ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে

সামসুজ্জামান
🕐 ৯:৫১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৯

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আমদের কৃষকরা যে ফসলে সামান্য লাভ পান, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রৌদ্দুরে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে উৎপাদন করেন সেই ফসল। কৃষকের বছরে একটি মাত্র ফসলই প্রধান। সেটি বোরো ধান। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত বেরুচ্ছে হাইব্রিড ধানের বীজ। কৃষক অধিক লাভের আশায় ফলন বেশি বলে চাষ করেন নতুন নতুন ধান। ফলনও হচ্ছে বাম্পার।

সেদিন টেলিভিশনের পর্দায় টক-শো’তে দেখলাম ধানের বর্তমান মূল্য পতন নিয়ে আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলছেন, ধান চালের বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই। থাকলেও তা ক্রিয়াশীল নয়। তিনি একথা টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বসে বলতে পারেন। কারণ, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাসে প্রচুর টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা কী তা তিনি বলেননি।

কৃষক রোদে পুড়ে, জলে ভিজে যে ধান উৎপন্ন করলেন, যে সোনালি ক্ষেত দেখে তার মন জুড়িয়ে যায়, কতটা কষ্ট পেলে তিনি নিজ হাতে পাকা ধানের ক্ষেতে আগুন লাগাতে পারেন। বাজারে এক মণ ধান তিনি ফড়িয়ার কাছে বিক্রয় করে পাচ্ছেন ৬০০-৬৫০ টাকা। অথচ এক মণ ধান কাটতে তাকে দিতে হচ্ছে কমপক্ষে ৭০০ টাকা। সরকারি ক্রয় নীতিতে স্বচ্ছতার অভাবেই দেশের কৃষকের মাথায় হাত উঠছে। ঘাড়ের গামছা দিয়ে চোখ মুছতে হচ্ছে। রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। অথচ ফলনের আনুপাতিক হারে তার তো মুখ জ্বল জ্বল করার কথা। আমাদের কৃষকদের বছরের ধান ঘরে থাকলে তারা থাকেন ফুরফুরে মেজাজে।

একুটু পেছন ফিরে তাকালে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হাওরের বন্যায় বোরো আবাদ পুরো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মোটা চালের দাম বেড়ে হয়েছিল ৬০ টাকায় আর সরু চাল বিক্রি হয়েছিল ৭০ টাকায়। বন্যার কারণে ৯ লাখ টন ধান কম হয়েছিল তাই এ অবস্থা। ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার চাল উদারীকরণের স্বার্থে আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করেছিল।

এতেও বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসায় শুল্ক ধার্য্য করা হয় ২ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৮ লাখ টন। তার মধ্যে চাল আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৯ লাখ টন। তারপরও বাজারে চালের দামের ওপর প্রভাব পড়েছিল খুবই কম। মোট চাল ৪০-৪৫ এবং সরু চাল ৬০-৬৫ টাকার কমে পাওয়া যায়নি। মাঝে লাভবান হয়েছেন ব্যবসায়ীরা আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ভোক্তা।

বিভিন্ন হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২০-২২ হাজার কোটি টাকা। এর সমুদয় অর্থই গেছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। এরপর দুটো বোরো এবং দুটো আমন ধানের ফলন ভালো হওয়ায় চালের দাম কমে এসেছিল সহনশীল পর্যায়ে।

অনেক অর্থনীতিবিদের অভিমত, হাইব্রিড চাষে এবার আশাতীত ফলন হওয়ায় ধানের বাজারে এই অবস্থা। আমাদের দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। আমাদের লক্ষ্য এখন উন্নয়ন। বলা যায় যে, অর্থনীতিবিদের ধারণা উৎপাদন কম হলেই ভালো হতো। আমাদের গড় প্রবৃদ্ধি এখন ৮ শতাংশ। যা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতকে টপকিয়ে গেছে। ২৫ এপ্রিল থেকে ধান খরিদের দিন ধার্য্য থাকলেও সময় মতো ধান খরিদ শুরু হয়নি। অথচ ধান উঠে গেছে আরও দু’সপ্তাহ আগে।

ধান কাটার পর কৃষকের বড় দুশ্চিন্তা থাকে বীজ, সার, কীটনাশক এবং পানির টাকা পরিশোধের। এ সুযোগটি এবারও ব্যবহার করেছেন মিল মালিক এবং ব্যবসায়ীরা। তারা কৃষকের দুর্বলতার সুযোগে মণ প্রতি ৫০০-৫৫০ টাকার ওপর ধানের দাম দেননি। অর্থনীতিবিদদের মতে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা শুধু রেপারির মতো।

বাজারের হস্তক্ষেপের কোনো দায় তাদের নেই। তাই যদি হয় তাহলে কৃষককে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য মূল্য নির্ধারণের প্রহসন কেন? কেনই বা খোলা বাজারে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে? দেশের জনগণ তথা কৃষকের প্রতি অবশ্যই দায়বদ্ধতা আছে সরকারের। সে কারণে বাজারে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় জরুরিভিত্তিতে। ধানের বাজারে এখন জরুরি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন সময়ের দাবি। কয়েকজন ব্যবসায়ীর অভিমত দ্রুত চাল রফতানি শুরু হলে বাজারে ধানের চাহিদা বাড়বে এবং কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন।

দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে কৃষকদের ১০ টাকার অ্যাকাউন্ট রয়েছে প্রায় ১ কোটি। সরকারি জনবল যখন আছে তখন ব্যবসায়ীরা হাট-বাজার থেকে ধান কিনতে পারলে সরকার কেন পারবে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নবগঠিত কমিটি নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল। পদবঞ্চিতদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়। ঢাবির এমন মারাত্মক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছিল। সরকারের সদিচ্ছাতেই সম্ভব হয়েছে এ কাজাটি। অথচ আজ দেশের কৃষকের কাছে ‘পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ হয়ে দেখা দিলেও কৃষিমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী এবং খাদ্যমন্ত্রী মহোদয় দিনের পর দিন চেষ্টা করেও ন্যায্যমূল্যে ধান খরিদের পন্থা বের করতে পারছেন না।

বাজেটে দেশে অনেক মেগা প্রকল্প রয়েছে। কৃষককে বাঁচানোর স্বার্থে তার ধানের ন্যায্যমূল্যের জন্য ধান খরিদকেও মেগা প্রকল্পের আওতায় নিতে ক্ষতি কী? ২০১০-১১ অর্থবছরে খাদ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৩ লাখ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৯৮ লাখ টনে। এ বছর উৎপাদন উদ্বৃত্ত হবে। এমন অবস্থায় কৃষকের উৎসাহ ধরে রাখতে হবে। না হলে ২০০৭-০৮ অর্থবছরের মতো আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের জন্য ধরনা দিতে হবে। আমরা দেখছি দেশে কৃষি বহুধাকরণ হচ্ছে। ধান চাষের জমি কমছে প্রতিনিয়ত। ফলে কৃষককে উৎসাহ দেওয়া অত্যাবশ্যক। সেই সঙ্গে রফতানি বৃদ্ধি অনেকাংশে বাড়াতে হবে। কমাতে হবে আমদানিনির্ভরতা।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তখন সদ্য স্বাধীন দেশে ছিল নানা সমস্যা। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। সেই পথ ধরে আজ আমরা একটি সম্মানজনক পর্যায়ে পৌঁছেছি। এখন সঠিক নীতি নির্ধারণ এবং কৃষকের স্বার্থে জিরো টলারেন্সে থাকতে হবে সরকারকে। আমরা পরনির্ভরশীলতা বাদ দিয়ে সব ক্ষেত্রেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। এক্ষেত্রে কৃষি অগ্রগণ্য কারণ আমাদের দেশ কৃষিভিত্তিক দেশ।

সামসুজ্জামান : সাংবাদিক।

 
Electronic Paper