ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রেশন

হাসান মাহমুদ বজ্র
🕐 ১:১১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৪, ২০১৯

-আমার চাদরটা দে মা, মেম্বার বাড়িতে যাই একটা কার্ড যদি পাই। কোথায় থেকে ছুটতে ছুটতে এসে মেয়েকে বলল জমিলা। বর্ণিলা ছেঁড়া চাদরটা হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই ছেঁড়া চাদর মা আর কতকাল গায়ে দেবে? এই চাদরটা নাকি বর্ণিলার মায়ের বিয়ের সময় বর্ণিলার বাবায় কিনেছিল। কত কাল গত হলো, কিন্তু এই ছেঁড়া চাদর এখনো রয়ে গেছে। কত কিছু ভাবতে ভাবতে মায়ের সামনে চাদর খানা এগিয়ে দিল বর্ণিলা।

মেয়ের হাত থেকে চাদর খানা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে দ্রুত মেম্বার বাড়ির দিকে যেতে লাগল বর্ণিলার মা জমিলা বিবি। জমিলা বিবি গাঁয়ের হাসমত জোরদারের বউ। হাসমত জোরদার পাঁচ ছেলে-মেয়েকে রেখে মরেছে অনেক আগেই। মরার সময় ভিটেটা ছাড়া কিছুই রেখে যেতে পারেননি।

সারাদিন মানুষের বাড়িতে কাজ করে তার বিধবা স্ত্রী ছেলে-মেয়ে বড় করছে। দু-বেলা উপোস করে এক বেলা খেয়ে কয়জনই বা আর বাঁচতে পারে। খাবারের জন্য না মরলেও অসুখে ওষুধ না পেলে মরণ তো অবশ্যম্ভাবী। হাসমত জোরদারের মৃত্যুর পর তার দেড় বছরের ছেলে ইকরাম নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, এর কিছুদিন পর আকরাম মারা যায় পানিতে ডুবে।

ইকরাম-আকরাম দু-ভাই জমজ ছিল। দুই ছেলেকে হারিয়ে যখন জমিলা বিবি পাগল প্রায় ঠিক তখনি তার পাঁচ বছরের মেয়ে মনি হারিয়ে যায়। কত খোঁজা-খুঁজি করেও মনিকে পাওয়া গেল না। তিন ছেলে মেয়েকে হারিয়ে যখন জমিলা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে তখন তার ১৩ বছরের বড় ছেলে বরুণ ইটভাটায় কাজ করে সংসার চালাতে শুরু করে, আর বর্ণিলা মায়ের দেখাশোনা করত। এভাবে অনেক বছর চলে গেছে, এখন বর্ণিলা বড় হয়েছে। জমিলা বিবি পুরোপুরি সুস্থ না হলেও হাঁটাহাঁটি করতে পারে, হাতের কাজ করতে পারে। বর্ণিলার বড় ভাই বরুণ এখন আর তাদের সঙ্গে থাকে না, বিয়ে করে বউ নিয়ে শ্বশুর বাড়ি থাকে।

এখন আর মা-বোনের খোঁজ নেয় না। এখন মা-মেয়ে বাঁশ-বেতের কাজ করে কোনোরকম বেঁচে আছে। তাদের মা মেয়ের আর কী চাই, দু-মুটো ভাত ছাড়া? এতক্ষণ মায়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে পুরনো সব কথা ভাবছিল বর্ণিলা। জমিলা বিবি চোখের আড়ালে চলে গেলে চেতনা ফিরে পায় বর্ণিলা। ক্ষিপ্র পায়ে ঘরে গিয়ে ভাঙা চার পায়ার ওপর বসে। বসতেই পুরনো চকিটা মর্মর আওয়াজ করে। আর কত, বাবার কেনা চকি, আর টিকবে কত দিন? বিছানো ময়লা ছেঁড়া কাঁথার ওপর গা এলিয়ে দেয় বর্ণিলা।

বুকের ভেতর থেকে চিঠিখানা বের করে হারিয়ে যায় স্বপ্নের রাজ্য। যেখানে বর্ণিলা মহারাণী, আর তার রাজা বিরল। মেম্বার বাড়ির দরজায় নারী-পুরুষের ভিড়, লম্বা লাইনে দাঁড় করিয়ে কার্ড দিচ্ছে মেম্বারের সহকারী। মেম্বার সাহেব সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে আর সবাইকে জেরা করছে তাকে ভোট দিয়েছে কি-না? আগামীবার তাকে ভোট দেওয়ার স্বীকারোক্তি নিয়ে সবাইকে কার্ড দিচ্ছে। অনেক লম্বা লাইন। জমিলা বিবি গিয়ে লাইনে দাঁড়ালো। মাথার উপরে জ্বলন্ত সূর্য তার তেজের প্রখরতা দেখাতে ব্যস্ত। সবার গায়ের অবিরত ঘাম গড়িয়ে পড়ছে শক্ত মাটিতে। তবুও কেউ লাইন থেকে এক পা নড়তে রাজি নয়।

শুনেছি এবারের রেশনে ২০ কেজি চাল দেবে। তাতো কম কথা নয়। বছরে একবার সরকার থেকে এই রেশন আসে, কিন্তু ২০ কেজি বলা হলেও চাল দেয় ১৪-১৫ কেজির মতো। গত বছর জমিলা বিবিকে কার্ড দেয়নি ভোট দেয়নি বলে। এবারে দেবে কি-না কে জানে? ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় জ্বলন্ত সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার পর জমিলা বিবি মেম্বারের সহকারী পর্যন্ত পৌঁছাল।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper