন চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। মঈনুদ্দীন বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাদের হত্যা কার্যকর করার পরিকল্পনা করেন। আশরাফুজ্জামান বুদ্দিজীবীদের মৃত্যু কার্যকর করেন।
স্বাধীনতার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়। ওই ডায়েরিতে যেসব বুদ্ধিজীবীর নাম-ঠিকানা পাওয়া যায় তাদের সবাইকে ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়। রায়েরবাজার ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমিতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে নিজ হাতে আশরাফুজ্জামান হত্যা করেন বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়।

দায়ীদের প্রথম ফাঁসি
পুরো বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিল সেই সময়ের বর্বরতা, নৃশংসতা। প্রত্যক্ষ করেছিল, কিভাবে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর ৪৫ বছর ধরে এই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তানি দোসররা এত দিন স্বীকারই করেনি এ দেশে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনা, মানবতাবিরোধী ঘটনা ঘটেছিল। এ দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই বলেও দাম্ভিকতা দেখিয়েছিল কেউ কেউ। কিন্তু সব দম্ভ চূর্ণ করে দিয়ে ২০১৫ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার নকশাকারদের বিচার হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে প্রথম ফাঁসি কার্যকর হয় তৎকালীন আলবদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের।

বাংলা একাডেমির উদ্যোগ
১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক গ্রন্থ’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহের জন্য তখন বাংলা একাডেমি সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সে সময় বাংলা একাডেমী নিজেরাই ঠিক করে যে শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, প্রকাশকসহ বিশেষ কিছু পেশাজীবীকে ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

সেই নীতিমালা অনুযায়ী ১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২৫০ জনের তালিকা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। যে ২৫০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করা হয় তাদের অনেকেরই আবাসিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে বেশকিছু শহীদ বুদ্ধিজীবীর বিস্তারিত তথ্য যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কোষ গ্রন্থের নাম-ঠিকানা ধরে খোঁজ-খবর নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বেশ কয়েকজনের নিকটাত্মীয়ের লেখা সংকলিত করে ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে ‘স্মৃতি-৭১’ গ্রন্থ।
এ গ্রন্থের ১০ম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১০ম খণ্ডে স্থান পেয়েছে ১২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নিকটাত্মীয়ের স্মৃতিকথা। এর বাইরে বাংলা একাডেমী আর কোনো তালিকা সংগ্রহ বা প্রকাশ করতে পারেনি।

বধ্যভূমি ‘স্মৃতিসৌধ’
রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধটি ঢাকার মোহাম্মদপুরের রায়ের বাজারে অবস্থিত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে পাকিস্তানি শাসকচক্র বাংলাদেশকে চিরতরে মেধাশূন্য করার এক ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। তারা ভেবেছিল এদেশকে মেধাশূন্য করা গেলে বাঙ্গালি জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাবে। এজন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকেই তারা হত্যা করেছিল বাঙ্গালি জাতির বিবেক, চেতনা, মননশীলতা, ঐতিহ্য ও সংষ্কৃতির ধারক ও বাহক এ মাটির সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। ১০ থেকে ১৪ই ডিসেম্বরের মধ্যে এই বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহ রূপধারন করে। তাদের স্মৃতিকে স্মরনীয় করে রাখতে এই বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মান করা হয় যা রায়ের বাজার বধ্যভূমি ‘স্মৃতিসৌধ’ নামে পরিচিত। স্থপতি ফরিদ উদ্দীন আহমেদ বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেন পরিত্যক্ত সেই ইটের ভাটার আদলেই।

সমগ্র স্থানটি ৩.৫১ একর আয়তনবিশিষ্ট। এটি ১৫.২৪ মিটার বর্গাকার একটি গ্রিড দ্বারা বিভক্ত হয়েছে। মূল বেদিটি রাস্তা থেকে ২.৪৪ মিটার উঁচু। স্মৃতিসৌধের প্রধান অংশটি ১৭.৬৮ মি উঁচু, ০.৯১ মি পুরু ও ১১৫.৮২ মি দীর্ঘ একটি ইটের তৈরি বাঁকানো দেয়াল। এটি রায়ের বাজারের আদি ইটখোলার প্রতীক, যেখানে বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহগুলি পড়েছিল। দেয়ালটির দুদিক ভাঙা। এ ভগ্ন দেয়াল ঘটনার দুঃখ ও শোকের গভীরতা নির্দেশ করছে। দেয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম পার্শ্বে একটি ৬.১০ মিটার বর্গায়তনের জানালা আছে। এ জানালা দিয়ে পেছনের আকাশ দেখা যায়। স্মৃতিসৌধের প্রধান প্রবেশপথ চত্বরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। এপথে প্রবেশ করলে দর্শনার্থী একটি বটগাছের মুখোমুখি হন। এই বটগাছ নিকটবর্তী শরীর-শিক্ষা কলেজ প্রাঙ্গণস্থ আদি বটগাছের প্রতীকরূপ।

তালিকা
দেশে এখনো একাত্তরে নিহত বুদ্ধিজীবীদের তিন ধরনের তালিকা প্রচলিত রয়েছে। সরকার স্বীকৃত কোনো তালিকা না থাকায় এসব তালিকার কোনোটাকেই নির্ভরযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রিক কিছু শহীদ বুদ্ধিজীবীর প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু সারা দেশে নিহত বৃদ্ধিজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা তৈরি সম্পন্ন করা হয়নি। সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পক্ষে ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কত তা নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এত বছরেও এ সংখ্যা নিরূপণ করে ফেলা কেন হলো না, তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকের। জাতীয় পর্যায়ে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলনে আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজ উইকে প্রকাশিত টমালিনের লেখায় উল্লেখ ছিল, শুধু ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট এক হাজার ৭০।
‘বাংলাপিডিয়া’র প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, চিকিৎক ৪৯ জন, ৪২ জন আইনজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন। সব মিলিয়ে এই তালিকায় নিহত বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এক হাজার একশ’ ১১ জন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ১৫২ জনের নামে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করে সরকার। তবে পূর্ণাঙ্গ একটি তালিকা তৈরির লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানা যায়। স্বীকৃত তালিকা অনুযায়ী শুধু ১৪ ডিসেম্বর নয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পাকবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-
ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র)। ড. মুনির চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. সিরাজুল হক খান, ড. এ এন এম ফাইজুল মাহী, হুমায়ূন কবীর, রাশিদুল হাসান, সাজিদুল হাসান, ফজলুর রহমান খান, এন এম মনিরুজ্জামান, এ মুকতাদির, শরাফত আলী, এ আর কে খাদেম, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, এম এ সাদেক, এম সাদত আলী, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, রাশীদুল হাসান, এম মর্তুজা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-
ড. হবিবুর রহমান, ড. শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইউম। চিকিৎসক : অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, অধ্যাপক ডা. আলিম চৌধুরী। অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ। অধ্যাপক ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী ডা. হুমায়ুন কবীর। ডা. আজহারুল হক। ডা. সোলায়মান খান। ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী। ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার। ডা. মনসুর আলী। ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা।
ডা. মফিজউদ্দীন খান। ডা. জাহাঙ্গীর। ডা. নুরুল ইমাম। ডা. এস কে লালা। ডা. হেমচন্দ্র বসাক। ডা. ওবায়দুল হক। ডা. আসাদুল হক। ডা. মোসাব্বের আহমেদ। ডা. আজহারুল হক, ডা. মোহাম্মদ শফী। অন্যান্য : শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, সিরাজুদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, আলতাফ মাহমুদ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রণদাপ্রসাদ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ। জহির রায়হান, মেহেরুন্নেসা, ড. আবুল কালাম আজাদ, নজমুল হক সরকার, নূতন চন্দ্র সিংহ।

প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী
‘আমি ছাত্রের রক্তে রঞ্জিত এরপর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রের গায়ে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে’- শহীদ ড.শামসুজ্জোহা। তখন ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাস। স্থানীয় প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা ভেঙে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভে নামেন প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী। উত্তেজনাপূর্ণ এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলির আদেশ দেয় পাকসেনারা। উক্ত কথাটি বলতে বলতে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে বুক পেতে দিয়ে শহীদ হলেন অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা। দেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা তখন রাবির প্রক্টর। শিক্ষক জীবনেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয় একজন। শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘জোহা স্যার’ নামে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper