ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আশার আলো দেখাচ্ছে বঙ্গোপসাগর

এমদাদুল হক বাদশা
🕐 ৯:৪৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০১, ২০১৯

অফুরন্ত পানি প্রবাহের নেটওয়ার্ক, প্লাবনপ্রবণ নিচু সমতল ভূমি, সমুদ্র নিয়ন্ত্রিত বদ্বীপ ও জলনির্ভর সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি অদ্বিতীয় সামুদ্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছে। প্রাচীনকালের বাংলাদেশ উজ্জ্বল সামুদ্রিক ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে পরিচিত যা শতাব্দীর পুরাতন সমৃদ্ধির পরিচায়ক। কিন্তু সেটি বিবদমান ঔপনিবেশিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আজ মৃতপ্রায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অতি স্বল্প সময়ে ‘টেরিটরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড ম্যারিটাইম জোন আইন, ১৯৭৪’ পাস করেন।

২০১২ সালে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার নীল অর্থনীতির অঞ্চল অর্জন করে এবং ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ম্যারিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। সামুদ্রিক বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের অংশ, নদী (ভূমির ৬ থেকে ৭ শতাংশ) এবং মৌসুমি জলাভূমি, প্লাবন ভূমি (৫৬ থেকে ৮০ শতাংশ)। সহস্র বছরের বঙ্গোপসাগর অদ্বিতীয় মিশ্র সংস্কৃতি, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের আঁধার। মহাসাগরের ২ দশমিক ১৭ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে বঙ্গোপসাগর মাত্র ০ দশমিক ৬ শতাংশ ভাগ দখল করেছে।

এতে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন ঘন ফুট বা বিশ্বের প্রায় ১ শতাংশ ভাগ সম্পূর্ণ অনাবিষ্কৃত তেল, গ্যাস মজুদ রয়েছে। আশা করা যায়, ২০৫০ সাল নাগাদ বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের দেশগুলো মাত্র ৪ দশমিক ৭ ভাগ ভূমি অধ্যুষিত বিশ্বের ২৯ দশমিক ৬৯ ভাগ জিডিপি অর্জন করবে। তখন ৫৬ দশমিক ৫১ ভাগ জিডিপি বঙ্গোপসাগরের ১০০০ কিলোমিটারের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হবে (বিশ্বের ১১ দশমিক ৩ ভাগ ভূমি এলাকায়)।

বিশ্বের সর্বোচ্চ স্তরের জিডিপি যা ১০০০ কিলোমিটার বৃত্তের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হবে। আর তাতে ১ম চীন, দ্বিতীয় ভারত, ৪র্থ ইন্দোনেশিয়া, ২৩তম বাংলাদেশ, ২৪তম মালয়েশিয়া, ২৫তম থাইল্যান্ড। এছাড়াও সিঙ্গাপুর, মিয়ানমার এবং শ্রীলংকা সমকালীন এলাকা, চীনের দক্ষিমুখী কৌশল, ভারতের দর্শন ও পূর্বমুখী নীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পুনঃভারসাম্য রক্ষা কৌশল তখন বঙ্গোপসাগরমুখী হবে। এই দৃশ্যপটে বঙ্গোপসাগর সুদীর্ঘ তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে একটি হটস্পট বা স্পর্শকাতর স্থান হয়ে উঠেছে এবং কৌশলগতভাবে উপকূলীয় এবং ভূম-লীয় কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে চলেছে।

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একটি পরিমাপগত অধিকার এবং নদ-নদীর একটি সম্ভাবনাময় নেটওয়ার্ক রয়েছে। এটি সমুদ্রে প্রবেশে আগ্রহী বিশাল স্থলবেষ্টিত অঞ্চলে (ক্রসরোড) অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের সামুদ্রিক সুবিধাদি লাভের অগ্রযাত্রায় নতুন দীগন্তের দ্বার উন্মোচন করছে।

ইষঁব ঊপড়হড়সু- নীল অর্থনীতির কতিপয় উৎস এখানে উল্লেখ করা হলো-
নৌবাণিজ্য : বাংলাদেশের ৯০ ভাগ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যই জাহাজের মাধ্যমে পরিবাহিত হয় যার প্রায় ১০ ভাগ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর জাহাজযোগে পরিবহনও ৭ ভাগ হারে বৃদ্ধি পায়। চট্টগ্রাম কাস্টম একাই প্রায় ২৮ দশমিক ৮ ভাগ জাতীয় রাজস্বের উৎস।

২৫ ভাগ নৌবাণিজ্য সংশ্লিষ্ট শুল্ক অর্থ হচ্ছে- বাংলাদেশ সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানি করে বিলিয়ন টাকা আয় করতে পারে। অভ্যন্তরীণ নৌপথে বছরে প্রায় ১১০ বিলিয়ন কিলোমিটার যাত্রী এবং ১৮৬ বিলিয়ন কিলোমিটার মালামাল পরিবহন করতে পারে। যদি অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থা আরও দক্ষ ও উন্নত করা যায় তাহলে বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ ভাগ এবং বৈদেশিক বাণিজ্য ২০ ভাগ বৃদ্ধি করতে পারবে।

মৎস্য আহরণ : বাংলাদেশ মৎস্য আহরণে বিশ্বে তৃতীয়, জলজ প্রাণী পালনে ৪র্থ এবং জাতীয় রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে ফিশারী ২য়। এটি জাতীয় পুষ্টির ৮০ ভাগ, জিডিপির ৩ দশমিক ৬৯ ভাগ এবং মেরিন ফিশারি একাই ১১ থেকে ১৩ মিলিয়ন চাকরির সংস্থান করে। এবং এ মাধ্যমেই ১৪ মিলিয়ন লোকের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে।

খনিজ পদার্থ : বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় ১১টি অগভীর এবং ৫টি গভীর জলের খনিজ পদার্থের ব্লক আছে। দ্বীপাঞ্চলের ব্লকগুলোতে ৪০ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের উপকূলীয় বেল্টে ১৭টি ডিপোজিটে মূল্যবান খনিজ/আকরিক এবং ভারী খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছে।

লবণ চাষ : দেশের প্রায় প্রায় ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ সামুদ্রিক লবণ উৎপাদনে নিয়োজিত। এতে ১৫ মিলিয়ন টনেরও বেশি লবণ উৎপাদন করে দেশের প্রায় ৮৭ ভাগ চাহিদা মেটে।

মিঠা পানির উৎস : বিশ্বের প্রায় ০ দশমিক ০৯ ভাগ ভূমি এলাকা সংবলিত বাংলাদেশ আয়তনে ৯৮তম। অপরদিকে মাত্র ১২২৭ কিলোমিটার বার্ষিক (বিশ্বের উৎপাদনের প্রায় ২ দশমিক ২ ভাগ) নবায়নযোগ্য মিঠা পানি উৎপাদন ক্ষমতায় বাংলাদেশ ১২তম। যথাযথ সংরক্ষণ ও পানির উৎসের প্রতি নজর প্রদানই জাতিকে বিশেষ উপকৃত করতে পারে।

জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙা শিল্প : জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৩তম এবং জাহাজ ভাঙতে ৩য়। এ দুটি সেক্টর দেশকে ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে। তাই এদিকও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

ভূমি পরিবৃদ্ধি/উপলেপন : বাংলাদেশের নদ-নদীসমূহ প্রতি বছর ১ দশমিক ৪ থেকে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন টন পলি মাটির (সেডিমেন্ট) উৎস যার অধিকাংশ বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।

এছাড়াও ১৯৫০ সাল থেকেই বাংলাদেশ ১৮ বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি দাবি করে আসছে। অধিক পলি বাংলাদেশকে নতুন ভূমি অর্জনের ক্ষেত্র ত্বরান্বিত করবে। সাগর মহাসাগর এবং বৃহৎ নদী বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে সংযোজিত করে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে গলিত (মেল্টিং) করে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি আরও উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থান সামুদ্রিক ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের প্রভূত সমৃদ্ধির দাবি রাখে। এই অঞ্চলে যোগাযোগের স্থাপত্য এবং নিরাপত্তার উৎসের উন্নয়ন সহজ নয়।

এক্ষেত্রে একটি সুস্থ সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম ও ভারসাম্যপূর্ণ শাসন প্রক্রিয়া অপরিহার্য। পূর্বের সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি এখনো সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে সনাতন পদ্ধতির ওপর জোর দিচ্ছে। এরূপ অবৈজ্ঞানিক এবং তাৎক্ষণিক প্রয়োজনভিত্তিক সম্পদ আহরণ দ্রুত সম্পদ নিঃশেষের কারণ। একই সঙ্গে তা সামুদ্রিক প্রজাতির সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সমুদ্রের স্বাস্থ্যকে অক্ষুণ্ন রেখে সম্পদ আহরণের পদ্ধতি অব্যাহত রাখতে সক্ষম।

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। এর সঙ্গে সমুদ্র আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সুতরাং সমুদ্র সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে পূর্ণ প্রয়োগ ও সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।

এমদাদুল হক বাদশা
নদী গবেষক ও সাবেক পরিচালক, বিআইডব্লিউটিএ

 

 

 
Electronic Paper