প্রবীণদের চোখে বিশ্ব দেখুন
মোশারফ হোসেন
🕐 ১০:০০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯
প্রবীণরা আমাদের শেকড়। গাছকে তার শেকড় যেমন শক্তভাবে ধরে রাখে, তেমনি প্রবীণরা তাদের জীবনের অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা দিয়ে আমাদের শত বন্ধুর পথকে মসৃণ করেন। আমাদের জীবনে নানাভাবে সাহস ও প্রেরণা দিয়ে উজ্জীবিত রাখেন। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রবীণদের অবদান অসীম।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, আধুনিকতাকে ছুঁতে গিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি অর্থাৎ বাংলার ঐতিহ্য ভুলে বহুমুখী কর্র্মব্যস্ততায় প্রিয়জনের প্রতি দায়বদ্ধতা উপেক্ষা করে ভুল সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছি। পরিবারকেন্দ্রিক চিন্তার বাইরে গিয়ে পারিবারিক বন্ধনকে দুর্বল থেকে দুর্বল করছি। আর এর ফলে বয়স বৈষম্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শ্রদ্ধাপ্রাপ্য অত্যন্ত আপন প্রবীণ মানুষটি।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ, এর মধ্যে এক কোটি প্রবীণই দরিদ্র। প্রবীণ নারী-পুরুষ, গ্রামের প্রবীণ ও শহরের প্রবীণ নানা শ্রেণিতে বিভক্ত। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী আমাদের দেশে ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তি প্রবীণ। এ ছাড়াও বয়সের ভিত্তিতে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যেমন : ৬০-৭০ বছর, ৭০-৮০ বছর, ৮০- আরও বেশি বয়স।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে ৬০-৮০ বছর পর্যন্ত জ্যেষ্ঠ নাগরিক (সিনিয়র সিটিজেন), ৮০ এর উপরে (সুপার সিটিজেন) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে। ২০৫০ সালে ২০০ কোটি যুবক বার্ধক্যে উপনীত হবে। এক্ষেত্রে গড়আয়ু যত বাড়বে প্রবীণের সংখ্যা তত বাড়বে। ক্ষমতায়ন অর্থাৎ অর্থবিত্তের ভিত্তিতে শ্রেণিকরণ করা যায়। এভাবে উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্য মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত প্রবীণশ্রেণি। এদের মধ্যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত প্রবীণ শ্রেণিটি নানাভাবে বঞ্চিত।
২.
প্রাকৃতির চরম বাস্তবতার নাম বার্ধক্য। শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের শেষ অধ্যায়ই বার্ধক্য। এই নিয়মের ভেড়াজাল থেকে রেহাই পায়নি ধনী-গরিব, রাজা-বাদশা, উজির-নাজির কেউই। সাধারণত কেউ রেহাই পায়ও না। জীবনসায়াহ্নে কর্মক্ষম, পরনির্ভরতা, একাকিত্ব, অসহায়ত্ব, দুর্বিষহ হতাশা, অপ্রাপ্তি, দুশ্চিন্তা, রোগ-শোক, জরা-জীর্ণতা, ইত্যাদি এসে বাসা বাঁধে প্রবীণদের মনে। বার্ধক্যের স্বাভাবিক নিয়তি হচ্ছে- শারীরিক পরিবর্তন, সেবাহীন-অবজ্ঞা, যত্নহীন-বেদনা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ইত্যাদি নিত্যদিনের সঙ্গী। এদের জীবন নামের রেলগাড়িটি চলতে থাকে শেষ অবধি মৃত্যুনামক স্টেশনে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত।
ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কোনো না কোনো শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। আর ১০ শতাংশ ভোগেন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায়। এ সম্পর্কে সচেতনতা না থাকার দরুন প্রবীণদের প্রতি আমাদের ভুল-বোঝাবুঝি হয়। খারাপ ব্যবহার করে থাকি। চুলপাকা, চুলপড়া, দন্তক্ষয়, দাঁত পড়ে যাওয়া, চোখে কম দেখা, কানে কম শোনা, গায়ের চামড়া কুঁচকে যাওয়া, চর্মরোগ, অপুষ্টিতে ভোগা, মুখে অরুচি, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ঘুম কম হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, হাত-পা-শরীর- কাঁপা, ঘন ঘন প্রশ্রাব, শারীরিক নানা জটিল সমস্যা দেখা দেয়। প্রবীণরা হাজারো সমস্যা, না পাওয়ার বেদনা নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে প্রহর গুনতে থাকেন, এক সময় মৃত্যু হয় সব সমস্যার সমাধানকারী।
আজকের সহায়-সম্বলহীন, পরনির্ভরশীল প্রবীণ, দয়া-দাক্ষিণ্যের ভেতর দিয়ে চলতে হয় তাকে। কারও কারও থাকার জায়গা হয় বিশাল ঘরের পাশের বারান্দায়। কখনো অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর, জরাজীর্ণ ছোট্ট একটি কুঠুরিতে, কখনো গোয়াল ঘরে। জীবনযাত্রার মান অনেক ক্ষেত্রে হাজতবাসীর চেয়েও নিম্নমানের অবস্থায় চলে যায়, হায় আফসোস!
৩.
প্রবীণদের সমস্যার ধরন অনেক ক্ষেত্রে একই হলেও আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন হয়ে থাকে। তারা বহুমাত্রিক সমস্যায় নিমজ্জিত। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সবক্ষেত্রে নানা বৈষম্যের শিকার হতো তারা। প্রবীণরা আচার-আচরণে চিন্তা-চেতনায়, ভাবপ্রকাশে, অনেকটাই শিশু হয়ে যায়। তাই এদের বলা হয় দ্বিতীয় শিশু। জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর সহজাত প্রবৃত্তি দানা বাঁধে। স্মৃতিকাতর হয়ে স্মৃতি হাতড়াতে থাকে।
শৈশবের সোনালি সকাল, কৈশোরের দুরন্তপনা, যৌবনের উন্মাদনার স্মৃতি তাদের কাতর করে ফেলে। চোখ ছল ছল করে ওঠে সামান্য অবহেলায়। দুমড়ে-মুচড়ে যায় হৃদয়। কবি গানে গানে বলেছেন এভাবে-দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল নাসেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি/কান্না হাসির বাঁধন তারা সইল না.সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি/কান্না-হাসির বাঁধন তারা সইল না/সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি/আমার প্রাণের গানের ভাষা/শিখবে তারা ছিল আশাউড়ে গেল, সকল কথা কইল না...।
শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে পরিবর্তন এসেছে সমাজ কাঠামোতে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে নানাভাবে। মূল্যবোধের অবক্ষয়, দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, আন্তঃপ্রজন্মের মধ্যে মানবিক গুণাবলির বিকাশের পথ রুদ্ধ হওয়ার মতো বিষয়গুলো জটিল রূপ নিচ্ছে। এক জরিপ থেকে জানা যায়, বর্তমানে যৌথ পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রবীণ ও শিশুরা।
জীবিকার খাতিরে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই বাইরে থাকতে হচ্ছে। অসহায় প্রবীণ ও শিশুটির অসহায়ত্বের ঘনত্ব বাড়ছে। অণুপরিবার গড়ে ওঠার কারণে প্রবীণদের দেখার অতিরিক্ত কোনো লোক থাকছে না। এক্ষেত্রে আন্তঃপ্রজন্মের বন্ধন আলগা হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে ভালোবাসা থেকে। এবং প্রবীণশিশু ও বর্তমান প্রজন্মের শিশু উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত মানসিকভাবে। দুই প্রজন্মের দুই শিশুর মন অত্যন্ত কোমল, বন্ধনের স্বাভাবিক ভারসাম্যহীনতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, অভিমান-ক্ষোভ-বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবে প্রবীণরা শিশুদের সান্নিধ্যে থাকতে বেশি পছন্দ করে। তাদের পছন্দগুলো বিবর্ণ হতে চলেছে। উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী নারী কম সম্পত্তি পান। আর যা পান সেটা বাস্তবে নিজের হাতে পাওয়াটা অনেক দুস্কর হয়ে যায়।
প্রবীণ পুরুষের ক্ষেত্রে নির্যাতনের হার যেখানে ৩৯.৬ শতাংশ, সেখানে প্রবীণ নারী নির্যাতনের হার ৫৪.৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, পিতা-মাতার ভরণপোষণের বিষয়টি। ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর (৩) এর ৩ ও ৪ নং ধারায় বলা আছে কিন্তু আইনে থাকলেই কী হবে। আদালতে গিয়ে সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করার নজির আমাদের সমাজ-বাস্তবতায় খুব কম।
৪.
যদিও পারিবারিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীত এটা। তারা যদি পরিবার ও রাষ্ট্র থেকে নিগৃহীত হয় তাহলে তাদের এই দুর্দশা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী হবে? তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার। তবু কিছু ব্যক্তি ও সংস্থা এগিয়ে আসছেন তাদের পুনর্বাসনের জন্য। সেটাও অপ্রতুল। যেমন গাজীপুরের হোতাপাড়ার বয়স্ক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে প্রবীণদের বিষয়ে বলা আছে যে, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নইলে অসহায় শ্রেণির লোকেরা যাবে কোথায়? স্মরণ না করলেই নয়।
তারা পরিবারে সহানুভূতি ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত; তবুও তাদের একটু ঠাঁই হচ্ছে এসব কর্মকাণ্ডে। এতে আমি আনন্দিত। বৃদ্ধাশ্রম কখনো বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অদূর ভবিষ্যতে পাবে কিনা জানি না। কিছু মানুষ আধুনিকতার নামে পশ্চিমা সামাজিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছে বৃদ্ধাশ্রম।
সরকারি হিসাব মতে- দেশে সরকারি ছয়টি মিলে ১৫টির বেশি বৃদ্ধাশ্রম আছে। এখানে অবস্থানকারীদের ৭০ শতাংশই নারী। নারী জাগরণের এই লগনে প্রবীণ নারীদের এই দৃশ্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। এত কিছুর পরও মন্দের ভালো হিসেবে পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে তারা বৃদ্ধাশ্রমকে বেছে নিয়েছে। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, অনেক প্রবীণ একসঙ্গে থাকার দরুন মনের কষ্টগুলো একে অপরের মধ্যে ভাগাভাগি করতে পারেন, যেটি অতি আপনজনের সঙ্গে পারেননি।
একান্নবর্তী পরিবার যেখানে সুখ-সমৃদ্ধি, মানবিক-নৈতিক পরিবেশ খেলা করে। সেটি ফিরিয়ে আনতে পারিবারিক বন্ধন, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার চর্চা খুব জরুরি। এক্ষেত্রে ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় পারিবারিক চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আন্তঃপ্রজন্ম সম্পর্ক তৈরির জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতিশাস্ত্র পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তকরণ, এ সক্রান্ত কাজের পুরস্কার ঘোষণা ও গবেষণার উৎসাহ দান।
প্রতিটি জেলায় বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে। এমনকি প্রবীণদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় বুঝতে পারার মতো প্রশিক্ষিত নার্স তৈরি করতে হবে। প্রবীণদের মনস্তত্ত্ব বুঝে তাদের উপযোগী বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন, প্রবীণদের কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি, কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
সুচিন্তিত মতামত দাতা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের জন্য হেল্পলাইন খুলতে হবে। প্রবীণবান্ধব খাবার হোটেল রেস্টুরেন্ট সরকারি বেসরকারিভাবে গড়ে তুলতে হবে। দেশ ও জাতির স্বার্থে ভবিষ্যৎ টেকসই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় মানবিক বিকাশের পথ-পরিক্রমায় ধারাবাহিকতা রক্ষার নিমিত্তে প্রবীণদের অর্জিত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-দক্ষতা-যোগ্যতা, ত্যাগ-অবদানের স্বীকৃত স্বরূপ সামাজিক অধিকার ন্যায়বোধ, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মানবতার জয়ের ধ্বনির প্রকাশ হোক এভাবে-শত বিপদে মোরা নই দিশাহীন, পাশে আছে অভিজ্ঞ প্রবীণ।
মোশারফ হোসেন : প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
[email protected]