ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও কিছু কথা

মোতাহার হোসেন
🕐 ৯:৩২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০৯, ২০১৯

দেশে ক্রমাগত জনসংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা। কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় দেশে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। এমনি অবস্থায় দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নতুন নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন এবং উৎপাদন বৃদ্ধি অপরিহার্য। একই সঙ্গে খাদ্যের বিকল্প উৎসের সন্ধান জরুরি। অবশ্য ইতোমধ্যে সরকার খাদ্য নিরাপত্তা এবং খাদ্য চাহিদা পূরণে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে।

আশার খবর হচ্ছে, স্বাধীনতার ৪৭ বছরে নতুন জাতের একশ রকম (জাত) ধান উদ্ভাবন করেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের জন্য বছরে খাদ্য চাহিদা প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে দেশে কম-বেশি উৎপাদন হচ্ছে ৩ কোটি ৮৪ লাখ টন। এই হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকছে প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য।

সত্তরের দশকে ঢাকার অদূরে প্রতিষ্ঠিত হয় ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করে দেশের অঞ্চলভেদে, মাটির গুণাগুণ এবং মৌসুম ধান, গম, ভুট্টা, তৈলবীজ উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেয়। এই প্রতিষ্ঠান গত ৪৭ বছরে ৮৬ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। পরবর্তীতে এসব ধান কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটয়। সত্তরের দশকের প্রথমদিকে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রবর্তন করা হলো উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাত আই আর ৮। ব্রিবিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করলেন তিন মৌসুমে চাষের উপযোগী উফশী ধানের আধুনিক জাত বিআর-৩।

সত্যিকার অর্থেই জাতটি দেশের ধান উৎপাদনে বিপ্লবের সূচনা করে। আইআর-৮ ও বিআর-৩ এ দুটি উফশী জাত প্রবর্তন ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে মূলত আধুনিক ধান চাষের গোড়া পত্তন হয়। স্বাধীনতার সূচনা লগ্ন থেকে গত সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে ব্রি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। বন্যায়, জলমগ্ন এলাকার জন্য পানি সহিষ্ণু ধান, খরা সহিষ্ণু ধান, লবণ সহিষ্ণু ধান, শীতপ্রধান অঞ্চলের উপযোগী ধান, সরু ও সুগন্ধি প্রিমিয়াম বেকায়ালিটি ধান, জিংক-সমৃদ্ধ ধান (বিশ্বে প্রথম), হাইব্রিড ধানসহ গত ৪৭ বছরে ৮০টি ইনব্রিড ও ৬টি হাইব্রিড মিলিয়ে ৮৬টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি।

তথ্য অনুযায়ী, গত চার দশকে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। ১৯৭০-৭১ সালে দেশে চালের উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি টন। ৪৭ বছরের ব্যবধানে ২০১৭ সালে এসে দেশে যখন জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এখন চাল উৎপাদন হচ্ছে ৩ কোটি ৮৪ লাখ টনের বেশি।

যে জমিতে আগে হেক্টর প্রতি ২-৩ টন ফলন হতো, এখন উফশী জাতের ব্যবহারের কারণে ফলন হচ্ছে ৬ থেকে ৮ টন। অবশ্য ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর পত্রিকা সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছে, অতীতের খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ বর্তমানে উদীয়মান অর্থনীতির নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এই অর্জন সম্ভব হয়েছে কেবল চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বা খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত দেশের ৯০ ভাগ লোকের প্রধান খাবার ভাত। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৩৮ বছর মানুষ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরন্তর সংগ্রাম করলেও সফলতা এসেছে সম্প্রতি।

বিগত ২০০৯ সাল থেকে ধীরে ধীরে সরকারি উদ্যোগে বিশেষ করে কৃষিতে সময়মতো সহযোগিতা, প্রণোদনা প্রদান, স্বল্পমূল্যে সার, বীজ, কীটনাশক সরবরাহ দেওয়ায় খাদ্য উৎপাদনে সফলতা অর্জনের পথ সুগম হয়েছে।

এটি সত্য নানা সীমাবদ্ধতা মধ্যেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে দেশের ধান বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন। এজন্য তাদের অবদান এবং কৃতিত্ব অপরিসীম। উৎপাদন গতিশীলতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন হবে ৪ কোটি ৭২ লাখ টন। বিপরীতে ২০৫০ সালে ২১ কোটি ৫৪ লাখ লোকের খাদ্য চাহিদা পূরণে চাল প্রয়োজন হবে ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন। অর্থাৎ, গত পাঁচ বছরের চালের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে দেশে ২৬ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে বোরো মৌসুমে সর্বাধিক ফলন ও কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয় জাত ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯। অনুরূপভাবে আমন মৌসুমে সফলতার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে বিআর-১১ জাতটি। বিজ্ঞানীরা এ জাতগুলোকে বলেন মেগা ভ্যারাইটি (বহুল ব্যবহৃত জাত)।

সময়ের চাহিদার প্রেক্ষাপটে পরবর্তী সময়ে এই জাতগুলোর পরিপূরক অনেক জাত বিশেষ করে বোরো মৌসুমে ব্রি-৫০, ৫৮, ৫৯, আউশে ব্রি-৪৮, আমন মৌসুমে ব্রি-৪৯ ও ৬২ উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং সেগুলো মাঠ পর্যায়ে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

বিশ্বের সর্বপ্রথম জিংক-সমৃদ্ধ ধানের জাত ব্রি-৬২, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ ধান বিআর-৫, ডায়বেটিক ধানের জাত বিআর-১৬ ও ২৫ উদ্ভাবন এবং প্রো-ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইসের জাত উন্নয়ন করে সারা বিশ্বের সুনাম অর্জন করেছেন দেশের বিজ্ঞানীরা।

১৯৯৭ সালে রোপা আমন ধানের স্বল্প জীবন কালের জাত ব্রি-৩৩ উদ্ভাবন করে দেশের উত্তরাঞ্চলের মরা কার্তিককে ভরা কার্তিকে রূপান্তর করা হয়েছে। ওই সব এলাকায় মঙ্গাজনিত মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখছে ব্রি-৩৩সহ স্বল্প জীবন কালের জাত ব্রি-৫৬, ৫৭, ৬২, ৬৭, ৭১ ও ৭৫। এই জাতগুলোর গড় জীবনকাল ১০০ দিন। ফলে আগাম ধান তুলে কৃষকরা একই জমিতে পর্যায়ক্রমে একাধিক ফসল চাষ করতে পারেন।

এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সেই সঙ্গে মানুষের চাহিদা ও রুচির পরিবর্তন এসেছে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সরু সুগন্ধি এবং রপ্তানির উপযোগী প্রিমিয়াম কোয়ালিটির বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি। ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ধান, রক্তশূন্যতা ও ডায়রিয়া রোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী। প্রায় ২০ থেকে ২৪ পিপিএমজিংক-সমৃদ্ধ ব্রি-৬২, ৬৪, ৭২ ও ৭৪ অবমুক্ত করা হয়।

এমনি অবস্থায় আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্রমাগত আবাদি জমি হ্রাসের বিষয়টি গুরুত্বে এনে খাদ্য উৎপদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা এবং এই প্রক্রিয়াকে টেকসই করা জরুরি। তাছাড়া কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের এই ধারা অব্যাহত রাখতে পরিবর্তন প্রযুক্তি এবং সব রকম নীতি সহায়তা দিতে সরকারের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। এই দিকটি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কাছে এটাই প্রত্যাশা।

মোতাহার হোসেন : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (বিসিজেএফ)
[email protected]

 
Electronic Paper