ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সিন্ডিকেট নৈরাজ্য বন্ধ করুন

আশেক মাহমুদ
🕐 ৯:১৮ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২২, ২০১৯

জনগণের মধ্যেই প্রশ্ন-এ দেশে কারা অধিক ক্ষমতাবান? জনগণ, রাষ্ট্র, সরকার নাকি সিন্ডিকেট? রুশোর সেই ‘জনগণই সার্বভৌমত্ব’, লকের ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’, জ্যা পল সার্ত্র্যরে সেই ‘স্বাধীনতা তত্ত্ব’ এখন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি।

পেঁয়াজ মূল্যস্ফীতিতে ডাবল সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে ২৫০ পার হয়ে গেছে। সেই সেঞ্চুরিতে কত মানুষ কষ্ট পাচ্ছে তা কিন্তু না বোঝার কিছু নেই। একটা স্বাধীন দেশে জনগণের ভাগ্য দেখার কি কেউ নেই? যারা উচ্চ মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত, তাদের অনেকেই অবৈধ আয় করে বলে তাদের তো কিছু যায় আসে না। কিন্তু যারা গরিব, যারা চাল কিনতেই মাথার ঘাম পায়ে পড়ে তাদের বিস্বাদ খাবারেই থাকতে হচ্ছে। সন্তান বলছে, মা গো, খাবারে স্বাদ নেই কেন? মা কান্না করে বলছে, তোর বাবা পেঁয়াজ নিয়ে আসলে স্বাদ পাবি। কয়টা দিন সবুর কর, কাঁদতে কাঁদতে বলে। কিন্তু সবুর যতই করে ততই দাম বেড়ে চলছে।

এতগুলো বছর কেটে গেল, তবু আমরা কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের বদলে বিদেশ নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছি কায়েমি গোষ্ঠীর স্বার্থে। আমরা আমাদের নদীর পানি পাচ্ছি না, এ নিয়ে আমরা আমাদের স্বাধীন নীতি ধরে রাখতে পারিনি। আমাদের কৃষকরা উৎপাদনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তবু সাধারণ মানুষ বেঁচে আছে মূল্যস্ফীতিকে সহ্য করেই। কিন্তু এভাবে যদি চলতেই থাকে, এক সময় চাল আমদানি কমে গেছে নাম দিয়ে সিন্ডিকেট বাজারে চালের দাম বাড়াতে বাড়াতে ৪০০ টাকা করে ফেলবে। হয়তো বলবেন-কিভাবে? একি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। কারণ ঐকিক অঙ্ক করে দেখুন-২৫ টাকার পেঁয়াজ বেড়ে যদি ২০০ টাকা হয়, তাহলে ৫০ টাকার চালের দাম বেড়ে হবে ৪০০ টাকা। আর তখনই শুরু হয়ে যাবে দুর্ভিক্ষ। পেঁয়াজের এই দুর্মূল্য কি আমাদের এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, অপেক্ষা করুন আগামীতে আমরা চালের দাম বাড়িয়ে ৪০০ টাকা করব।

এদিকে লক্ষ্য করছি, অনেক দিন ধরে পেঁয়াজের দাম বাড়ানোকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে যে আপত্তি ও ক্ষোভ ছিল তা এখন চরম হাসির বিষয় হয়ে গেছে। আচ্ছা বলুন তো, পেঁয়াজ নিয়ে আমরা এত হাসাহাসি করি কেন? পেঁয়াজের দাম বেড়েছে অনেক, আমাদের তো ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা, রাগ দেখানোর কথা, কষ্ট পাওয়ার কথা। অথচ তা না করে আমরা গল্প করি, হাসি মজা নিচ্ছি পেঁয়াজের নাম ধরে।

ফেসবুকে ট্রলের বন্যা হয়ে গেছে। কেউ বলছে একটির বেশি পেঁয়াজ নয়, অর্ধেক হলে ভালো হয়। কেউ যদি কাউকে সামান্য কথায় একটু আঘাত করে তখনি সে হয়তো কষ্ট পেয়ে কান্না করে, যদি বেশি কষ্ট দেয় বা নিপীড়ন করে তখন সে কাঁদে না বরং ক্ষোভ ঝাড়ে, কেউ অন্যায় মেনে নিতে না পেরে প্রতিবাদ করে। অথচ যখন অবিচারের মাত্রা ধারণার সীমাকে অতিক্রম করে তখন সে ক্ষোভের ভাষা হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তারপর থেকে সে হাসতে থাকে। এই হাসি কোনো খুশি বা তামাশার হাসি নয়।

আজ যখন দেখছি, ২২ টাকার পেঁয়াজের দাম বেড়ে ২৫০, তখন ক্ষোভ প্রতিবাদ ভুলে আমরা বাকরুদ্ধ, হারিয়ে ফেলেছি ভাষাজ্ঞান। এই ভাষাজ্ঞান হারিয়ে ফেলা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, দেশের সংকটে, জনগণের সংকটে, জনগণের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছে যারা অনুগত থেকে স্বার্থসিদ্ধিকেই বুদ্ধিদীপ্ত মনে করে, এক শ্রেণির শিক্ষক সমাজ আছে যারা অর্থ উপার্জন কত অধিক করা যায় সেই সাধনায় লিপ্ত, বড় আকারের আমলাশ্রেণি তো লুটপাটের নেতৃত্ব দিয়ে চলছে।

এ দেশে লাখ লাখ মসজিদ আছে। অথচ এসব মসজিদে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তেমন কিছুই বলা হচ্ছে না। এখানে ওদেরই চাকরি দেওয়া হয় যারা শুধু এই প্রচার করবে যে, পরকালে কত সহজে পার পাওয়া যাবে, কিন্তু জনগণের অধিকার নিয়ে এখানে কিছুই বলতে দেওয়া হবে না। এদিকে দেশের জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যে থেকে এখনো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর মতো নেতৃত্ব তৈরি হয়নি।

সেই হতাশা থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি চেপে বসা অন্যায় নিয়ে ট্রল করে, গরিবেরা হায় হায় করে আর ধনীরা নিশ্চিন্তে ঘুমায়। আমার প্রশ্ন হলো, দেশে সিন্ডিকেট কি করে সার্বভৌম ক্ষমতা পেয়ে যায়? হবস না বলেছিল, জনগণ যখন নিরাপত্তাহীনতায় বাস করে, যখন স্বার্থ সিদ্ধির কারণে দুর্বলের অস্তিত্ব থাকে না তখনই রাষ্ট্র আবির্ভূত হয় সার্বভৌম শক্তি নিয়ে। অথচ কোন সেই শক্তি, যে শক্তির বলে সিন্ডিকেট পায় লুটের স্বাধীনতা, কৃষকরা পায় না তাদের অক্লান্ত খাটুনির মূল্য।

যারা উৎপাদন করে তাদের বঞ্চিত করে সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। কৃষকরা ২৬ লাখ টন চাহিদার মধ্যে বছরে ১৮ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করলেও সিন্ডিকেট পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটছে অথচ টিসিবিকে দুর্বল ও অক্ষম করে রাখা হয়েছে। এর ফলে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক, ভুক্তভোগী হচ্ছে জনগণ, আর শক্তিশালী হচ্ছে অসাধু সিন্ডিকেট। কতটা অসাধু হলে এই চারমাসে এক পেঁয়াজ থেকেই এরা লুটে নেয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।

এসব দেখভালের কেউ কি নেই? আমাদের কি কোনো অভিভাবক নেই? এভাবে যদি অথর্ব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ক্ষমতায়ন হয় তাহলে এই সিন্ডিকেটই দেশে দুর্ভিক্ষ নিয়ে আসবে। এই বাংলায় ব্রিটিশ আমলে ১৯৪৩-এ দুর্ভিক্ষ হয়, এর কারণ ছিল জমিদারদের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসক শ্রেণির স্বার্থগত বন্ধন। তখন ওই জমিদাররাই রাজাকারের ভূমিকায় ছিল।

বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণ নিয়ে লিখতে গিয়ে অমর্ত্য সেন গবেষণা পত্রে দেখান যে, সে সময় বাজারে পণ্য ছিল যথেষ্ট, কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে বাজার ছিল সিন্ডিকেটের দখলে, সেই শ্রেণির লুটপাটের বলী দিতে হলো সাধারণ জনগণকে, মৃত্যু উপত্যকার মধ্য দিয়ে। এভাবে কি আমাদের এই স্বাধীন দেশ চলবে? দেশ কি যুগে যুগে দুর্নীতিবাজদের হাতে জিম্মি থাকবে? কবে বন্ধ হবে এদের দৌরাত্ম্য? কবে দেশের মানুষ স্বস্তি পাবে? কবে দেশের সমস্যা নিয়ে এ দেশের জ্ঞানীদের মুখে জ্ঞান ফুটবে? অতি দ্রুত সরকারের উচিত জনগণের স্বার্থে কালো সিন্ডিকেট ধ্বংস করা।

আশেক মাহমুদ
সহকারী অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
[email protected]

 
Electronic Paper