ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অনন্য দানবীর আর পি সাহা

বিবিধ ডেস্ক
🕐 ২:৩০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৩, ২০১৯

মানবতা বোধের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম রণদা প্রসাদ সাহা, সংক্ষেপে আর পি সাহা। ছিলেন একজন সংগ্রামী, আত্মপ্রত্যয়ী মানবসেবক, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক ও শিল্পানুরাগী। নিতান্ত দরিদ্র থেকে দানবীর খেতাবে পরিবর্তিত হওয়ার সংগ্রামী গল্প দুনিয়াখ্যাত। ১৫ নভেম্বর এই মহান চরিত্রের জন্মতিথি। তার জন্য সশ্রদ্ধ প্রণাম-

শৈশবের রণদা
ছেলেবেলা থেকেই রণদা প্রসাদ ছিলেন দুরন্ত- হাসিখুশি, চঞ্চল, নির্ভীক স্বভাবের। বাল্যের দুরন্তপনার ভেতরেই হয়তো লুকানো থাকে উত্তরকালের বৈপ্লবিক সম্ভাবনা। অঙ্কুরের মধ্যেই তো থাকে বনস্পতির সংকেত। রণদা প্রসাদের ভবিষ্যৎ বিপ্লবের পথচিহ্ন যেন আঁকা হয়ে গিয়েছিল তার আপন শৈশবেই।
সারা দিন কাটত প্রতিবেশীদের আম-কাঁঠালের বনে, বাড়ির পাশ দিয়ে বহতা লৌহজং নদীতে সঙ্গীদের সঙ্গে সাঁতার কেটে, মাছ ধরে, গোল্লাছুট খেলে। মেধার অভাব না থাকলেও পড়াশোনায় ছিলেন বড়ই উদাসীন। শোনা যায় নতুন নতুন দুষ্টুমির কায়দা বের করে প্রতিবেশীদের জ্বালাতন করতেন নিত্যদিন।
প্রথম স্ত্রী বিগত হওয়ায় দেবেন্দ্রনাথ আত্মীয়-পরিজনের পরামর্শে ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করার জন্য দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম কোঁকন দাসী। কিন্তু সৎ মায়ের সংসারে ঠাঁই হলো না রণদা প্রসাদের। বাবা তাকে পাঠিয়ে দিলেন শিমুলিয়ায় মামাবাড়িতে। ইতিমধ্যে ছোটভাইকেও এক জমিদারের কাছে পুষ্যি দেওয়া হয়েছে। রণদাপ্রসাদ স্থানীয় নিম্ন-মাধ্যমিক পাঠশালায় তৃতীয় শ্রেণির পর আর এগুতে পারেননি। কারণ নানাবাড়িতেও স্নেহকাঙাল মন শান্তি পেল না। পালিয়ে গেলেন নিরুদ্দেশে, যখন সবেমাত্র কৈশোরে পা দিয়েছিলেন। অনেক খোঁজখবরের পর জানা গেল নতুন জীবনের সন্ধানে সবার অলক্ষে পৌঁছে গেছেন কলকাতায়।

নজরুল সঙ্গে সখ্য
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জোর দাবি উঠল, বাঙালিদের সৈন্যদলে ভর্তি করা হোক। শেষ পর্যন্ত গণদাবির চাপে ইংরেজ সরকার তাদের নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। রণদাপ্রসাদ সাহা বেঙ্গল রেজিমেন্টে অস্থায়ী সুবেদার মেজর পদে যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে বাঙালি পল্টনের সঙ্গে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য চলে যান করাচি। সেখানে তার সঙ্গে এক অদ্ভুত ছেলের পরিচয় ঘটে। লম্বা চুল, বড় বড় চোখ আর প্রাণবন্ত এক উড়নচণ্ডী সভাবের ছেলে। সবাই রণদাপ্রসাদকে ভয় পায়। কিন্তু ওই ছেলেটির কোনো পরোয়া নেই। কাউকেই তার পরোয়া নেই। চাকরি করে সামরিক দলে, চুল হলো বেসামরিক; মানে ঝাঁকড়া। রণদাপ্রসাদ সাহা একদিন তাকে ডেকে পাঠালেন।
‘কাজী, তুমি গান গাও?
‘আজ্ঞে অল্পবিস্তর চিৎকার করি বটে।’
‘কবিতা লেখ?’
‘লোকে তেমন দুর্নামও করে।’
‘বেশ, তোমাকে রেজিমেন্টের সংগীত বিভাগেই দিলাম।’ সেই দিনের সেই ছেলেটিই বিদ্রোহী কবির কাজী নজরুল ইসলাম। কবি সেদিন তার পছন্দের কাজটি পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। করাচি সেনানিবাসে নজরুলের সাহিত্যচর্চার সঙ্গে সংগীতচর্চাও অব্যাহত গতিতে চলেছে। সেনাবাহিনীতে মিলিটারি ব্যান্ডের বদৌলতে ভালো বাদ্যযন্ত্রের অভাব ছিল না, নজরুল সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলেন।
কবির সঙ্গে রণদা প্রসাদের সখ্য গড়ে উঠেছিল সহজেই। সৈনিক জীবনের শিক্ষা যে তাদের দুজনের অভিজ্ঞতাকে প্রসারিত করতে, দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করতে, সর্বোপরি জীবনকে চিনে নেওয়ার প্রস্তুতিকে পূর্ণতা দান করেছে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সৈনিক জীবন যেন নজরুলকে বাংলার প্রাদেশিক গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বভারতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক চেতনাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তেমনি সৈনিক জীবনের শৃঙ্খলাবোধ ও সংঘবদ্ধ সমবায়ী জীবনযাপন রণদা প্রসাদ সাহাকে পূর্ণ দায়িত্ববান যুবকে পরিণত করেছিল।

উত্থান পর্ব
দেবেন্দ্রনাথের তিন পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে রণদা প্রসাদ দ্বিতীয়। দেবেন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষ ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই সূত্রেই বোধহয় রণদা প্রসাদের ব্যবসায়িক বুঝ-বুদ্ধি প্রখর। তখনকার সময় তিনি তার ব্যবসায়িক বুদ্ধিবলে হয়েছিলেন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। কিন্তু সেই পর্যন্ত পৌঁছতে তাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।
কিশোর রণদা প্রসাদ যখন বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা যান, তাকে কত কিছু করেই না জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছিল। কুলি, শ্রমিক, রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা প্রভৃতি কাজ করে তিনি দুবেলা খাবার জোটাতেন। এক পর্যায়ে রণদা জাতীয়তাবাদী বা স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ও হাজতবাসও করেন।
এরপর প্রথম বিশ^যুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সৈনিকদের জন্য সরকার থেকে যোগ্যতানুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। রণদা রেলবিভাগে টিকিট কালেক্টর পদে চাকরি পান। তার কর্মস্থল ছিল শিয়ালদহ রেলস্টেশন থেকে দর্শনা হয়ে সিরাজগঞ্জঘাট রেলস্টেশন পর্যন্ত রেলপথ।
তিনি ১৯৩২ সাল পর্যন্ত রেল বিভাগে চাকরি করে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের এককালীন অর্থ দিয়ে কলকাতায় তিনি কয়লা ও লবণের ব্যবসা শুরু করেন।
পরবর্তীতে কয়লার ব্যবসা অধিক লাভজনক হওয়ায় লবণের ব্যবসা ছেড়ে শুধু কয়লার ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। প্রথমদিকে তিনি নিজে বাড়ি বাড়ি কয়লা সরবরাহ করতেন। পরবর্তীতে তিনি কয়লার ঠিকাদারি ব্যবসাসহ সরবরাহের কাজ শুরু করেন এবং কলকাতায় কয়লার ডিলারশিপ নেন। এতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বড় আকারের পুঁজি সংগ্রহ করেন। কয়লা ব্যবসায় মুক্তাগাছার জমিদার সতীশ চৌধুরী রণদাকে সহায়তা করেন।
এ সময় নদীপথে চালিত লঞ্চসমূহের ইঞ্জিন কয়লা দ্বারা চালিত হতো। এসব লঞ্চ সার্ভিসের মালিকদের কেউ কেউ তার কাছে দেনাদার হয়ে পড়লে তিনি দেনার বিপরীতে তাদের লঞ্চগুলো কিনে নেন। রণদা লঞ্চগুলোকে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে কয়লা পরিবহনের কাজে ব্যবহার করতেন। ১৯৩৯ সালে জমিদার নৃপেন্দ্রনাথ চৌধুরী, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, জাস্টিস জে এন মজুমদার ও নলিনী রঞ্চন সরকারকে সঙ্গে নিয়ে রণদা প্রসাদ ‘বেঙ্গল রিভার সার্ভিস’ নামে একটি নৌ-পরিবহন কোম্পানি চালু করেন। বেঙ্গল রিভার সার্ভিস মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথ সমূহে মালামাল পরিবহন করত। নৃপেন্দ্রনাথ চৌধুরী ছিলেন কোম্পানির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার মৃত্যুতে রণদা ওই পদে অধিষ্ঠিত হন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে অন্য শরিকদের কাছ থেকে সব অংশ কিনে নিয়ে কোম্পানির একক মালিকানা লাভ করেন। প্রকৃতঅর্থে এ অবস্থান থেকেই রণদা প্রসাদ সাহার উত্থান শুরু। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

জীবনপঞ্জি
> ১৮৯৬ : ১৫ নভেম্বর সাভার উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের কাচৈড় গ্রামে জন্ম। পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার এবং মাতার নাম কুমুদিনী দেবী।

> ১৯০৩ : মায়ের মৃত্যু।

> ১৯০৪ : বাবার দ্বিতীয় বিবাহ।

> ১৯০৩-০৫: তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা।

> ১৯১৫ : বাবার মৃত্যু।

> ১৯১৫ : আর্মি অ্যাম্বুলেন্স কোরে যোগদান।

> ১৯১৭ : বাঙালি পল্টন প্রতিষ্ঠা। ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগদান।

> ১৯১৯ : সৈনিক অবস্থায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব।

> ১৯২০ : ১৫ অক্টোবর বাঙালি পল্টন ভেঙে দিলে কলকাতায় এসে বিয়ে করেন।

> ১৯২২ : বড়মেয়ে বিজয়ার জন্ম।

> ১৯৩২ : রেলের চাকরিতে ইস্তফাদান। কয়লা ও নৌপরিবহন ব্যবসার সূচনা। ছোটমেয়ে জয়ার জন্ম।

> ১৯৩৮ : মির্জাপুরে মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপন।

> ১৯৪০ : মাগুরায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

> ১৯৪৩ : বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে রণদা কলকাতা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় চার মাস ধরে শতাধিক লঙ্গরখানা পরিচালনা করে ক্ষুধার্ত মানুষের সেবা প্রদান করেন।

> ১৯৪৪ : দানবীর ও রায়বাহাদুর খেতাব গ্রহণ। ছোট ছেলে ভবনীপ্রসাদের জন্ম।

> ১৯৪৫ : প্র-পিতামহীর নামে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতেশ্বরী হোমস।

> ১৯৪৬ : পিতার নামে মানিকগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন দেবেন্দ্র কলেজ।

> ১৯৪৭ : ‘কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ গঠন করেন।

> ১৯৬৮ : পৌত্র রাজীব প্রসাদ সাহার জন্ম বর্তমানে তিনি ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

> ১৯৭১ : ৭ মে রণদা প্রসাদ সাহা ও পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।


ভারতেশ্বরী হোমস
টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানায় রণদা প্রসাদ সাহা নিজের প্র-পিতামহী ভারতেশ্বরীর নামে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতেশ্বরী হোমস। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার জন্য ভারতেশ্বরী হোমসের নাম দেশজুড়ে সুবিদিত।
তদানীন্তনকালে ভারতেশ্বরী দেবী সুশিক্ষিত ও বিচক্ষণ বুদ্ধিসম্পন্ন নারী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। অনাথ রণদা প্রসাদ সাহাকে তিনিই স্নেহ দিয়ে ছেলেবেলায় শিক্ষা দেওয়ার আন্তরিক চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে রণদা প্রসাদ সাহা যখন জীবন সংগ্রামে জয়ী হলেন তখন এই পুণ্যময়ীর কথা স্মরণ করেন।
পরম আরাধ্য প্র-পিতামহীর স্মৃতি চিরঅম্লান করে রাখার জন্য ভারতেশ্বরী হোমস নামে ছাত্রীদের আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে মেয়েদের চরিত্রবান, সৎ ও আদর্শ নাগরিকরূপে গড়ে তোলা, তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতা জাগ্রত করা। সংস্থাটি পারস্পরিক সহনশীলতা ও ত্যাগের মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরি করে সুস্থ সমাজ গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ।
ভারতেশ্বরী হোমস বাংলাদেশের প্রথম আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিদ্যালয়টি ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৬২ সাল থেকে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি খোলা হয়। ১৯৭৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসএসসি পাসের পর অন্য কলেজে ভর্তি হওয়া, আবাসিক সমস্যা, সুন্দর পরিবেশের অভাব ইত্যাদি সমস্যার কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ ১৯৮৩ সালে এই প্রতিষ্ঠান আবার উচ্চমাধ্যমিক শাখা খোলেন।


দানবীর ও সেবক
দারিদ্র্যের কষাঘাতে রণদা প্রসাদ নিজে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হলেও নারী শিক্ষার জন্য তিনি কুমুদিনী চত্বরের ভেতরেই ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতেশ্বরী হোমস। প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী নার্সিং স্কুল। তিনি টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ, মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্রনাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা, মির্জাপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও মির্জাপুর এস কে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হলেও তিনি ভোগ-বিলাসে ব্যয় করেননি। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তার জীবনের অর্জিত সব অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল। এ ট্রাস্টের মাধ্যমেই তার নাতি কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহা মির্জাপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন কুমুদিনী মহিলা মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ ও কুমুদিনী হ্যান্ডিক্রাফট। ১৩৫০ সালের ভয়াবহ মন্বন্তরের সময় তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে একশরও বেশি লঙ্গরখানা খোলেন। ওই সময় সেখানে হাজার হাজার দরিদ্র লোক প্রতিদিন খাবার খেত।


অভিনয়শিল্পী রণদা
ভরতেশ্বরী হোমসের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এগুলোর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন স্বয়ং রণদাপ্রসাদ সাহা। ১৯৪৮ সালে বিপুল উৎসাহ নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন শৌখিন নাট্যসংঘ ও মঞ্চ। মঞ্চটি নির্মিত হয়েছিল আধুনিক পদ্ধতিতে এবং একে সাজিয়েছিলেন খ্যাতিমান শিল্পীরা। নতুন মঞ্চ, নতুন আঙ্গিকে নাটক অভিনয়ের এই সাহসী পদক্ষেপ তৎকালীন পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকায়ও দেখা যায়নি।
১৯৬৯ সালে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ রচিত ‘আলমগীর’ নাটকটি অভিনীত হয় আনন্দনিকেতনের (অডিটরিয়াম) মঞ্চে। অভিনয় চলে ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর। নাটকের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন রণদাপ্রসাদ নিজে। ৭৩ বছর বয়সে নাটকের প্রধান চরিত্র আলমগীরের ভূমিকায় আশ্চর্য অভিনয়-নৈপুণ্যে দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলেন তিনি। এই দুদিন তিনি যেন তার যৌবনে ফিরে গিয়েছিলেন।
যে কোনো নাটক মঞ্চায়নের আগে তিনি প্রবল উৎসাহে মহড়ায় লেগে যেতেন। ‘আলমগীর’ নাটকে অন্যান্য কলাকুশলী ছিলেন মনসুর রহমান, বাদলবন্ধু সাহা, মদন পোদ্দার, নিরঞ্জন সাহা, শ্যামলকান্তি চন্দ, ফজলুর করিম মল্লিক, সুবল পোদ্দার, গোপালচন্দ্র বণিক, রীনা দেবনাথ, আভা দাস। তিনি অভিনয়ে পেশাদার অভিনেতার মতোই চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন। এ-ও ছিল কাজের মধ্যে তার আনন্দলাভের আর একটি ধরন। বলা বাহুল্য, এই শিল্পীমনটি তার চরিত্রে অন্যতম মাত্রা যোগ করেছিল।


হারিয়ে যাওয়ার দিনটি
১৯৭১-এর জনযুদ্ধে অন্য অনেকের মতো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেন রণদাপ্রসাদ সাহাও। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় এগিয়ে এলেন। সাধারণ রোগীর ছদ্মবেশে আহত মুক্তিযোদ্ধারা আসত কুমুদিনী হাসপাতালে; পথ্য চিকিৎসা, ওষুধ, পথ্য ও অর্থ! গোপন ব্যাপারটি অবশ্য গোপন রইল না বেশি দিন।
১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল পুত্র রবিসহ রণদাপ্রসাদ সাহাকে আটক করে হানাদার বাহিনী। ৫ মে তারা ছাড়া পান। মৃত্যুগুহা থেকে ছাড়া পেয়ে পিতাপুত্র ফিরে যান নারায়ণগঞ্জে। প্রিয় জ্যাঠামণি ও রবিদাকে জীবিত ফিরে পেয়ে সবাই দারুণ খুশি। তারা ভাবলেন বিপদ বুঝি কেটে গেছে।
৭ মে নারায়ণগঞ্জে হানাদার বাহিনীর দোসররা রাত ১১-৩০ মিনিটে রণদাপ্রসাদ ও ভবানীপ্রসাদকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। রণদাপ্রসাদের পরিবার ও মির্জাপুর গ্রামবাসী দীর্ঘদিন তাদের ফেরার পথ চেয়েছিলেন। ৫ মে ঘাতকদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার ঘটনাতেই হয়তো এই আশাবাদ নিহিত ছিল। আশায় আশায় বহুদিন, মাস, বছর কেটে গেছে। তারা ফেরেননি। রণদাপ্রসাদ সাহা যখন পুত্রসহ হারিয়ে যান তখন তার বয়স ৭৪ বছর, আর রবির ২৭ বছর। রবি তখন ৩ বছর বয়সের এক পুত্রসন্তানের জনক।
তিনি নেই, কিন্তু মানবকল্যাণে নিবেদিত তার সত্তা মৃত্যুহীন।


স্মারকগ্রন্থ
রণদা প্রসাদ সাহা স্মারকগ্রন্থ। আনিসুজ্জামান, প্রতিভা মুৎসুদ্দি ও অন্যান্য আরও কয়েকজন মিলে সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থটি এই মহান মনীষীকে জানার আকরগ্রন্থ বলে ধরে নেওয়া যায়। তার জন্ম, জীবন ও কর্মভিত্তিক ইংরেজি এবং বাংলায় প্রায় ৭০টি প্রবন্ধ, ৫টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে রণদা প্রসাদ সাহা স্মারকগ্রন্থ। গ্রন্থটিতে দেশের বরেণ্য সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, সাংবাদিক, রণদার নিকটাত্মীয়, স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীরা তাকে নিয়ে সুন্দর-সাবলীল ভাষায় স্মৃতিচারণা করেছেন। রণদার বিভিন্ন বয়সের ছবি, পারিবারিক ছবি ও বংশতালিকা গ্রন্থটিকে আরও চিত্তাকর্ষক করে তুলেছে।

কুমুদিনী হাসপাতাল
সমাজসেবক রায়বাহাদুর রণদা প্রসাদ সাহার মানবসেবার আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কুমুদিনী হাসপাতাল। হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর ১৯৩৮ সালে স্থাপিত হলেও এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৪৪ সালে এবং তার মাতার নামে এটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘কুমুদিনী হাসপাতাল’।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে হাসপাতালে রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেওয়া হতো। ১৯৯৩ সাল থেকে চিকিৎসার জন্য রোগীদের কাছ থেকে সামান্য খরচ নেওয়া শুরু করে। এখনো ভর্তি হওয়া রোগীদের থাকা-খাওয়া সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। ১৯৭০ সালে কুমুদিনী হাসপাতালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি ওয়ার্ড যুক্ত হয়। এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা কারণ, সে সময় দেশে মরণব্যাধি যক্ষ্মার চিকিৎসার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। হাসপাতালে যক্ষ্মা রোগের স্বতন্ত্র ওয়ার্ড নির্মাণের আগে যক্ষ্মা রোগীদের নদীতে আচ্ছাদিত নৌকায় তৈরি ভাসমান ওয়ার্ডে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হতো।
কুমুদিনী হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোনো শ্রেণিভেদ নেই। এখানে কোনো কেবিন নেই। সবাইকে সমান গুরুত্বসহকারে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। ২০০০ সালে এখানে কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper